আসিফ আরসালান:
এর আগে একবার ভারত থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, ‘আমি কিছু নেয়ায় বিশ্বাস করি না। আমি দেওয়ায় বিশ্বাস করি। ভারতকে আমি যা দিয়েছি সেটি ভারত চিরদিন মনে রাখবে। আমার কারণেই উত্তর পূর্ব ভারতের অধিবাসীরা আজ শান্তিতে ঘুমাতে পারে।’ শেখ হাসিনা যেটা বলেছেন সেটা তার ব্যক্তিগত উদারতা হতে পারে। ব্যক্তি জীবনে এই ধরনের উদারতা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু রাষ্ট্রীয় জীবনে এই ধরনের উদারতার কোনো স্থান নাই। রাষ্ট্রীয় জীবনে এক দেশের সাথে আরেক দেশের সম্পর্ক নির্ভর করে দেওয়া নেয়ার ওপর। আপনি কতটা দিলে অন্য রাষ্ট্র আপনাকে কতটা দেবে এবং সেই দেওয়াটা আপনার দেশের জন্য কতখানি উপকারী হবে তার ওপর নির্ভর করবে সেই দেওয়া নেওয়া। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি কথা যথার্থই বলেছেন। সেটা হলো, তিনি ভারতকে যা দিয়েছেন সেটি ভারত চিরদিন মনে রাখবে।
শেখ হাসিনার বিগত ১৪ বছরের শাসনামলে ভারতকে সবকিছু উজাড় করে দেওয়া হয়েছে। তবে ভারতকে সবচেয়ে বড় যে দুটি জিনিস দেওয়া হয়েছে সেই দুটি হলো (১) উত্তর পূর্ব ভারতের স্বাধীনতাকামী সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে কঠোরভাবে দমনে ভারতকে সক্রিয় সহযোগিতা প্রদান এবং (২) স্থল, নৌ ও রেল পথে ভারতকে ট্রানজিটের নামে করিডোর প্রদান। এগুলো ভারতকে একদিকে যেমন ভৌগোলিক অখন্ডতার নিশ্চয়তা দিয়েছে, অর্থাৎ ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, অন্যদিকে ভারতের এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের দূরত্ব কম করে হলেও দুই তৃতীয়াংশ কমিয়েছে। একই সাথে পণ্য পরিবহনের খরচও সেই অনুপাতে কমিয়েছে। এছাড়াও মোংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। এই ট্রানজিটের তথা করিডোরের জন্য ভারত সেই পাকিস্তান আমলে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে আবেদন করেছিল। তারপর থেকে বিগত ৬০ বছর সেই আবেদন করেই যাচ্ছে। কিন্তু, না পাকিস্তান সরকার, না বাংলাদেশের প্রথম ৩৫ বছরের সরকারসমূহ ভারতের সেই আবেদনে সাড়া দিয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর সেই ট্রানজিটও দিয়েছেন এবং উত্তর পূর্ব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম দমনেও সাহায্য করেছেন। এসব দেওয়ার পর বাংলাদেশের কাছে ভারতের নতুন করে চাওয়ার আর কিছু থাকে না। তবে এর বিনিময়ে ভারতের নিকট থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু চাওয়ার আছে। আমরা আজকে প্রধানমন্ত্রীর বিগত ভারত সফর এবং সেই সফর শেষে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে যাচ্ছি না। আমরা ভেবেছিলাম বাংলাদেশের নিকট থেকে ভারতের আর চাওয়ার কিছুই নাই। অনেকে ঠাট্টা করে বলেন যে ভারত যদি বাংলাদেশের নিকট থেকে কোনো কিছু চাওয়ার সিদ্ধান্ত করে তাহলে তাকে একদল গবেষক নিয়োগ করতে হবে। তারা গবেষণা করে বের করবেন যে বাংলাদেশের নিকট থেকে ভারত আর কি কি চাইতে পারে।
আসলে ঐ চিন্তাধারা ভুল ছিল। দেখা গেল, প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরেও ভারত একটি বড় জিনিস চেয়েছে, যদিও তারা তিস্তার পানি নিয়ে কোনো কথা বলেনি এবং সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যায় বিগত ১২/১৩ বছরের আশ্বাসের পুনরাবৃত্তি করেছে। যৌথ বিবৃতি থেকে জানা গেল যে এইবার ভারত বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে আরেকটি নতুন করিডোর চেয়েছে। এটি স্থল ট্রানজিট এবং রেল ট্রানজিট উভয় কাজ করবে। ভারত প্রস্তাব করেছে যে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত থেকে ভারতের মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ পর্যন্ত একটি নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হোক। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুরে হিলি একটি সীমান্ত সংলগ্ন গ্রাম। অনুরূপভাবে বাংলাদেশেও হিলি রয়েছে, তবে সেটি সীমান্তবর্তী একটি রেল স্টেশন। এটি পড়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, ভারত আর কত চায়? ভারতের প্রস্তাবিত এই মহাসড়কটি নির্মিত হলে যমুনা নদীর ওপর আরো একটি সেতু বানাতে হবে। কৌশলগতভাবে এই মহাসড়ক ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
