রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা গুলিস্তান। যে এলাকাকে ঘিরে ঢাকা জিপিও, বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম, বঙ্গভবন, সচিবালয়, বায়তুল মোকাররম, ওসমানী উদ্যান পার্ক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কার্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো রয়েছে। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কও এর সঙ্গে সংযুক্ত। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকায় রাজত্ব চলে হকারদের। প্রতিদিন অন্তত ৩০ হাজার ছোট-বড় অবৈধ দোকান বসে এই এলাকায়। অভিযোগ রয়েছে- স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিভিন্ন সংগঠন, সিটি করপোরেশন ও রাজউক’র অসাধু কর্মকর্তারা সড়ক ও ফুটপাথ দখল করে এসব দোকান বসিয়ে ব্যবসা করছেন। সেখান থেকে দৈনিক, কেউ মাসিক, কেউবা ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া তুলছেন। নামে-বেনামে চাঁদাবাজি করছেন তারা। সড়কের ওপর ব্যবসার লাইসেন্স দিচ্ছেন তাদের কেউ কেউ। বছরের পর বছর চলছে এই দখল বাণিজ্য।
মাঝেমধ্যে সিটি করপোরেশন উচ্ছেদ কার্যক্রম চালালেও তা কয়েক ঘণ্টাও স্থায়ী হয় না।
পর মুহূর্তেই আবার হকাররা দোকান বসায়। অনেকটা দখল-উচ্ছেদ খেলার মতো। হকারদের কারণে এই এলাকার পথচারীরা পড়ছেন বিপাকে। সরু হয়ে গেছে এখানকার ব্যস্ততম সড়কগুলো। যানবাহন আটকে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা। চুরি, ছিনতাই ও মারামারির মতো ঘটনো ঘটছে প্রায়শই। বিভিন্ন সময় একাধিক সংস্থা উচ্ছেদ অভিযান চালালেও গুলিস্তানের ফুটপাথ কিংবা রাস্তা ছাড়েনি হকাররা। সিটি করপোরেশন কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্ছেদে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। অনেক সময় উল্টো হকারদের ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে গেছেন উচ্ছেদ করতে আসা লোকজনও। গুলিস্তানে হকার উচ্ছেদ নিয়ে প্রায় চলে চোর-পুলিশ খেলা। মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, যারা উচ্ছেদে আসেন, উচ্ছেদ করেন, পরক্ষণে তারাই হকার বসিয়ে চাঁদা তোলেন। ফলে গুলিস্তান এলাকায় কোনো উচ্ছেদ অভিযানই কাজে আসছে না। গত ৭ বছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দুই শতাধিক অভিযান চালালেও দখলমুক্ত হয়নি গুলিস্তান। এছাড়া প্রতিদিনই দু’একবার চলে পুলিশি অভিযান। গুলিস্তান এলাকা নিয়ন্ত্রণকারীরা এতই শক্তিশালী যে লাগাম টানতে নিয়মিত হিমশিম খাচ্ছে সরকার। যদিও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলছে-গুলিস্তান এলাকায় কোনোভাবেই হকারদের বসতে দেয়া যাবে না। পর্যায়ক্রমে হকারদের পুনর্বাসন করা হবে।
সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে গুলিস্তানকে ‘রেড জোন’ ঘোষণা করেছে। যানজট নিরসনে ও পথচারীদের নির্বিঘ্নে চলাচল নিশ্চিত করতে ওই এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালায়। তাতেও কোনো সুফল পায়নি সিটি করপোরেশন। অতীতের মতো এবারো হকার উচ্ছেদের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফের দখল হয়ে গেছে ‘রেড জোন’ এলাকা। দ্বিতীয় দিনের মতো সিটি করপোরেশনের লোকজন ‘রেড জোন’ উচ্ছেদ চালাতে গিয়ে হকারদের বিক্ষোভের মুখে সরে যান। এমনকি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঘেরাওয়ের হুমকি দেন হকাররা। এর আগে সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন সময় গুলিস্তানকে হকারমুক্ত করতে গিয়ে হকার বিক্ষোভের মুখে পড়েন। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে গুলিস্তানে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গিয়ে হকারদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ওই সময় সিটি করপোরেশনের পক্ষে ছাত্রলীগের দুই নেতা ফাঁকা গুলিও ছুড়েছিলেন। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় গুলিস্তান। তখন উল্টো নিজ দলের নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েছিলেন সাঈদ খোকন। পরবর্তীতে তিনি গুলিস্তানকে হকারমুক্ত করার কাজ বন্ধ রাখেন। বর্তমান মেয়র দায়িত্ব গ্রহণের পর অসংখ্যবার গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চালান। এসব অভিযান চলাকালেও ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। তবুও রাস্তা দখল ছাড়ছে না হকাররা। ফলে কোনোভাবেই দখলমুক্ত হচ্ছে না ফুটপাথ ও রাস্তা। তবে হকারদের অভিযোগ, প্রতিদিনই ফুটপাথ ও রাস্তা বিক্রি হয়। রাস্তায় ও ফুটপাথে ব্যবসা করার জন্য প্রতিদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি-গ্রুপ, সংগঠন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সিটি করপোরেশনের নামে তারা চাঁদা দেন। চাঁদা তোলার জন্য সবার নির্দিষ্ট লোকজন রয়েছে। সময়মতো চাঁদা না দিলে দোকানদারদের মারধর করে উঠিয়ে দেয় তারা। সেখানে নতুন হকার বসানো হয়। এমনকি রাস্তায় দোকান বসানোর জন্য নেয়া হয় অগ্রিম টাকা।
গত এক সপ্তাহ সরজমিন দেখা যায়, গুলিস্তান ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় সকাল ১১টা থেকে রাস্তা ও ফুটপাথে হকাররা বসতে শুরু করে। তাদের কার্যক্রম চলে রাত ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত। এই সময়ে এই এলাকা জনসমাগমপূর্ণ থাকে। মাঝেমধ্যে পুলিশ এসে দোকান উচ্ছেদ করে। তার আগেই হকারদের লাইনম্যান দোকান উঠিয়ে নেয়ার বার্তা দেন। পুলিশ চলে গেলে ফের বসানো হয় দোকান। এদিকে ফুটপাথে হাঁটার জায়গা না থাকায় পথচারীরা রাস্তায় নেমে যাতায়াত করেন। এতে ক্রমেই বাড়ে মানুষের ভিড়। কমে যায় যানবাহন ও হাঁটার গতি। সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। বিশেষ করে সদরঘাটগামী যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হন। গুলিস্তানের যানজটের কারণে নির্দিষ্ট সময়ের লঞ্চে কিংবা বাসে উঠতে পারছেন না। এছাড়া হকাররা সাধারণ যাত্রীদের জিম্মি করে মালামাল বিক্রি করেন। কখনো কখনো পথচারী ও সাধারণ মানুষকে লাঞ্ছিত করেন।
রমনা মার্কেটের সামনে পোশাক বিক্রি করা সাজ্জাদ বলেন, মার্কেটে জায়গা না পেয়ে ফুটপাথে দোকান বসিয়েছি। বিকালের দিকে বিক্রি বেশি। ভালো আয় হয়। তবে লাইনম্যানদের চাঁদার কারণে শান্তি নেই। নামে বেনামে চাঁদা নেয়। পুলিশ এসে উঠিয়ে দেয়। তারা গেলে আবার নতুন করে দোকান সাজাতে হয়। প্রতিদিনই আতঙ্কে থাকি। হকার্স নেতারা বলছেন, সিটি করপোরেশন, রাজউক, ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি সমন্বয় করে হকারদের ফুটপাথ-রাস্তায় বসার সুযোগ দিয়েছে। বিনিয়য়ে তারা প্রতিদিন গুলিস্তান থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদা নিচ্ছেন। চাঁদার বড় অংশ ক্ষমতাসীন দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের পকেটে যায়। এ কারণে হকারদের পুনর্বাসন চাচ্ছে না একটি মহল। হকারদের পুনর্বাসন ও তালিকা হলে এখান থেকে মাসে হাজার কোটি টাকার চাঁদা আদায় বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণেই গুলিস্তানের রাস্তা ও ফুটপাথ দখলমুক্ত হচ্ছে না।
ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক গবেষণা বলছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৪৩০ কিলোমিটার রাস্তায় ৩ লাখের বেশি হকাররা ব্যবসা করেন। রাজধানীর ফুটপাথ ও সড়কে বছরে প্রায় ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়। এসব হকার প্রতিদিন স্থানভেদে ৫০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দেন। তবে অনেকেই বলছেন, ঢাকায় বাস্তবে হকারের সংখ্যা আরও বেশি। এছাড়া প্রতিদিন হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়।
এদিকে, হকারদের উচ্ছেদ করে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এজন্য গুলিস্তানে অত্যন্ত ১০টি মার্কেট নির্মাণ করেছে করপোরেশন। তবে একদিকে হকারদের পুনর্বাসন হলেও অন্যদিকে নতুন করে বাড়ছে হকারের সংখ্যা। যদিও সিটি করপোরেশন বলছে, করোনা মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণেই রাজধানীতে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে হকারের সংখ্যা। তবে হকার্স ফেডারেশনের নেতারা বলছেন, হকারদের পুনর্বাসনের নামে যতগুলো মার্কেট তৈরি হয়েছে। এগুলো প্রকৃত হকাররা পাননি। প্রভাবশালী ব্যক্তি নামে-বেনামে মার্কেটের দোকান বরাদ্ধ নিয়েছেন।
গত ১১ই সেপ্টেম্বর গুলিস্তানে হকারদের পাশাপাশি ফুটপাথে গড়ে তোলা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মুনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে যান চলাচল ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় জনসাধারণের চলাচল নির্বিঘ্ন করতে মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের নির্দেশনায় গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট থেকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ হয়ে সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্স এবং বঙ্গভবন ও মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারগামী ও ফ্লাইওভার থেকে গুলিস্তান চত্বর এলাকাকে ‘রেড জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে। এটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক রেড জোন হিসেবে বিবেচিত হবে। এগুলো লাল চিহ্নিত থাকবে। এখানে আর হকার বসতে দেয়া হবে না।
বাংলাদেশ হকার্স লীগ ও বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের সভাপতি এমএ কাশেম মানবজমিনকে বলেন, যতদিন পর্যন্ত হকারদের পুনর্বাসন করা না হবে, ততদিন হকাররা গুলিস্তান ছাড়বে না। ২০১৬ সালের ১৯শে এপ্রিলের একনেকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, হকারদের পুনর্বাসন করতে হবে। তাদের তালিকা করে পরিচয়পত্র দিতে হবে। ২৫০২ জন হকারের তালিকা হয়েছে। এখনো অনেক হকারের তালিকা হয়নি। হকারদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা আছে তা প্রত্যাহার করতে হবে। অন্যথায় হকাররা ফুটপাথ ও রাস্তা ছাড়বে না। তিনি বলেন, গুলিস্তানের চারপাশে অনেক ভিআইপি সড়ক আছে। এখন আর সেগুলো আমাদের হকার ও রিকশাচালকদের কারণে ভিআইপি নেই। সব দখল হয়ে গেছে এটা সত্য। কিন্তু সিটি করপোরেশন আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই রেড জোন চিহ্নিত করে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে। এতে হকাররা বিক্ষোভ করছে। ৪০ জন নামধারী চিহ্নিত চাঁদাবাজ লাইনম্যান আছে। যারা প্রতিদিন এখান থেকে চাঁদা নেন। তাদের বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এর আগে সিটি করপোরেশন উচ্ছেদকালে তারাই সিটি করপোরেশনের গাড়ি ভাঙচুর করেছে। ম্যাজিস্ট্রেটদের মাথা ফাটিয়েছে। তেমন ৪৯ জনের নামে তখন মামলা হলেও তারা এখনো প্রকাশ্যে চাঁদা তুলছেন।
সোর্স : মানব জমিন