বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা পুলিশের দায়িত্ব। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের গুলিতে সাধারণ মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনায় খোদ বাহিনীটির মধ্যেই বির্তকের সৃষ্টি হয়েছে। অস্ত্রের ভাষা কখনোই ভালো ফল বয়ে আনে না। উল্টো হিতে বিপরীত হয়। সমাজ-রাষ্ট্রে অসন্তোষ ও ক্ষোভ বেড়ে যায়। আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় অতি উৎসাহী কতিপয় সদ্যসের ভূমিকার কারনে পুরো বাহিনীর সুনাম নষ্ট হচ্ছে। অথচ করোনাকালে এই বাহিনীর সুনাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের গুলি চালানো ঘটনা বেড়ে যাওয়া কোন সুলক্ষণ নয়। যেকোনো গোষ্ঠীর দাবি, শ্রমিক অসন্তোষ, বিক্ষোভ কিংবা প্রতিবাদ দমনে গুলি করে হত্যার অপসংস্কৃতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। এর মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এছাড়া পুলিশ কখন মানুষের উপর গুলি চালাতে পারে তা পুলিশ রেগুলেশনস বেঙ্গল (পিআরবি) বিধানে উল্লেখ আছে। এটি পুলিশ বাহিনীর পূর্ণাঙ্গ আচরণ বিধান। পুলিশের সকল সদস্য এ আচরণ-বিধান মেনে চলতে বাধ্য। অথচ কিছু সংখ্যক সদস্য তা মানছে না। যার ফলে গুলির ঘটনা বাড়ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, পিআরবির চতুর্থ অধ্যায়ের ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও গোলযোগের সময় পুলিশ কখন, কীভাবে, কতটা গুলি ব্যবহার করবে তা বর্ণনা করা আছে। এমনকি ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের কিছু ধারাতেও উল্লেখ আছে। পুলিশ প্রবিধানে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার শিরোনামের ১৫৩ ধারায় পুলিশকে তিনটি ক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
ব্যক্তির আত্মরক্ষা বা সম্পত্তি রক্ষার অধিকার প্রয়োগ, বেআইনি সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে এবং কতিপয় পরিস্থিতিতে গ্রেফতার কার্যকর করার জন্য (ধারা ১৫৩-ক)। ১৮৬০ সালের দন্ডবিধির ৯৬-১০৬ ধারাবলে পুলিশ নিজের বা অন্যের জানমাল রক্ষায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু সেটা তখনই করতে পারবে যখন জানমাল বেআইনিভাবে ধ্বংসের উপক্রম হবে। সেক্ষেত্রে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের বিকল্প নেই। কিন্তু সেক্ষেত্রেও আঘাত যতটুকু প্রতিকারও ঠিক ততটুকু করতে পারবে। এর বেশি নয় (ধারা ১৫৩-খ)। এই ধারায় বেআইনি সমাবেশে গুলিবর্ষণ একটি চরম ব্যবস্থা।
এ ক্ষেত্রে প্রথমে ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা নেতৃত্বদানকারী পুলিশ কর্মকর্তা (ম্যাজিস্ট্রেট না থাকলে) দাঙ্গাকারী জনতাকে বারবার ছত্রভঙ্গ হওয়ার জন্য অনুরোধ জানাবেন। তাতেও যদি কাজ না হয় তাহলে গুলিবর্ষণের হুমকি দিবেন। কিন্তু গুলি ছুঁঁড়তে পারবে না। এরপরও যদি উত্তেজিত জনতা সরে না যায় কিংবা জনগণের জানমাল যায় যায় অবস্থা এবং আর কোনো বিকল্প থাকে না তখনই কেবল গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেয়া যেতে পারে।
ওই কর্মকর্তারা আরো বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট বা উচ্ছপদস্থ কর্মকতা (ম্যাজিস্ট্রেট না থাকলে) নির্দেশ ছাড়া কোনো পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা সদস্য বেআইনি সমাবেশে গুলিবর্ষণ করতে পারে না। সংবিধানও পুলিশকে সে অধিকার দেয়নি। সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত: আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোন ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।
পুলিশ কারও প্রতিপক্ষ নয় উল্লেখ করে ডিএমপি কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, বিনা উসকানিতে পুলিশ হামলা চালালে পুলিশের কি লাভ আছে? যারা রাজনীতি করেন, তারা যদি বুঝে শুনে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে কর্মসূচিগুলো পালন করেন, তাহলে তো কোনও সঙ্ঘাত হয় না। যখন মানুষের প্রাণহানি, সম্পদহানির শঙ্কা দেখা দেয়, তখন পুলিশ হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়।
তিনি বলেন, বিভিন্ন পক্ষ মাঠে আছে, কোনও পক্ষ কাউকে সহ্য করতে পারে না। এর দায় পুলিশ কেন নেবে। যখন সমাবেশের অনুমতি চাওয়া হয়, তখন পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আমরা সমাবেশের অনুমতি দিয়ে থাকি। আর যদি বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখি কোনও ধরনের সমস্যার আশঙ্কা থাকে, তাহলে স্থানান্তর করে অন্য জায়গায় করার কথা আমরা জানিয়ে দিই। যদি কোনও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি না হয়, তাহলে বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ করায় সহায়তা করা হবে।
মানবাধিকার কর্মী নূরখান লিটন বলেন, নাশকতা, সন্ত্রাস ও দাঙ্গা-হঙ্গামা বন্ধের কৌশল আছে। শুধু কৌশল নয়, আইনও আছে। আইনে সরাসরি গুলির কথা কোথাও বলা হয়নি। লাঠিচার্জ, টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেটসহ আরো অনেক কৌশল ব্যবহারের পরই গুলির প্রশ্ন আসে। আর গুলি করার উদ্দেশ্য হবে হত্যা নয়, ছত্রভঙ্গ বা নিবৃত্ত করা।
তিনি বলেন, বিরোধী দলের যে আন্দোলন চলছে তাতে সহিংসতা হচ্ছে। কিন্তু এই সহিংসতা বন্ধে সরাসরি গুলি করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। সহিংসতা না কমে বরং আরো বেড়ে যেতে পারে। তিনি মনে করেন, সম্প্রতি আন্দোলন প্রতিরোধে পুলিশ দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে।
গত ১ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে বিএনপির ৪৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে শোভাযাত্রা বের করতে গেলে বাধা দেয় পুলিশ। এক পর্যায়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় নারায়ণগঞ্জ ডিবির এসআই মাহফুজুর রহমান কনক সহকর্মীর কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লে যুবদল কর্মী শাওন মাহমুদ ওরফে আকাশ (২০) গুলিবিদ্ধ হন। পরে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার এনায়েতনগর ইউনিয়ন যুবদলের কর্মী ছিলেন। এ ঘটনায় আরো বেশ কয়েকজন আহত হন।
সেদিনের ঘটনার ভিডিও ও স্থিরচিত্রে দেখা যায়, বিএনপির নেতা-কর্মীরা যখন পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়ছিলেন, তখন কনক দাঁড়িয়ে, নিচের দিকে খানিকটা ঝুঁঁকে এবং হাঁটু গেড়ে সরাসরি নেতা-কর্মীদের দিকে গুলি করছেন। পুলিশ কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, সেদিন কনককে কোনো অস্ত্র দেয়া হয়নি। তিনি সেখানে যান হাতে লাঠি নিয়ে। সংঘর্ষ চলাকালে তিনি অন্য এক পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে গুলি করেন।
একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সংঘর্ষের আগে মাহফুজ কনক অন্য ডিবি পুলিশদের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছেন। কনকের ডান হাতে একটি লাঠি আর বাম হাতে ওয়্যারলেস। আরেক অংশে দেখা যায় কনকের হাতে চাইনিজ রাইফেল। তিনি গুলি করছেন বিএনপির নেতা-কর্মীদের দিকে। কনক সেই ঘটনার চার বা পাঁচ দিন আগে ভোলা থেকে নারায়ণগঞ্জে বদলি হয়ে আসেন। তিনি ভোলায় থাকাকালেও পুলিশের গুলিতে বিএনপির মিছিলে দুই জনের মৃত্যু হয়। তবে সেই গুলি কে বা কারা ছুড়েছিল, সেটি প্রকাশ পায়নি।
নারায়ণগঞ্জ পুলিশের ইন্সপেক্টর শরফুদ্দিন ভূঁইয়া জানান, শটগান ও রাইফেল থাকে কনস্টেবলদের কাছে। এসআইদের কাছে পিস্তল থাকে। তবে কারো কারো কাছে শটগানও থাকে। মাহফুজ কনক যে রাইফেল দিয়ে গুলি করেছে, সেটি কার দায়িত্বে ছিল, সে প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি শরফুদ্দিন। তবে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইনসে কর্মরত একাধিক পুলিশ সদস্য নিশ্চিত করেছেন, রাইফেলটি ছিল লিটন নামে এক পুলিশ সদস্যের। তার পুরো নাম অবশ্য জানাতে পারেননি তারা।
অন্যদিকে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি ও লোডশেডিংয়ের প্রতিবাদে গত ৩১ জুলাই বিক্ষোভ সমাবেশ করে ভোলা জেলা বিএনপি। ওই মিছিলে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে ওই দিনই নিহত হন স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী রহিম। গুলিবিদ্ধ হন জেলা ছাত্রদলের সভাপতি নূরে আলম। তিন দিন পর গত ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
সোর্স : ইনকিলাব