॥ দুই ॥
দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর জারিকৃত যৌথ ইশতেহারের ১৯ নং অনুচ্ছেদে এই মহাসড়কের প্রস্তাব উল্লেখিত হয়েছে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ ভারত, মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হবে। এই প্রস্তাব সম্পর্কে এখন পর্যন্ত বিস্তারিত কিছুই বলা হয়নি। এটি কি মহাসড়কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? নাকি এটি রেল সুবিধাসহ বহুমুখী সুবিধা সম্পন্ন হবে? খবরে প্রকাশ, ২০১৯ সালে শেখ হাসিনা যখন ভারত সফর করেন তখন এই প্রস্তাবটি সামনে আনা হয়নি। কিন্তু ২০২১ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন বাংলাদেশে আসেন তখন মৌখিকভাবে বাংলাদেশকে এই প্রস্তাবের কথা বলে।
এখানে একটি কথা বলা দরকার। ভারত তো এতদিন ধরে যতটুকুই ট্রানজিট এবং ট্রান্সশিপমেন্টের মালামাল পরিবহন করেছে সেটি চূড়ান্ত পরিণামে শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেক নামে পরিচিত সংক্ষিপ্ত ভূখন্ডের ওপর দিয়ে পরিবহন করেছে। কিন্তু এই চিকেন নেক সামরিক কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষ করে এটি চীনের নাগালের মধ্যে। যদি কোনো সময় ভারত এবং চীনের মধ্যে বিরাজমান বৈরী সম্পর্ক সশস্ত্র সংঘর্ষে রূপ নেয় এবং সেক্ষেত্রে চীন যদি চিকেন নেক দখল করে নেয় তাহলে ভারতের পূর্বাঞ্চল অবশিষ্ট ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব্।ে সুতরাং ভারতের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন শিলিগুড়ি করিডোর বা চিকেন নেকের বিকল্প রাস্তা খুঁজে বের করা। আর সেখানেই আসে হিলি মহেন্দ্রগঞ্জ ভায়া বাংলাদেশ প্রস্তাবিত মহাসড়ক। এখানে আমরা দৈনিক সংগ্রামের সম্মানিত পাঠক ভাইদের জন্য ট্রানজিট বা করিডোর ভারতীয়দেরকে কত বিশাল সুবিধা দিয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করছি।
ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ৬৮০ কি.মি.। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আগরতলার দূরত্ব মাত্র ২৪৮ কি.মি.। মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ১৫০ কি.মি.। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এই দূরত্ব মাত্র ৫৭০ কি.মি.। মিজোরামের রাজধানী আইজল থেকে কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ৫৫০ কি.মি.। কিন্তু আইজল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব মাত্র ৬৫৫ কি.মি.। নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমার সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব ১ হাজার ৪৫০ কি.মি.। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দূরত্ব ৮৮০ কি.মি.। কলকাতা থেকে অন্যান্য রাজ্যের দূরত্বও গড়ে ৩ গুণের বেশি। এতদিন ধরে কলকাতা বন্দর থেকে ফিডার জাহাজে করে ভারতকে অন্যান্য রাজ্যে পণ্য পরিবহন করতে হতো। এর ফলে ভারতের সময় এবং অর্থ অনেক বেশি ব্যয় হতো। ট্রানজিট বা করিডোর দেওয়ার ফলে এই সময় এবং অর্থ দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি কমে যায়।
