কাওরান বাজার আম্বর শাহ্ মসজিদের সামনে সিদ্ধ ডিম বিক্রি করে সোহেল। পড়াশুনা করার পাশাপাশি সিদ্ধ ডিম বিক্রিতে বাবাকে সহযোগিতা করে সে। আগে প্রায় প্রতিদিন আসা লাগতো না। এখন নিয়মিত আসতে হয়। কারণ সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসারের খরচ সামাল দিতে বাবাকে বেশি সময় সহযোগিতা করতে হচ্ছে তাকে। সোহেল জানায়, এভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকলে আর যদি না কমে তাহলে আগামীতে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। সোহেলের বাবা মনসুর মিয়া বলেন, গত বছর লকডাউন থাকায় মাসের পর মাস ঘরে বসে থাকতে হয়েছে। তখন জমানো যে টাকা ছিল তা খরচ হয়ে গেছে। ধারদেনা করে নতুন করে পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও আগের মতো বেচা-বিক্রি হয় না। আগে দৈনিক দুই থেকে আড়াইশ’ ডিম বিক্রি হতো।
এখন একশ’ও হয় না। আর পণ্যটির দাম বেড়ে যাওয়ায় আগের চেয়ে গ্রাহক অনেক কমে গেছে। এতে দৈনিক আয়ও কমেছে। এতে বাসা ভাড়া দেয়ার পর সংসারের খরচ চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ছেলের পড়াশুনা করাতে পারবো কিনা বলতে পারছি না।
রাস্তায় শ্রমিকের কাজ করেন মুরাদ হোসেন। তার মতে, সব কিছুর খরচ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে নিত্যপণ্যের দাম। আর এখন যোগ হয়েছে যাতায়াত খরচ। ওষুধের দামও বেড়েছে। চলমান জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির আগে তার দৈনিক রোজগার ছিল ৬০০ থেকে ৫০০ টাকা। এখন তা কমে গিয়ে দিনে আয় হয় ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা। এই টাকায় সংসার খরচ বহন কঠিন হয়ে উঠেছে। ফলে বাধ্য হয়েই নিজের ৭ম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলেকে কাজে পাঠিয়েছেন মুরাদ। আমার ইচ্ছে ছিল ছেলে পড়ালেখা করুক। কিন্তু সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় শাকসবজি দিয়েই খাবার খাচ্ছেন তারা।
বাংলামোটর এলাকায় একটি রেস্তরাঁয় কাজ করেন মো. সাগর। তিনি বলেন, বাজারে কোনো কিছুই এখন কেনা যায় না। করোনার পর পড়াশুনাও বাদ। মজুরি বেড়েছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, মালিকের কাছে বাড়তি মজুরি চাইছি। কিন্তু এখনো বাড়েনি। সাগর বলেন, চার সদস্যের পরিবারে তাদের দিনে এক কেজি চাল লাগে। মূল্যবৃদ্ধির কারণে চালের দাম বাবদ তার পরিবারের মাসিক খরচ বেড়েছে ৬০০ টাকা। কিন্তু আয় বাড়ে নাই। সে জানায়, বাবা ভ্যানে ঘুরে সবজি বিক্রি করেন। কিন্তু সব দিন তো লাভ হয় না। সব নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন হওয়ায় আট বছরের বোনসহ মাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়েছেন বাবা। সাগর বলেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে খুব হিসাব করে চলি। তারপরও মাসের শেষদিকে চলতে খুব কষ্ট হয়।
উল্লেখ্য, আগস্টের প্রথম সপ্তাহে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পরপরই চড়া হয় নিত্যপণ্যের দাম। বেড়ে যায় চাল, ডাল, মাছ, মাংস, ভোজ্য তেল, সবজি, ফল, চিনি, লবণ, গম, আটা-ময়দা, ওষুধসহ সবকিছুর দাম। যাতায়াত খরচও বেড়ে যায়। এতে দিশাহারা হয়ে পড়ে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষ। আয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে জীবনযাত্রার খরচ মেটাতে না পেরে দুর্বিষহ দিন কাটছে নিম্ন আয়ের মানুষের ছেলেমেয়েদেরও। টিকে থাকতে চাহিদার চেয়ে কম কিনছেন তারা। এখন জিনিসপত্রের দাম চড়া থাকায় এসব নিম্ন আয়ের মানুষ আলু ভর্তা আর শাকসবজি দিয়ে কোনো রকম খেয়ে দিন পার করছেন।
রাজধানীর বিমানবন্দরের পাশের দক্ষিণখান এলাকায় থাকেন ছকিনা বেগম। বাসাবাড়িতে বুয়ার কাজ করেন। এ পেশায় থেকে একটি মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছেন। তিনি বলেন, স্বামী ভাড়ায়চালিত গাড়ির ড্রাইভার। গাড়ি চললে আয় হয়। না চললে আয় হয় না। বর্তমানে আয় আরও কমে গেছে। তাই বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসার চালাই। আয়ের একটা বড় অংশ যায় ঘর ভাড়া আর সন্তানদের লেখাপড়ায়। তাই ভালো খাবার দিতে পারি না। সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার পথে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ছোট ও অতি ছোট ব্যবসায়ীদের অনেকে মূলধন ভেঙে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু তার সংসারের খরচ বাড়ছে। কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, পণ্যমূল্য যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ হচ্ছে না। হঠাৎ করে একেকটি পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এটি কারসাজি। সরকারও শক্ত অবস্থান নিতে পারছে না। কিন্তু সাধারণ মানুষকে এর মূল্য দিতে হচ্ছে।
সোর্স : মানব জমিন