ড. মো. নূরুল আমিন
প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনাই মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক। যারা বহুমুখী প্রতিভা ও গুণের অধিকারী, সমাজ থেকে নেয়ার পরিবর্তে দিয়েছেন বেশি, সততা নিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে কাজ করেছেন, জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং সোজা কথায় সমাজের বিবেক ও পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছেন তাদের মৃত্যু বা তিরোধান সহজে ভোলার মতো নয়। তাদের মৃত্যুতে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয় আল্লাহ সহায় না হলে এই ক্ষতি শতাব্দীতেও পূরণ হয় না। এই মাসের শুরুর দিকে দু’টি মর্মান্তিক মৃত্যু আমাকে একথাগুলোই স্মরণ করিয়ে দেয়। এ দুটি মৃত্যুর একটি হচ্ছে সাবেক অর্থ ও কেবিনেট সচিব, কেয়ারটেকার সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খানের আরেকটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বঙ্গবন্ধু হলের প্রভোস্ট এবং রাজশাহীর মসজিদ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জনাব নূরুল ইসলামের। গুণিজনের সম্মান করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। গুণিজনকে সম্মান না করলে সমাজে গুণিজনের সৃষ্টি হয় না।
ড. আকবর আলি খানকে দিয়েই শুরু করি। ড. খানের সাথে আমার পরিচয় ১৯৮২ সালের দিকে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সেচ শাখায় তখন তিনি উপসচিবের দায়িত্ব পালন করছিলেন। আমি তখন ডেপুটেশনে পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মরত ছিলাম। চাঁদপুর সেচ প্রকল্প, মুহুরী সেচ প্রকল্প, কর্ণফুলী সেচ প্রকল্প, মনু সেচ প্রকল্প, বরিশাল সেচ প্রকল্প, পাবনা সেচ প্রকল্প প্রভৃতি প্রকল্পের পরিচালনা সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে আমাকে প্রায়ই মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে হতো এবং ডেস্ক অফিসার হিসেবে তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতার সৃষ্টি হয়। তিনি অত্যন্ত দক্ষ ও বন্ধুবৎসল একজন কর্মকর্তা ছিলেন। সততা, নিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা তার অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি অগাধ পা-িত্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি রসিকতায়ও পারদর্শী ছিলেন। তার দুটি রসিকতা আমার সব সময় মনে পড়ে। তিনি বলতেন, বাংলাদেশের মানুষকে আল্লাহ তায়ালা কখনো জাহান্নামে পাঠাবেন না। কারণ বাংলাদেশ স্বয়ং একটি জাহান্নাম। আল্লাহ ন্যায়বিচারক, তিনি তার বান্দাদের দু’বার শাস্তি দেবেন না।
তার আরেকটি চুটকি ছিল, দুনিয়ার যত বড় নাস্তিকই হোক বাংলাদেশে এসে তিনি আর নাস্তিক থাকতে পারেন না। তাকে আস্তিক হতেই হবে। কেননা এই দেশটি যেভাবে চলছে তাতে এখানে কোনো শাসক আছে বলে মনে হয় না। শাসকের কাজ হচ্ছে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। এখানে তা নেই। সুশাসনের অভাব সত্ত্বেও দেশটি এগিয়ে যাচ্ছে। কাজেই বুঝতে হবে যে মানুষের অনুপস্থিতিতে নিশ্চয়ই দেশটিকে আল্লাহ চালাচ্ছেন। এই বিষয়টি যিনি বা যারা অনুধাবন করতে পারবেন তিনি বা তারা কিছুতেই আস্তিক না হয়ে পারবেন না। তিনি ইতিহাসের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। ডক্টরেট করেছিলেন অর্থনীতিতে। এক্ষেত্রেও তিনি নিজের মেধার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তিনি উন্নতমানের একজন গবেষক ছিলেন। ড. আকবর আলি খান একজন উঁচুমানের লেখকও ছিলেন। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে রয়েছে পরার্থপরতার অর্থনীতি, অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনা জালে রাজনীতি, বাংলাদেশে বাজেট অর্থনীতি ও রাজনীতি, দারিদ্র্যের অর্থনীতি, অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যত, আজব ও জবর আজব অর্থনীতি, বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য Discovery of Bangladesh, Freindly Fires Humpty Dumpty Disorders, Gresham’s Law Syndrome and Beyond, Peoples Participation in Badgetary Process, চাবিকাঠির খোঁজে নতুন আলোকে জীবনানন্দের বনলতা সেন, পুরানো সেই দিনের কথা প্রভৃতি। তার সবগুলো বই-ই জীবনধর্মী, যতই পড়েছি ততই অভিভূত হয়েছি। Gresham’s Law-এর Bad money drives good money out of Market -এই সূত্রকে তিনি অত্যন্ত নিপুণভাবে আমাদের বর্তমান সমাজের সাথে তুলনা করে দেখিয়েছেন। কীভাবে আমাদের দেশের খারাপ মানুষগুলো নেতৃস্থানীয় সকল পদ ও পদবী দখল করে ভালো মানুষগুলোকে কোণঠাসা করে দিচ্ছে। এই অবস্থায় একটা জাতি ও সভ্যতা টিকে থাকা দায়। ড. আকবর আলি কখনো জীবনের গতি হারাননি। যখন যে অবস্থায় ছিলেন জাতির খেদমত করে গেছেন; রাষ্ট্রকে দিকনির্দেশনা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আল্লাহ তার দোষত্রুটি ক্ষমা করুন এব বেহেশত নসীব করুন।