ট্রানজিট দেওয়ার বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতের নিকট থেকে কি পরিমাণ মাশুল পাবে সেটি জনসাধারণকে জানানো হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান তো একবার বলেই ফেলেছিলেন যে ট্রানজিটের বিনিময়ে মাশুল চাওয়াটা নাকি বাংলাদেশের জন্য ‘অভদ্রতা’ হবে। উপদেষ্টার এই চরম প্রো-ইন্ডিয়ান বক্তব্যের প্রতিবাদে চারিদিকে হৈচৈ শুরু হলে উপদেষ্টা মশিউর রহমান খামোশ হয়ে যান। যাই হোক, ট্রানজিট বা করিডোর সম্পর্কে ট্যারিফ কমিশনে একটি কোর কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি বিভিন্ন রুটে ট্রানজিট বা করিডোর বাবদ একটি মাশুল বা ভাড়ার চার্ট তৈরি করেছেন। এই চার্ট এখনও অবশ্য উভয় দেশের চূড়ান্ত অনুমোদন পায়নি। ট্রানজিট বাস্তবায়িত হলে কোন রুটে ভারতের কত সাশ্রয় হবে সে সম্পর্কে একটি চার্ট করা হয়েছে। সেই চার্ট অনুযায়ী ভারতের সাশ্রয়ের পরিমাণ নিম্নরূপ:
তামাবিল-চট্টগ্রাম রুটে ১২ শতাংশ, আখাউড়া-চট্টগ্রাম রুটে ৭০ শতাংশ, আখাউড়া-বেনাপোল রুটে ৪৮ শতাশং, তারাকান্দি-বেনাপোল রুটে ৩৩ শতাংশ, সুতারকান্দি-চট্টগ্রাম রুটে ৫৩ শতাংশ, বাংলাবান্ধা-মোংলা রুটে ২৯ শতাংশ, বুড়িমারি-মোংলা রুটে ১২ শতাংশ, শাহবাজপুর-চট্টগ্রাম রুটে ৬৭ শতাংশ, আখাউড়া-দর্শনা রুটে ৭০ শতাংশ, রায়মঙ্গল-আশুগঞ্জ রুটে ৫০ শতাংশ এবং শাহবাজপুর-দর্শনা রুটে সাশ্রয় হবে ৫৭ শতাংশ।
প্রিয় পাঠক, এ সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য রয়েছে আমার কাছে। কিন্তু সে সম্পর্কে এই কলামে আরো কিছু বললে তথ্য ও পরিসংখ্যানে এই লেখাটি ভারাক্রান্ত হয়ে যাবে। তাই আজ এ সম্পর্কে আর কিছু বলছি না। আজ হিলি-মেহেন্দিগঞ্জ প্রস্তাবিত রুট সম্পর্কে ভারতের বিদায়ী হাইকমিশনার বিক্রম দোরাই স্বামীর মতামত উল্লেখ করে আজকের কলাম শেষ করছি। বিক্রম দোরাই স্বামী বলেন, ‘এটি একটি উপ-আঞ্চলিক সংযুক্তির ধারণা, যেখানে ভারত, বাংলাদেশ, উত্তর পূর্ব ভারত এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সাথে সংযুক্তি সাধিত হবে। এটি একটি উচ্চাভিলাসী কিন্তু অত্যন্ত মঙ্গলজনক প্রকল্প। সড়কের সংখ্যা খুব সীমিত।’ তারপরেই আসল কথাটি বলে ফেলেছেন দোরাই স্বামী। বলেছেন, ‘বর্তমানে উত্তর ভারত থেকে উত্তর পূর্ব ভারতে যে সড়কের মাধ্যমে যাতায়াত বা পণ্য পরিবহন করা যায় সেটি শিলিগুড়ি করিডোর হয়ে করতে হয়। এর বিকল্প খোঁজার পথ হিসাবে আমরা ভারত, বাংলাদেশ, উত্তর পূর্ব ভারত এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সংযোগের কথা বলছি। এজন্যই এই নতুন সড়ক নির্মাণ নিয়ে কথা বলতে চাই। এই সড়ক হিলি-মহেন্দ্রগঞ্জ ছাড়াও চট্টগ্রাম থেকে ত্রিপুরা হয়ে মৈত্রী সেতুর মাধ্যমে সংযোগ হতে পারে। হতে পারে কুমিল্লা থেকে চার লেনের মাধ্যমে আশুগঞ্জ হয়ে আগরতলা। এখন পর্যন্ত আমরা একটি সমীক্ষা রিপোর্টের কথা বলেছি। এই রিপোর্টে যমুনা নদীর ওপর ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সেতুর কথা বলা হয়েছে। তবে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন হবে বিপুল অর্থ।’
প্রিয় পাঠক, এ সম্পর্কে আজ আর নতুন করে কিছু বলতে চাই না। শুধু এইটুকু বলতে চাই যে লুডু খেলার বোর্ডটির ওপর সর্বত্র যেমন সাপ লিকলিক করে, ভারতও তেমনি বাংলাদেশের ওপর একটি দুটি নয়, সাপলুডু বোর্ডের মত অসংখ্য ট্রানজিট বা করিডোর বিস্তার করতে চায়। একটি সময় ছিল যখন মানুষ ভারতকে করিডোর দিতে চায়নি। আমি আবার বলছি, আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে যা দিয়েছে সেটি ট্রানজিট নয়, করিডোর। পৃথিবীতে ট্রানজিটের বহু উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু করিডোরের উদাহরণ নাই।
করিডোর হলো সেটি যেখানে এক দেশের এক স্থান থেকে সেই একই দেশের অন্য স্থানে যাওয়া যায়, মাঝখানে অপর একটি দেশের ভেতর দিয়ে। আর ট্রানজিট হলো, এক দেশ থেকে সরাসরি অন্য দেশে যাওয়া। বাংলাদেশ ভারতকে করিডোর দিয়েছে। এরপর ভারত একের পর এক যে নিত্য নতুন নৌ, স্থল ও রেল ট্রানজিটের (করিডোর) আবদার করছে সেগুলো মেটাতে গেলে তৃতীয় কোনো দেশের চোখ রাঙ্গানি সহ্য করতে হয় কিনা সেটি বিবেচনা করা দরকার। এছাড়া আমরা অর্থাৎ বাংলাদেশ কিছুই না পেয়ে ভারতকে সবকিছুই দিচ্ছি, এটিই বা কেমন পররাষ্ট্রনীতি?
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম