থেমে থেমে গুলির শব্দ। মাঝে মাঝে গুলি, মর্টারশেল এসে পড়ছে সীমান্ত লাগোয়া বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। এতে আতঙ্ক পুরো সীমান্ত এলাকায়। মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিবদমান সংঘর্ষ বাড়ায় দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী আগ্রাসী অভিযান চালাচ্ছে। এর রেশ এবং উত্তেজনা বাংলাদেশ সীমান্তে। বার বার প্রতিবাদ করার পরও মিয়ানমারের সীমান্ত আইন লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বিগ্ন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আরও কঠিন ভাষায় মিয়ানমারকে বার্তা দিতে হবে। ওদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না। তবে প্রয়োজন হলে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘে যাবে। মিয়ানমারে টানা সংঘর্ষের ঘটনায় সীমান্তে বসবাসকারী নাগরিকদের মধ্যে প্রতিনিয়তই বাড়ছে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা।
ইতিমধ্যে একই দিনে দু’দফা হামলায় একজন নিহত হওয়ার পাশাপাশি অন্তত আরও ৬ জন আহত হয়েছেন। এরই মধ্যে আরও হামলার আশঙ্কায় একটি এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র সরিয়ে কক্সবাজার জেলাধীন কুতুপালংয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গত ২৮শে আগস্ট মিয়ানমার থেকে ছোড়া দুটি মর্টারশেল বাংলাদেশের বান্দরবান উপজেলার নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে এসে পড়ে।
ওই দিন দুপুর ৩টার দিকে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের নো-ম্যান্সল্যান্ডের কাছে পর পর মর্টারশেলগুলো এসে পড়ে। তবে সেগুলো বিস্ফোরিত হয়নি। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ৩রা সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় বাংলাদেশ সীমান্তে গোলা ছুড়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তাদের যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া ২টি গোলা এসে পড়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। পরে ৫ই সেপ্টেম্বর দ্বিতীয়বারের মতো আরও একটি মর্টারশেলের গোলা এসে পড়ে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের রেজু আমতলী বিজিবি বিওপি আওতাধীন সীমান্ত পিলার ৪০-৪১ এর মাঝামাঝি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ৬ই সেপ্টেম্বর সকাল ৭টা থেকে থেমে থেমে ভারী অস্ত্রের বিকট শব্দ ভেসে আসছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তে। এ ছাড়াও রেজু আমতলীর সীমান্ত পিলার এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দুটি যুদ্ধবিমান থেকে ৮-১০টি গোলা নিক্ষেপ করা হয়। দুটি ফাইটিং হেলিকপ্টার থেকে ৩০-৩৫টি গুলি ছোড়া হয়।
১ নম্বর ওয়ার্ডের তুমব্রু বিজিবি বিওপি’র সীমান্ত পিলার ৩৪ থেকে ৩৫-এর মাঝামাঝি থেকে ভারী অস্ত্রের ৪ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়। এসব ঘটনায় সীমান্তবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ৯ই সেপ্টেম্বর রাতে মিয়ানমারে সংঘর্ষ চলাকালে ছোড়া একটি গুলি পাওয়া যায় তুমব্রু সীমান্তের ঘোনারপাড়া এলাকায়। শুক্রবার বিকালে হঠাৎ করে মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে ব্যাপক গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পান স্থানীয়রা। এ সময় সবাই ভয়ে ঘরের ভেতরে আশ্রয় নেন। পরে গোলাগুলির আওয়াজ থেমে গেলে ঘোনারপাড়া এলাকায় একটি গুলি পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয়রা। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানালে ৩৪ বিজিবি’র একটি দল ঘটনাস্থলে গিয়ে গুলিটি উদ্ধার করে। এর পর থেকে ওই এলাকার বাসিন্দাদের মাঝে নতুন করে আবার আতঙ্ক বিরাজ করছে। জানা গেছে, তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সেদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির ব্যাপক সংঘর্ষ চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় নাইক্ষ্যংছড়ির তুমরু কোনারপাড়া সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ছোড়া চারটি মর্টারশেল এসে পড়ে। এতে শূন্যরেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইকবাল নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন।
আহত হয়েছেন রোহিঙ্গা শিশুসহ চার জন। শুক্রবার রাত ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। আহতরা হলেন- জাহিদ আলম (৩০), নবী হুসাইন (২১), মো. আনাস (১৫) ও সাহদিয়া (৮)। তুমব্রু রোহিঙ্গা ক্যাম্প কমিটির চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অপর রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ আরিফ জানান, আহতদের মধ্যে চার জনকে উদ্ধার করে কুতুপালংস্থ এমএসএফ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। একইদিনে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী-বিজিপি’র পুঁতে রাখা ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণে এক বাংলাদেশি নাগরিক আহত হয়েছেন। শুক্রবার দুপুরে তুমব্রু হেডম্যান পাড়ার ৩৫ নং পিলারের ৩০০ মিটার মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে এ ঘটনা ঘটে। আহত অন্নথাইং তঞ্চঙ্গ্যা ঘুমধুম ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের তুমব্রু হেডম্যান পাড়ার বাসিন্দা। পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, শুক্রবার দুপুরে বাংলাদেশি ওই যুবক তুমব্রু সীমান্ত এলাকায় ৩৫ নং পিলারের কাছাকাছি কাঁটাতার পেরিয়ে মিয়ানমারের সীমান্তের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে মাইন বিস্ফোরণে অন্নথাইং তঞ্চঙ্গ্যার বাম পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ পা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পরে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে প্রথমে কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়।
ওই এলাকার এসএসসি পরীক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অনুষ্ঠিতব্য এসএসসি পরীক্ষার হল পরিবর্তন করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান হোসাইন সজীব। তিনি বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম সীমান্ত পরিস্থিতির কারণে এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র উখিয়া কুতুপালং কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।’ পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত আগামীকাল ১৭/০৯/২০২২ থেকে কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস বলেন, আমরা বিষয়গুলো প্রতিনিয়তই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করছি। বিষয়টি নিশ্চিত করে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, সীমান্তের কয়েকদিনের টানা উত্তেজনার কারণে বিভিন্ন উন্নয়নকাজ বন্ধ রয়েছে, শ্রমিকরা কাজে যাচ্ছে না। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের গোলাগুলি হলেও আতঙ্কও বিরাজ করছে এ পাড়ের মানুষের মধ্যে।
বিশেষ করে তুমব্রু এলাকায় মিয়ানমারের নিক্ষিপ্ত গোলা পড়া ও যুদ্ধবিমানের মহড়ার কারণে সীমান্তে কর্মরত শ্রমিকরা এখন কাজ বন্ধ রেখে নিরাপদ স্থানে সরে রয়েছে। চলমান অবস্থায় ইউনিয়নবাসীকে সাবধানে ও নিরাপদ স্থানে থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরিজি গতকাল সকালে বলেছেন, ‘সরকার মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে কঠোর অবস্থানে আছে। সরকার এই মুহূর্তে জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।’ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে উদ্বেগের বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমরা জনপ্রতিনিধি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এলার্ট করেছি। একই সঙ্গে জনগণকে নিরাপদে থাকার নির্দেশনা দিতেও তাদের জানানো হয়েছে। এখন আমরা জরুরি সভা আহ্বান করছি। সবাই মিলে বসে সিদ্ধান্ত নেব সীমান্তের মানুষকে আরও কীভাবে নিরাপদে রাখা যায় সেই বিষয়ে।
যুদ্ধ চাই না, প্রয়োজনে জাতিসংঘে যাবো: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ যুদ্ধে জড়াবে না, বরং শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কাজ করছে। আমরা মনে করি, তারা তাদের ভুল বুঝতে পারবে, তারা সংযত থাকবে। স্পষ্ট কথা, আমরা যুদ্ধ চাই না, আমরা এটার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে। আমরা সেই চেষ্টাই করছি। তবে কাজ না হলে প্রয়োজনে জাতিসংঘকে জানানো হবে। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডিতে আহছানিয়া মিশনের এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। মিয়ানমারে সংঘাতে গত কিছুদিন ধরে গোলা আসার ধারাবাহিকতায় শুক্রবার একজনের মৃত্যুর পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র দল আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর সংঘাত চলছে।