এরপর আসি অধ্যাপক নূরুল ইসলাম প্রসঙ্গে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত উঁচুমানের একজন শিক্ষক, হলের প্রশাসক, ইসলামী আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ নেতা ও কর্মী এবং সমাজসেবক ছিলেন। তারই এক সহকর্মী তার মৃত্যুতে গত ১০ সেপ্টেম্বর ‘অর্ধশতাব্দীর বন্ধন’ শিরোনামে তার সম্পর্কে যা লিখেছেন তার অংশবিশেষ আমি এখানে তুলে ধরছি। তিনি বলেছেন, ‘অর্ধশতাব্দীর জাগতিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে গেল। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক, ছাত্রী সংস্থার তিন সভানেত্রী শিউলি, সীমা, শিরিনের প্রিয়তম আব্বা আমাদের কাছ থেকে চিরবিদায় নিলেন। রাজশাহীর ইসলামী আন্দোলন এক মহীরূহ থেকে বঞ্চিত হলো, একটা যুগের অবসান হলো।
‘অধ্যাপক নূরুল ইসলামকে যারা কাছে থেকে না দেখেছেন তাদের পক্ষে তাকে মূল্যায়ন করা কঠিন। মিটিং-মিছিল, শোভাযাত্রায় খুঁজলে তাকে পাওয়া যাবে না, তবে যেখান থেকে এসব শুরু হয় সেখানে তার হাতের পরশ সাবলীল। আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সফর, সাথে এক গাদা মেহমান। দেখভাল মেহমানদারির দায়িত্ব কে নেবে। মাঠে ময়দানের দায়িত্বশীলগণ নিশ্চিত এ কারণে যে নূরুল ইসলাম স্যার এ দায়িত্ব নিয়েছেন।
অধ্যাপক আবুল হাসেম অনেক ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন, কীভাবে মেহমানদের এটো বাসন কোসন তিনি নিজ হাতে পরিষ্কার করেছেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রাজশাহী মসজিদ মিশন প্রতিষ্ঠা করেছেন, মিশন স্কুল ও কলেজ তৈরির সময় রাজমিস্ত্রিদের সাথে নিজে কাজ করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। ছাত্র ইসলামী আন্দোলনের হল ও মেসচ্যুত ছাত্রদের তিনি কীভাবে নিজ বাড়িতে মাসের পর মাস ছায়ার মতো আশ্রয় দিয়েছিলেন তার বর্ণনাও দিয়েছেন। তিনি রাজশাহী মহানগরীর নায়েবে আমীর হিসেবেও অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন যা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।
অধ্যাপক নূরুল ইসলামের সাথে আমার সম্পর্ক অনেকটা বিস্ময়কর। আমি তখন ছদ্মনামে কলাম লিখতাম। তিনি আমার লেখার একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন। এই লেখার সূত্র ধরেই তিনি আমার আসল পরিচয় সংগ্রহ করেন এবং মেয়ের খোঁজ পান। মেয়েটি তখন ঢাকা মহানগরী ছাত্রী সংস্থার অফিস সেক্রেটারি ছিল। এই সূত্র ধরেই তিনি তার বড় ছেলের জন্য আমার মেয়েকে পছন্দ করেন এবং আমার ছোট মেয়ে খাদিজাতুল কোবরা কলির সাথে তার পুত্র আশরাফুল ইসলাম সেলিমের বিয়ে হয়। তাকে আমি সব সময় নিবেদিতপ্রাণ একজন দাঈ, বিনয়ী ও দরদী একজন আত্মীয় এবং উঁচুমানের একজন ভদ্রলোক হিসেবেই দেখেছি। সব সময় তার মুখে হাসি লেগে থাকতো।
যতবার আমি রাজশাহী গিয়েছি তার বাড়িতেই মেহমান হয়েছি এবং অনুপম আতিথেয়তা পেয়েছি। বিনোদপুরে তার যে ডুপ্লেক্স বাড়িটি তিনি করেছেন তা একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। ব্যাংক লোন না নিয়ে প্রত্যেক বছর অল্প অল্প করে বাড়িটি তিনি তৈরি করেছেন। এমনভাবে করেছেন যাতে সাংগঠনিক মেহমান এবং নিগৃহীত ছাত্ররাও প্রয়োজনবোধে এখানে অবস্থান করতে পারেন।
অবসরগ্রহণের পর মিশন স্কুল ও কলেজের কাজেই তিনি বেশিরভাগ সময় কাটাতেন। দুর্ভাগ্যবশত এই নিঃস্বার্থ মানুষটি বর্তমান সরকারের রোষানল থেকে রক্ষা পাননি। তিনি একাধিক মামলার আসামীও ছিলেন এবং বার বার আদালতে হাজিরা দিতে হতো। এই জুলুম তাকে হাইপারটেনশনের রোগী বানিয়ে দিয়েছিল এবং বছর দুয়েক আগে তিনি স্ট্রোক করেন এবং চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলেন। সেইযে বিছানায় পড়লেন তা থেকে তিনি আর উঠতে পারেননি। দ্বীনের একজন দাঈ, একজন শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী মহৎপ্রাণ মানুষকে আমরা হারালাম। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন, আমিন।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম