জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য প্রায় একশ কোটি টাকার উত্তরপত্র এবং ওএমআর ফরম কিনছে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত দরপত্রের কয়েকটি শর্ত নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজটি পাইয়ে দিতে ওইসব শর্ত আরোপের অভিযোগ করেছে প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো। এ কারণে কাজটি মনোপলি হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটি কোটি টাকা গচ্চা যেতে পারে। এর আগেও বিশ্ববিদ্যালয়টি একই ধরনের কাজ করেছে বলে অভিযোগ আছে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে দরপত্র খোলা হবে।
দরপত্রে নির্ধারিত শর্তের মধ্যে আছে, গত ৩ বছরে একক কার্যাদেশে ১৫ কোটি টাকার ওএমআরসহ উত্তরপত্র সরবরাহের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। একই সঙ্গে এ ধরনের সর্বমোট ২৫ কোটি টাকার কাজে অভিজ্ঞতাও থাকতে হবে। বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছরের মধ্যে একক কার্যাদেশে কমপক্ষে ১ কোটি লিথোকোড ও কিউআর কোডযুক্ত ওএমআর ফরম সরবরাহের অভিজ্ঞতাও থাকতে হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব শর্ত কেবল নির্দিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠান পূরণ করতে পারবে। ওই প্রতিষ্ঠানটি বিগত তিনটি কেনাকাটায়ই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তরপত্র সরবরাহ করছে বলে জানা গেছে। তাদের সামনে রেখেই এ ধরনের দরপত্র দলিল তৈরি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ও এই দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রধান অধ্যাপক আবদুস সালাম হাওলাদার যুগান্তরকে বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই দরপত্র ডাকা হয়েছে। মালামাল ক্রয়ের নির্ধারিত শর্ত সিন্ডিকেটের অনুমোদনের পরই নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এত বড় কাজে বেশি অঙ্কেঅভিজ্ঞতা চাওয়া যেতেই পারে। তবে এখানে আইনের কোনো ব্যত্যয় হয়েছে কিনা সেটা খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রকিউরমেন্ট’ শাখার মাধ্যমে এই দরপত্রের কাজ পরিচালিত হওয়ার কথা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে কাজটি করানো হচ্ছে প্রকৌশল বিভাগের মাধ্যমে। প্রকিউরমেন্ট শাখার পরিচালক মো. আবু হানিফ বিষয়টি নিশ্চিত করে যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী এটি তার বিভাগের কাজ। কিন্তু বেআইনিভাবে প্রকৌশল বিভাগ করছে।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় এবার ৩ কোটি ওএমআর ফরমসহ উত্তরপত্র কিনছে। প্রতিটি খাতায় ৩০টি পৃষ্ঠা থাকছে। এছাড়া অতিরিক্ত খাতা কেনা হচ্ছে ৪ কোটি। এর প্রতিটিতে থাকবে ১২ পৃষ্ঠা। লিথোকোডের ওএমআর ফরমসহ কভার পেজ ছাপানো উত্তরপত্র সরবরাহের কাজ বাংলাদেশে ছয়-সাতটি প্রতিষ্ঠান করে থাকে। এগুলোর মধ্যে আছে বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার লিমিটেড, এলিট প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, এশিয়া বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েটস, বসুন্ধরা পেপার মিলস লিমিটেড, প্রিন্ট মাস্টার এবং মাস্টার সিমেক্স পেপার লি.। এগুলোর মধ্যে শেষেরটি কয়েক বছর ধরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তরপত্র এবং ওএমআর ফরম সরবরাহ করে আসছে।
রেকর্ড ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে একই কাজের জন্য এমএন মল্লিক ২৭ কোটি ২৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা দর দিয়েছিল, আর এলিট প্রিন্টিং দিয়েছিল ৩২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। ওই বছর তৃতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা ছিল মাস্টার সিমেক্স। তারা প্রায় সাড়ে ৩৩ কোটি টাকায় কাজটি পেয়েছিল। ২০১৮ সালে একই ধরনের কেনাকাটায় এলিট প্রিন্টিং দর দিয়েছিল ৩২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। কিন্তু প্রায় ৪২ কোটি টাকায় সেই কাজটি পেয়েছিল মাস্টার সিমেক্স। সর্বশেষ ২০১৯ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একইভাবে উত্তরপত্র ও ওএমআর ফরম কেনে। তখনো একইভাবে কিছু শর্ত দিয়েছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ওই বছরও উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানটি কাজ পায়। সেই হিসাবে বড় আকারের কাজের অভিজ্ঞতা কেবল এই প্রতিষ্ঠানটিরই আছে।
এ প্রসঙ্গে মাস্টার সিমেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেওয়ান আলী কবির যুগান্তরকে বলেন, তাকেই কাজটি দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট শর্ত আরোপের অভিযোগ সঠিক নয়। এত বড় কাজে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নিজেদের নিরাপত্তগত স্বার্থে যে কোনো শর্ত আরোপ করতেই পারে। আমি মনে করি, এখানে সরকারি ক্রয় আইনেও (পিপিআর) কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। আর এর আগে প্রত্যেকবারই সর্বনিম্ন দরদাতা হয়েই তারা কাজ পেয়েছেন। অন্য যারা কম দর দিয়েছিল তারা প্রকৃত খাতা প্রস্তুতকারী ছিল না, সরবরাহকারী ছিল বলেই কাজ পায়নি।
এদিকে একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে শর্ত আরোপের অভিযোগ এনে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের একটি প্রিন্ট মাস্টার। প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা ড. আরবাব আকন্দ উল্লেখ করেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোনো বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয় গত তিন বছরে লিথোকোড অ্যান্ড কিউআর কোডযুক্ত ওএমআর ফরমসহ উত্তরপত্র কেনাকাটায় একক দরপত্রে ১৫ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেয়নি। তাছাড়া কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে গত কয়েক বছরে সীমিত আকারে পরীক্ষা নিয়েছে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড। ফলে কয়েক বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এককভাবে কাজ করছে যে প্রতিষ্ঠান, সেটি ছাড়া আর কেউ দরপত্রের শর্ত পূরণ করবে না। এতে দরে কোনো প্রতিযোগিতা থাকবে না। কাজটি মনোপলি হতে পারে। ফলে সরকারের অর্থ অপচয়ের শঙ্কা আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডও উত্তরপত্র এবং ওএমআর ফরম কেনাকাটা করে থাকে। ১১টি বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে বড় কেনাকাটা করা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান সিস্টেম অ্যানালিস্ট মনজুরুল কবীর যুগান্তরকে বলেন, তারা তিনটি পরীক্ষার জন্য বছরে সর্বোচ্চ ১৭-১৮ কোটি টাকার কেনাকাটা করেন। এবারের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার জন্য প্রায় ১১ কোটি টাকার খাতা কেনা হয়। এতে ৬৮ লাখ ৬৫ হাজার উত্তরপত্র আর ৪৬ লাখ ওএমআর আছে। এলিট প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের পরিচালক মো. আশরাফ আলী যুগান্তরকে বলেন, দরপত্রের শর্তগুলো উন্মুক্ত প্রতিযোগিতাকে নিরুৎসাহিত করবে। বাংলাদেশ মনোস্পুল পেপার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা জামাল মহিউদ্দিন বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কয়েক বছর ধরে একটি প্রতিষ্ঠানকেই কাজ দিয়ে আসছে। এবারও যে শর্ত দেওয়া হয়েছে তাতে তারাই কাজটি পাবে।
এদিকে দরপত্রে দুর্নীতি ঠেকাতে বর্তমানে সরকার ই-টেন্ডারিং প্রবর্তন করেছে। এতে দরপত্রে অংশ নেওয়া প্রত্যেকের দর দেখা যাবে। কিন্তু সফটওয়্যার এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, তা দেখা যায় না। এর পরিবর্তে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ‘দুই খাম’ পদ্ধতি চালু রেখেছে। এ পদ্ধতিতে প্রথম খামে থাকে দরদাতার নথিপত্র আর দ্বিতীয়টিতে দর। তাই প্রথম খামের শর্ত দেখেই প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত বা বাতিল করা হয়। বাতিল হলে দ্বিতীয় খামে সংরক্ষিত দর আর দেখা হয় না। ফলে বেশি দরে কাজ দেওয়ার সুযোগ থাকে। অভিযোগপত্রে এ বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্যও দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের মতো লটভিত্তিক দরপত্র দেওয়ার দাবি করেন তারা।
সোর্স : যুগান্তর