কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে, আশা করছি এক সপ্তাহের
মধ্যে দুই লেন চালু হলে সমস্যা থাকবে না : সফিকুল ইসলাম
দুই কোটি মানুষের বসবাসের শহর ঢাকা। যানজট ও পরিবহন নৈরাজ্য এখন নগরবাসীকে দিন দিন কাবু করে ফেলছে। রাস্তায় নামলেই যানজটে পড়ে বসে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একই স্থানে গণপরিবহনগুলোকে বসে থেকে পুড়তে হচ্ছে মূল্যবান জ্বালানি। সেই পরিস্থিতি থেকে স্বস্তি ফেরাতে নগরবাসীর সুশৃঙ্খল বসবাস ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য নানা প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। কিন্তু প্রকল্পের কাজে দীর্ঘসূত্রিতা নানা অনিয়মের কারণে কিছু কিছু প্রকল্প হয়ে উঠে জনসাধারণের জন্য ভোগান্তির কারণ। বিমানবন্দর-গাজীপুর রুটের প্রকল্পের কাজের কারণে মাত্র একটি লেনে গাড়ি চলাচল করে। রাস্তার ফুটপাথের পাশের অংশে খানাখন্দ হয়ে পড়ে আছে। এসব খানাখন্দে পানি জমে দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। পথচারী ও যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। দীর্ঘদিন ধরে এই অবস্থায় পড়ে থাকলেও প্রকল্প ও সড়ক ও জনপথের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নজর নেই সেদিকে।
যানজট সমস্যা নিরসন ও যানবাহন ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে সরকার হাতে নেয় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প। কিন্তু এ প্রকল্পের কারণে যানজট লেগে থাকছে নিত্যদিন। প্রতিদিনের ভোগান্তির এ যানজট স্থায়ী রূপ নিতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্থায়ী যানজট শুরু হয়ে গেছে প্রতিদিন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন করলেও কোন সুফল পাওয়া যাবে না।
জানতে চাইলে ঢাকা বিআরটি লিমিটেড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, বিমানবন্দর-গাজীপুর সড়কের টঙ্গী অংশের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। আশা করছি এক সপ্তাহের মধ্যে দুই লেন চালু করতে পারবো। দুইলেন চালু করা হলে যানজটের সমস্যা আশা করি থাকবে না। সহজেই যানবাহনগুলো চলাচল করতে পারবে।
তবে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী এ,কে,এম, মনির হোসেন পাঠান প্রকল্পের সওজ অংশের পরিচালক এ এস এম ইলিয়াস শাহ-এর সাথে কথা বলতে বলেন। প্রকল্পের সওজ অংশের পরিচালক এ এস এম ইলিয়াস শাহকে মোবাইল ফোনে কল করা হলে তিনি প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রকল্প পরিচালক মহিরুল ইসলাম খানের সাথে কথা বলতে বলেন। কিন্তু মহিরুল ইসলাম খানের মোবাইল ফোনে কল করলে তিনি রিসিভ করেননি।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের হিসাবে ঢাকা-মনমনসিংহ মহাসড়কে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করে। গাজীপুর দেশের অন্যতম শিল্পাঞ্চল হওয়ায় এখানে চলাচলকারী যানবাহনের একটি বড় অংশ হলো পণ্যবাহী ভারী যান। গাজীপুরের সাথে রয়েছে আরেকি শল্প এলাকা নারায়ণগঞ্জের সাথে বাইপাস সড়ক যোগাযোগ। এই রুটে নিয়মিত ভারী শিল্প কারখানার পণ্য আনা নেয়া করা হয়। শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, সিলেট, রংপুর ও রাজশাহীসহ উত্তর অঞ্চলের মানুষ ঢাকায় আসার ক্ষেত্রেও মহাসড়কটি ব্যবহার করে। অতিরিক্ত গাড়ির চাপে এমনিতেই দিন-রাতের একটা বড় সময় বিমানবন্দর-গাজীপুর অংশে যানজট লেগে থাকে। বিআরটির নির্মাণকাজ এ যানজটকে আরো প্রকট করে তুলেছে। স্টেশনের নকশাগত দুর্বলতার কারণে বিআরটির কাজ শেষ হওয়ার পরেও এ যানজট থেকে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিআরটি সূত্রে জানা যায়, রিভাইজড স্ট্র্যাট্যাজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান ২০১৬ অনুযায়ী ঢাকা শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে ২০৩৫ সাল নাগাদ ২টি বাস র্যাপিড ট্রানজিট লাইন এবং ৫টি মাস র্যাপিড ট্রানজিট লাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ফরাসী উন্নয়ন সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে বর্তমানে বিআরটি লাইন ৩-এর উত্তর অংশের গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। নির্মাণাধীন বিআরটি লাইন ৩-এর উত্তর অংশের দৈর্ঘ্য হবে ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এয়ারপোর্ট থেকে শিববাড়ি গাজীপুর টার্মিনাল পর্যন্ত এ লাইনে ২৫টি বিআরটি স্টেশন থাকবে এবং এ লাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় চার লাখ যাত্রী যাতায়াত করবে।
