স্টাফ রিপোর্টার: মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের কারণে উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে থাকা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্ত পরিদর্শনে গেছেন প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল। বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভিন তিবরীজি, পুলিশ সুপার মো. তারিকুল ইসলামসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গতকাল সোমবার সকাল ১০টার দিকে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং পৌঁছান। এ সময় কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছিল। নিরাপত্তার কারণে এই স্কুলেই পরীক্ষা দিচ্ছে বান্দরবানের ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ে পরীক্ষার্থীরা।
কেন্দ্রটি পরিদর্শন শেষে জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভিন তিবরীজি সাংবাদিকদের বলেন, “মিয়ানমারের অভ্যন্তরের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রটি ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে কেন্দ্রটি উখিয়ার কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ কেন্দ্রে সব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।” তিনি আরও বলেন, “শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পরীক্ষা দিচ্ছে। একই সঙ্গে সীমান্তের কাছের ঝুঁকিপূর্ণ বাসিন্দাদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রয়োজনে এসব এলাকার মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতিও রয়েছে।” সীমান্ত পরিস্থিতি সার্বিক পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।
এর আগে রোববার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে প্রস্তুতি সভা হয়েছে। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঝুঁকিপূর্ণদের তালিকা প্রস্তুত রয়েছে।
বান্দরবানের পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম বলেন, সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা দিতে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। শুক্রবার এপারে মর্টার শেল এসে হতাহতের পর একটু উদ্বেগ থাকলেও পুলিশের পক্ষে প্রশাসনের নিদের্শনা মতে কাজ করার প্রস্তুতি রয়েছে।
উখিয়ার কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বের হয়ে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ১২টার দিকে ঘুমধুম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যান। সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করেন তারা। এরপর কর্মকর্তারা ঘুমধুম পুলিশ ফাঁড়িতে যান। সেখান থেকে সীমান্তের অন্যান্য এলাকাও পরিদর্শনে যাওয়ার কথা রয়েছে তাদের।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর তুমুল লড়াই চলছে। মধ্য আগস্ট থেকে এর প্রভাব পড়তে শুরু করে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু, কোণাপাড়া, উত্তরপাড়া ও বাইশফাঁড়িসহ বিভিন্ন সীমান্তে। প্রায় প্রতিদিনই ওপারে চলছে দিনেরাতে থেমে থেমে গোলাবারুদ বর্ষণ; এতে এপারের বাসিন্দাদের দিন কাটছে চরম আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে। এরই মধ্যে ঘুমধুম সীমান্তের ৩৫টি স্থানীয় পরিবার এবং কোনারপাড়া শূন্যরেখার আশ্রয় ক্যাম্প থেকে আতঙ্কিত রোহিঙ্গাদের অনেকে ইতোমধ্যে সরে গেছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
এর আগে গত শুক্রবার রাতে মিয়ানমার থেকে আসা গোলা সীমান্তের শূন্যরেখায় অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিস্ফোরিত হলে একজন নিহত ও পাঁচজন আহত হন। ওইদিন সকালেই ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে ‘মাইন’ বিস্ফোরণে এক বাংলাদেশি যুবকের পা উড়ে যায়।
এর আগে গত ২৮ আগস্ট দুপুরে বান্দরবানের ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার থেকে দুটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ে। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের দুটি যুদ্ধবিমান ও দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টারের গোলা বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে এসে পড়ে।
মিয়ানমার থেকে গোলা এসে পড়া এবং হতাহতের ঘটনায় দেশটির রাষ্ট্রদূতকে চার দফা তলব করে প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের তরফ থেকে এসব ঘটনার জন্য আরাকান আর্মিকে দায়ী করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সীমান্তে বিজিবিকে সতর্কাবস্থায় রাখার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তবে সীমান্তে এখনই সেনা পাঠানো হচ্ছে না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, “আমাদের বর্ডার গার্ড যথেষ্ট শক্তিশালী। তাদের মনোবল যথেষ্ট আছে। তারা আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত।”
ভোর থেকেই মুহুর্মুহু গোলাগুলী : বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু পশ্চিমকুল গ্রাম। দক্ষিণ দিকে ১০০ গজ দূরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের তুমব্রু পাহাড়ে দেশটির বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সীমান্তচৌকি। চৌকির নিচে ঘাঁটি। ঘাঁটির আশপাশ থেকে ছোড়া হচ্ছে মুহুর্মুহু গুলী। থেমে থেমে ছোড়া হচ্ছে আর্টিলারি, মর্টার শেলের গোলা।
গোলার শব্দে কাঁপছে এপারের তুমব্রুর পশ্চিমকুল, ক্যাম্পপাড়া, বাজার পাড়াসহ অন্তত ১৫ গ্রামের ঘরবাড়ি। এ অবস্থায় সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার।
স্থানীয় পশ্চিমকুল গ্রামের কৃষক ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল হোসেন বলেন, রোববার সকালে গোলাগুলী শুরু হয়। চলে ভোররাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত। দেড় ঘণ্টা বিরতি দিয়ে ভোর পাঁচটায় আবার গোলাগুলী শুরু হয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ১৬টির মতো মর্টার শেল ছোড়া হয়েছে। শব্দে ঘরে থাকা যাচ্ছে না।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ভোররাত থেকে ওপারে গোলাগুলী চলছে। থেমে থেমে ছোড়া হচ্ছে মর্টার শেল। কাঁপছে এপারের ভূখ-। দুই মাস ধরে চলা মিয়ানমারের গোলাগুলীতে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন না এলাকার হাজারো মানুষ। সীমান্ত এলাকার চাষাবাদ প্রায় বন্ধ। সীমান্ত এলাকার অন্তত ৩০০ পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়ার ৫০ গজ দূরত্বে পশ্চিমকুল গ্রামের কৃষক আবদুর রশিদের বাড়ি। সপরিবার বাড়িতে থাকছেন তিনি। আবদুর রশিদ বলেন, ‘কী করব ভেবে পাচ্ছি না, গোলার আতঙ্কে রাত জেগে বসে থাকতে হচ্ছে।’
গোলার আতঙ্কে ঘুম আসে না, চলছে গৃহবন্দী জীবন : তুমব্রু সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দুই মাস ধরে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির যুদ্ধ চলছে। চার দফায় মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল ও গুলী বাংলাদেশ ভূখ-ে এসে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। গত শুক্রবার মর্টার শেলের আঘাতে শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গা কিশোর মো. ইকবালের মৃত্যু হয়। আতঙ্কে আছেন ঘুমধুম ইউনিয়নের অন্তত ১২ হাজার বাসিন্দা। সেখানকার এক বাসিন্দা মনোয়ারা বেগমের (২৩) বয়ানে ওঠে এল বর্তমান পরিস্থিতি।
মনোয়ারা বেগম বলেন, দুই মাস ধরে সীমান্তের ওপারে গোলাগুলী চলছে। বাড়ির কাছে একটি মর্টার শেল পড়েছে। একজন রোহিঙ্গা মারা গেছে। গোলাগুলীর শব্দে ঘুমাতে পারি না। বিকট শব্দে ঘরবাড়ি কেঁপে ওঠে। গোলার আতঙ্কে ঘুম আসে না। যুদ্ধ শুরু হলে কোথায় ঠাঁই নেব, ভেবে পাচ্ছি না। গৃহবন্দী অবস্থা চলছে।
আড়াই বছর ধরে মনোয়ারা এলজিইডির সড়ক পরিষ্কারের কাজ করেন। তিনি বললেন, ১০ থেকে ১৫ দিন ধরে সড়কে লোকজনের চলাচল সীমিত হয়ে পড়েছে। গাড়িও তেমন চলে না। সড়কে বিজিবি টহল দেয়। মানুষ জরুরি কাজে বের হলেও দ্রুত ঘরে ফিরে যান।
মনোয়ারার স্বামী মারা গেছেন বছর তিনেক আগে। বৃদ্ধা মা ও দুই ছেলে মো. আরিফ ও মো. রিফাতকে নিয়ে তার সংসার। কাজ করে দিনে ১৭৫ টাকা পান। এই আয়ে সংসার চলতে চায় না। দুই মাস ধরে এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা, দোকানপাট প্রায় বন্ধ। এলাকাতে কাজ-কর্ম নেই। শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা অনেক খারাপ। কেউ কোনো ত্রাণ সহায়তা দেননি তাদের।
গোলাগুলী কখন হয়, জানতে চাইলে মনোয়ারা বলেন, ঠিক-ঠিকানা নেই। সকালে হয়, রাতেও হয়। সড়কে দাঁড়িয়ে ওপারের (রাখাইন রাজ্যের) পাহাড় থেকে ছোড়া গোলার আগুন দেখা যায়। রাতের বেলায় গোলা ছোড়া হলে আকাশ আগুনের শিখায় লাল হয়ে ওঠে। ঘরবাড়ি কাঁপতে থাকে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে কী করবেন, এই নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই তার। বললেন, ঘরে ৬০ বছরের অসুস্থ মা ও ছোট ছোট দুই ছেলে। ঠিকমতো সংসার চলে না; এর মধ্যে কোথাও সরে যেতে হলে কী পরিস্থিতি যে হবে, তিনি ভাবতেও পারছেন না। গোলাগুলী বন্ধ হয়ে তারা যেন দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে যেতে পারেন, সেটাই তার একমাত্র চাওয়া এখন।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম