বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি নিয়ে চলছে চালবাজি। ৩০ জুন সরকারের কাছ থেকে প্রায় ৪ লাখ টন চাল আমদানির অনুমোদন নিলেও নির্ধারিত সময়ে এলসি খোলেনি আমদানিকারক সিন্ডিকেট।
উলটো চালের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বাজারে তৈরি করেছে অস্থিরতা। বাড়িয়েছে দাম। এ অবস্থায় সরকারকে চাপে ফেলে ২৮ আগস্ট আমদানি শুল্ক মওকুপ ও রেগুলেটরি ডিউটি ২৫ শতাংশের জায়গায় ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের পর চাল আমদানির গতি বাড়িয়েছে সিন্ডিকেট হোতারা। এরপরও বাজারে চালের দাম কমেনি। ফলে কম শুল্কে চাল এনে বাড়তি দামে বিক্রি করে ক্রেতার পকেট কাটছে তারা।
মানুষকে জিম্মি করে অনৈতিক এই ব্যবসা চললেও রহস্যজনক কারণে চালবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে এই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ভোক্তাদের প্রশ্ন-তাদের কাছে কি অসহায় সরকারও।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, চালের বাজারে সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যখন যেভাবে চাচ্ছে সেভাবেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে মন্ত্রণালয়। এতে সাধারণের কোনো লাভ না হলেও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ও প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হচ্ছে। আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের কঠোর জবাবদিহিতায় আনা না গেলে চালের দাম কমানো সম্ভব না। বাজার নিয়ন্ত্রণে চাল সিন্ডিকেটের অসাধু সদস্যদের চিহ্নিত করে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আল মদিনা রাইস এজেন্সির মালিক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘যারা মিলার তারাই আমদানিকারক। তাদের সিন্ডিকেটের কারণে সব সময় চালের দাম বেড়ে যায়। সময় ও সুযোগ বুঝে তারা মূল্য কারসাজি করে থাকে। গুটি কয়েক আমদানিকারকের কাছে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা এবং ভোক্তা-সবাই জিম্মি। যাদের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তারাও নীরব।’
জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, ‘বেসরকারি পর্যায়ে যে চাল আমদানি করা হয়েছে তাতে দামে কোনো প্রভাব পড়েনি। যেটুকু প্রভাব পড়েছে তা ওএমএস-র চালে। যারা অনুমোদন নিয়েও চাল আমদানি করেনি বা এলসি খোলেনি তাদের নতুন করে আর বরাদ্দ দেওয়া হবে না। তাদের ব্যবসার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বরাদ্দ নেওয়ার পরও যারা চাল আনছে না তাদের আইআরসি সাসপেন্ড করার ব্যাপারে শিগগিরই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিদেশ থেকে নিজেদের কোম্পানির নামে বস্তাজাত করে চাল আমদানির কোনো সুযোগ নেই। এটা কেউ করে থাকলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে মামলার সুযোগ আছে।’
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, ৩০ জুনের এক আদেশে বেসরকারি পর্যায়ে নন-বাসমতি সিদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির জন্য ৯৫টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৪ লাখ ৯ হাজার টনের বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সাতটি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার টন। এগুলো হচ্ছে-ঢাকার মেসার্স মজুমদার ট্রেডার্স ২০ হাজার টন, মজুমদার এগ্রোটেক ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ২৫ হাজার টন, বগুড়ার মজুমদার প্রডাক্টস লিমিটেড ২০ হাজার টন, ঢাকার সেতু এন্টারপ্রাইজ ২৫ হাজার টন ও খুলনার কাজী সোবহান ট্রেডিং করপোরেশন ও মেসার্স কাজী এন্টারপ্রাইজ ৩০ হাজার টন ও মেসার্স গ্লোবাল এন্টারপ্রাইজকে ১০ হাজার টন করে চাল আমদানির বরাদ্দ পায়। এ সাতটি প্রতিষ্ঠান বাদে বাকি প্রায় সব প্রতিষ্ঠান ১/২ হাজার টনের বরাদ্দ পেয়েছে। এছাড়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ পেয়েছে ৪-৭ হাজার টনের মধ্যে।
বরাদ্দপত্রে সাত ধরনের শর্ত দেওয়া আছে। এগুলো হচ্ছে-২১ জুলাইয়ের মধ্যে বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে এলসি খুলতে হবে এবং এ সংক্রান্ত তথ্য (বিল অব এন্ট্রিসহ) খাদ্য মন্ত্রণালয়কে তাৎক্ষণিকভাবে জানাতে হবে। বরাদ্দপ্রাপ্ত আমদানিকারকদের ১১ আগস্টের মধ্যে সমুদয় চাল বাংলাদেশে বাজারজাত করতে হবে। আমদানি করা চালের পরিমাণ, গুদামজাত ও বাজারজাতকরণের তথ্য সংশ্লিষ্ট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রককে অবহিত করতে হবে। বরাদ্দের অতিরিক্ত আইপি ইস্যু করা যাবে না। আমদানিকৃত চাল স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠানের নামে পুনঃপ্যাকেটজাত করা যাবে না। আমদানিকৃত বস্তায় চাল বিক্রি করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যাংকে এলসি খুলতে ব্যর্থ হলে এ বরাদ্দ আদেশ বাতিল বলে গণ্য হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোনো আমদানিকারক এ শর্তগুলো মানছে না। শর্ত না মানায় আমদানিকারকদের বিরুদ্ধেও সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মন্ত্রণালয়ের নথিতে দেখা গেছে, শর্ত অনুযায়ী এলসি না খোলায় নির্ধারিত সময়ে (১১ আগস্টের মধ্যে) বেশিরভাগ চাল দেশে এনে বাজারজাত করেনি আমদানিকারকরা। উলটো ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ আগস্ট খাদ্য মন্ত্রণালয় এলসি খোলার সময়সীমা ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়েছে। এরপরও চাল আমদানির গতি সন্তোষজনক নয়। এসব আমদানিকারকরা প্রধানত ভারত থেকে যশোরের বেনাপোল, দিনাজপুরের হিলি ও সাতক্ষীরার ভোমরা বন্দরসহ আরও কয়েকটি পথে চাল আমদানি করে থাকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জুলাই থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ১০-১৫ জন আমদানিকারক মাত্র ৯০ হাজার ৯৭৫ টন চাল আমদানি করেছে। অথচ এর বিপরীতে ৯৫টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে চার লাখ টন চাল আমদানির বরাদ্দপত্র ইস্যু করা হয়েছে। দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর দিয়ে জুলাই ও আগস্টে আমদানি হয়েছে ১২ হাজার ১১৮ টন। আমদানি শুল্ক মওকুপ ও রেগুলেটরি ডিউটি ২০ শতাংশ কমানোর পর সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনেই আমদানি হয়েছে ১৫ হাজার ৩২০ টন। সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে জুলাই-আগস্ট দুই মাসে চাল আমদানি হয়েছে ১৯ হাজার ৫০২ টন। সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনেই আমদানি হয়েছে ১৫ হাজার ৪০২ টন। আর যশোরের বেনাপোল দিয়ে জুলাই ও আগস্টে চাল আমদানি করা হয়েছে ১৭ হাজার ৪২৭ টন। শুল্ক মওকুপের পর সেপ্টেম্বরের ১৫ দিনে আমদানি হয়েছে ১১ হাজার ২০৬ টন। তবে আমদানি, গুদামজাত ও বাজারজাতকরণের কোনো তথ্য জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিসকে অবহিত করেন না আমদানিকারকরা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু শর্ত ভঙ্গ নয়, সরকারি অনুমোদন নিয়ে চাল আমদানির নামে রীতিমতো অপরাধে জড়িয়েছে দেশের অন্যতম বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মজুমদার গ্রুপ। তাদের মেসার্স মজুমদার ট্রেডার্স, মজুমদার প্রডাক্টস লিমিটেড ও মেসার্স গ্লোবাল এন্টারপ্রাইজের নামে ৭০ হাজার টন চাল আমদানির বরাদ্দ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। এর বিপরীতে তারা আমদানি করেছে মাত্র ১৫ হাজার টন। ‘আমদানিকৃত চাল স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠানের নামে পুনঃপ্যাকেটজাত করা যাবে না। আমদানিকৃত বস্তায় চাল বিক্রি করতে হবে।’-এই শর্ত যাতে ভঙ্গ না হয় সেজন্য মজুমদার ট্রেডার্স জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়েছে। অন্ধপ্রদেশ থেকে ধান কিনে তারা কলকাতায় নিজেদের মিলে (কলকাতায় মজুমদার ট্রেডার্সের মালিক ও তার ভাইদের দুটি চালের মিল আছে।) চাল তৈরি করে বাংলাদেশের মজুমদার কোম্পানির নাম-ঠিকানায় বস্তাজাত করছে। এরপর সেই চাল স্থল ও জলপথে দেশে এনে বাজারজাত করছে। কাস্টমসের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তারা তাদের এই কাজে সহায়তা দিচ্ছে। খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদেরও এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।
বগুড়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আশ্রাফুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘মজুমদার গ্রুপের আমদানি করা চালের মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ৭৬৭ টন বগুড়ায় তোলা হয়েছে। ব্যাগিং রুল অমান্য করার কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে ৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তারপরও তারা এই অপরাধ করেই যাচ্ছে। প্রতিদিন একই প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তো আর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।’
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মজুমদার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিত্ত মজুমদার নিজস্ব কোম্পানির নামে করা বস্তায় চাল আনার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘এটা করলে মার্কেটে বিক্রি বেশি হয়। তাই এটা আমরা করে থাকি। বস্তার গায়ে আমদানিকারক হিসাবে আমাদের প্রতিষ্ঠানের নাম দেই। এটা অপরাধ না।’ বাজারে যখন চালের দাম বাড়ছে তখন আপনারা চাল আমদানি না করে দেশ ও মানুষকে বিপদে ফেলছেন কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কস্টিং না হলে আমি কি বাড়ি থেকে এনে দেব। এটা কেউ করবে না। সরকার ভর্তুকি দিতে পারে, ব্যবসায়ীরা লোকসান দিয়ে ব্যবসা করবে না। তারপরও আমরা চাল আনার কারণে বাজারে দামের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ঠেকানো গেছে।’
সোর্স : যুগান্তর