সুষ্ঠু ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত করিডোরের ৬টি ইন্টারসেকশনে গ্রেড সেপারেশনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে এবং এজন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগের তত্ত¡াবধায়নে ৬টি ফ্লাইওভার নির্মাণাধীন রয়েছে। বিমানবন্দর ইন্টারসেকশনে উত্তর ও দক্ষিণগামী যানবাহনের চলাচল নির্বিঘœ করতে রাস্তার উভয় পাশে ২টি পৃথক ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ দ্রæতগতিতে এগিয়ে চলছে। ৬ লেনের জসিমউদ্দিন ফ্লাইওভার নির্মাণাধীন রয়েছে, যার মধ্যের ২টি বিআরটি এর জন্য নির্ধারিত। বিআরটি সিস্টেম চালু করার মাধ্যমে উত্তরা ও গাজীপুর শহর এলাকায় এবং এ করিডোরের উভয় পাশের আবাসিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট এক নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে প্রকল্পে বলা হয়।
কিন্তু এই বিআরটি প্রকল্পটি এখন দুর্ভোগের প্রকল্প হিসেবে স্থান পেয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। বছরের পর বছর বিমানবন্দর-গাজীপুর সড়কে যাতায়াতকারী মানুষের করতে হচ্ছে সীমাহীন কষ্ট। ১০ মিনিটের যাতায়াতের পথ যেতে হচ্ছে দেড় থেকে দুই ঘণ্টায়। এই প্রকল্পে শুধু লোকজনের দুর্ভোগেই সীমাবদ্ধ নয়। অনিয়ম ও অসাবধানতার কারণে প্রাণ দিতে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের। ইতোমধ্যে বিআরটি স্টেশনের নকশাগত দুর্বলতার বিষয়টি উঠে এসেছে। একারণে ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কে যানজট স্থায়ী রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বিআরটি প্রকল্পের কাজে সিস্টেমে দুর্বলতা, প্রকল্পের কাজের কারণে রাস্তা খানাখন্দক থাকা, এই প্রকল্পের কাজ দীর্ঘদিন চলতে থাকার করণে এই সড়কের যানজট স্থায়ী রূপ নিতে পারে। এছাড়াও প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও যানজটের সম্মুখীন হতে হবে যাত্রীদের। কারণ এই প্রকল্পের কাজের রাস্তার মাঝখানেই নির্মান করা হয়েছে বাস বে। যেখানে বাস থামবে, লোকজন বাসে উঠবে এবং নামবে। বাস বে নির্মাণ করার কারণে মূল সড়কের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ পরিবহন চলাচল করতে পারবে না।
বিআরটি রুট-সংলগ্ন সড়কে সাধারণ যানবাহন চলার জন্য সাত মিটার জায়গা থাকলেও স্টেশন এলাকায় তা কমে দাঁড়াবে ছয় মিটারে। নির্মাণাধীন বিআরটি করিডোরের ১৬ কিলোমিটার মাটির সমান্তরাল (অ্যাটগ্রেড) অংশে স্টেশন রয়েছে ১৯টি। চলতে গিয়ে এর প্রায় প্রত্যেকটিতেই বাধাপ্রাপ্ত হবে সাধারণ যানবাহন। এরই মধ্যে বিআরটির স্টেশনগুলো দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। স্টেশন এলাকায় সাধারণ যানবাহন চলার পথ সরু হয়ে যাওয়ায় দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে যানজটও। ঢাকা-ময়মনসিংহ জাতীয় মহাসড়কে যানজট স্থায়ী রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
টঙ্গী এলাকার বাসিন্দা আরিফ মিয়া ইনকিলাবকে বলেন, বিমানবন্দর-গাজীপুর মহাসড়কটি এখন যাত্রীদের জন্য ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খানাখন্দ, প্রকল্পের কাজের জিনিসপত্র রাস্তায় রাখার কারণে এই সড়কটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও অযোগ্য হয়ে পরেছে। বছরের পর বছর চলতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এই সড়কে প্রতিদিন যানজট লেগেই থাকছে।
সেভ দ্য রোড-এর মহাসচিব শান্তা ফারজানা ইনকিলাবকে বলেন, বিআরটি প্রকল্পটি দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর সড়কে এই প্রকল্পের কারণে যানজট স্থায়ী হতে পারে। প্রকল্পের আগে যাত্রীদের দিক বিবেচনায় আনতে হবে। যা এই প্রকর্পে লক্ষ করা হয়নি। ঠিকাদারদের গ্রহণযোগ্য কর্মপরিকল্পনা তৈরির মতো দক্ষ জনবল, সরঞ্জাম, অর্থ, প্রয়োজনীয় উপকরণ কিছুই নেই। এ কারণে মিল ছিলো না তাদের কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবেরও। গত ১০ বছর ৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার এলাকায় জমেছে ইকুইপমেন্ট জঞ্জাল। এই জঞ্জাল অপরিকল্পিত-অব্যবস্থাপনার মধ্যে মানুষকে যেমন কষ্ট দিয়েছে, তেমন কেড়ে নিয়েছে সময় এবং অর্থ।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল হক ইনকিলাবকে বলেন, কন্ট্রাকশন এমন একটি শিল্প যেখানে টাকা দেয়া হয় তবুও এমন একটি জনবহুল জায়গায় এভাবে কাজ হচ্ছে এটা কাম্য নয়। এতে নিরিহ মানুষ শিকার হচ্ছে। এই প্রকল্প করার আগে বিআরটির দর্শন অনুসরণ করা হয়নি। এসব কারণেই এখন আমাদের উন্নয়ন যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ব্যবস্থা নিতে হবে। বিআরটি করার জন্য যে পরিমাণ রাইট অফ ওয়ে প্রয়োজন, ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কে তা নেই। যদি প্রয়োজনীয় রাইট অফ না থাকে, তাহলে জমি অধিগ্রহণ করে এটা পর্যাপ্ত করতে হয়। রাস্তার সক্ষমতা বাড়ানোর বদলে স্টেশন এলাকাগুলোয় আরো সংকীর্ণ করে ফেলা হয়েছে। ফুটপাথও সরু করা হয়েছে।
সোর্স : ইনকিলাব