সেই সংঘাতের গোলা বাংলাদেশে এসে পড়ছে। গত ২৮শে আগস্ট দুপুরে বান্দরবানের ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তে মিয়ানমার থেকে দু’টি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল এসে পড়ার পর ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। তারপর আরেক দফায়ও তাকে ডেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সীমান্ত পার হয়ে রোহিঙ্গারা যেন বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে সেজন্য সতর্ক রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্ট গার্ড। তারা সীমান্তে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে। এরপরও যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশ ঢোকার চেষ্টা করছে তাদের ‘পুশব্যাক’ করে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, শুক্রবার একটি রোহিঙ্গা পরিবার মিয়ানমার সীমান্তের পাশে জিরো লাইনে অবস্থান করছিল। জিরো লাইন বলতে মিয়ানমারের সীমানা ও বাংলাদেশের সীমানার মাঝখানে যে লাইন থাকে সেটাকে বোঝানো হচ্ছে। সেই ক্যাম্পে গোলাবারুদের আঘাতে একজন নিহত হয়েছে এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
সরকারের নতজানু কূটনীতির সুযোগে মিয়ানমার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করছে: বিএনপি
বান্দরবান সীমান্তে মিয়ানমার বাহিনীর ছোড়া মর্টারশেলের আঘাতে একজন নিহত এবং কয়েকজন আহতের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপি। পাশাপাশি এ ঘটনায় জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করেছে দলটি। শনিবার বিকালে নয়াপল্টনে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম এসব কথা বলেন। মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের নতজানু ও দুর্বল কূটনীতির সুযোগে গত ২৮শে আগস্ট শুরু হওয়া মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ বেড়েই চলেছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ হলো শুক্রবার মিয়ানমার বাহিনীর ছোড়া মর্টারশেলের আঘাতে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রু সীমান্তের বিপরীতে শূন্যরেখায় রোহিঙ্গা কিশোরের মৃত্যু। এতে এক শিশুসহ পাঁচজন আহত হয়েছেন। সীমান্তে মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনীর বেপরোয়া তৎপরতা ও সর্বশেষ নিক্ষিপ্ত মর্টারশেলের আঘাতে বাংলাদেশ সীমান্তের শূন্যরেখার কাছাকাছি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করে বিএনপি।
ফখরুল ইসলাম বলেন, সমপ্রতি মিয়ানমার সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গোলা নিক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় এক গভীর আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ সীমান্তে মর্টারশেল ছোড়ার এক সপ্তাহের মাথায় গত ৩রা সেপ্টেম্বর মিয়ানমার বাহিনী বারংবার আকাশসীমা লঙ্ঘন করে যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার থেকে গোলা নিক্ষেপ করে। এই গোলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের শূন্যরেখার কাছাকাছি বাংলাদেশ ভূখণ্ডের ১২০ মিটারের ভেতরে পড়ে বিস্ফোরিত হয়, যা সরাসরি আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন। বিএনপি মহাসচিব বলেন, ২০১৭ সালের ২৫ ও ২৬শে আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও পুলিশের গণহত্যার মুখে প্রাণ বাঁচাতে আট লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এমনিতেই ১২ লাখ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ মহাসংকটে রয়েছে। তার উপর এখন নতুন করে সীমান্ত সমস্যা সৃষ্টি করছে মিয়ানমার বাহিনী।
আর এটা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান ফ্যাসিবাদী শাসক শেখ হাসিনার নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ফলে। মির্জা ফখরুল বলেন, একদিকে বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত হত্যা অব্যাহত রয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময়েও সীমান্ত হত্যা সংঘটিত হয়েছে। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার্থে মেরুদণ্ড সোজা করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারকে আহ্বান জানান মির্জা ফখরুল। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম, আমান উল্লাহ আমান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন প্রমুখ।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি উদ্বেগের: জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি উদ্বেগের সৃষ্টি করছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি লুইস গুয়েন। গতকাল গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি এ মন্তব্য করেন। বলেন, বাংলাদেশের সীমান্ত পরিস্থিতি রাখাইন থেকে উদ্বিগ্নের। জাতিসংঘ প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করছে, মিয়ানমারের মিশনের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, সত্যি বলতে কী পুরো ঘটনা স্পষ্ট নয়। যদিও ঘটনাস্থলে দেখবার অনুমতি নেই। তাই উভয় দেশকে শান্তি বজায় রাখতে অনুরোধ আমার।
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ সরকার: জিএম কাদের
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, কূটনৈতিকভাবে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। অকারণে নিরীহ রোহিঙ্গা শিবিরে মিয়ানমার সেনাদের গোলাবর্ষণের ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের ওপর এই হামলা ক্ষমার অযোগ্য। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্ব সমপ্রদায়ের কার্যকর উদ্যোগ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের তেমন কোনো সাফল্য নেই। গতকাল দুপুরে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে তিনি এসব কথা বলেন। মিয়ানমার সরকারের উদ্দেশ্যে জিএম কাদের বলেন, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সবাইকে সংযত আচরণ করতে হবে। এ সময় তিনি বাস্তুচ্যুত, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এদিকে বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের নোম্যান্সল্যান্ডে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শিবিরে মিয়ানমার সেনাদের নিক্ষিপ্ত গোলায় নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন জিএম কাদের। পাশাপাশি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান ।
বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া-
সতর্ক থাকতে হবে, কড়া বার্তা দিতে হবে
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ পর্যন্ত যা হয়েছে তার জন্য মিয়ানমারকে কড়া বার্তা দিতে হবে। একইসঙ্গে জাতিসংঘসহ বিশ্ব ফোরামে উপস্থাপন করতে হবে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন নর্থ রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মি কয়েকটা জায়গা দখল করেছে। তার মধ্যে মান্ডুর শহরের উত্তর দিকে একটি সামরিক ঘাঁটি দখল করেছে। সেখানে প্রায় ১৯ জন সৈনিক মারা গেছে। আমাদের পিলার ৪০ এর কাছাকাছি আরেকটি জায়গা দখল করেছে। তাই মিয়ানমার আর্মি কাউন্টার অ্যাটাক শুরু করেছে। যার প্রভাব বাংলাদেশে এসে পড়েছে। ওইসব এলাকায় কিছু রোহিঙ্গা আছে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। জাতিসংঘ মাঝেমধ্যে কিছু ত্রাণ পাঠাতো সেটিও বন্ধ করে দিয়েছে সংঘর্ষের কারণে। তিনি বলেন, মিয়ানমার যখন একটি ক্যাজুয়েলিটির মধ্যে পড়ে তখন তারা হেলিকপ্টার, জেট ফাইটারও ব্যবহার করে। আর যখন সেগুলো ব্যবহার করে গোলা ছোড়ে তখন কোথায় কি পড়ছে বোঝা যায় না। অনেক সময় বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকে যাচ্ছে গোলা। তারা ইচ্ছে করে এমনটি করছে কি না, সেটিও বোঝা যাচ্ছে না। পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বুঝতে হবে। তবে এটা আমাদের জন্য বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করছে।
এটা তাদের অভ্যন্তরীণ মারামারি। কিন্তু যদি আমাদের সীমান্তের মধ্যে পড়ে সেটা তো দেশের জন্য বড় একটা সমস্যা দেখা দিচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য। তাদের এই যুদ্ধ কমবে না আরও বাড়তে পারে। এমনও হতে পারে তারা পালিয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত রেখার ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের ওই এলাকায় তুমব্রু, ঘুমধুম এলাকায় পাহাড় ও ঘন জঙ্গলের কারণে নজরদারিও করা সম্ভব না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আমরা তাদেরকে বারবার বলেছি। যদি প্রয়োজন হয় জাতিসংঘকে জানানো হবে। আমি মনে করি বিশ্ববাসীকে জানানোই হবে সঠিক কাজ। তাদেরকে জানাতে হবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করছে। যুদ্ধের সম্ভাবনা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যুদ্ধ তো বললেই হয়না। এখানে বিজিবি আছে। তারা যদি ফায়ারিং করে তবে বিজিবিও পাল্টা জবাব দিতে পারে। এটা সীমান্ত পর্যায়ে হয়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যুদ্ধ হবে না। কারণ মিয়ানমার-বাংলাদেশ কেউই যুদ্ধ চাইবে না। কিন্তু যদি সেরকম অবস্থায় পড়ে বাংলাদেশকে অ্যাকশন নিতে হয় তাহলে বাংলাদেশ একা জড়াবে না। কারণ ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে রাখাইন অঞ্চল এখন স্পর্শকাতর। বিশেষ করে নর্থ রাখাইন অঞ্চলে ভারতের কালাডান প্রজেক্ট আছে। ইকোনমিক জোন করারও প্ল্যান করছে ভারত। কালাডান নদী ব্যবহার করছে। যেখানে বন্দর করার কথা সেখানে আরাকান আর্মি অ্যাটার্ক করছে। কাজেই ভারতের ভুমিকা কি হবে, চীন, আমেরিকার ভুমিকা কি হবে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখানে বড় ধরনের কিছু হতে পারে। যার জন্য আমরা ফেঁসে যেতে পারি।
তিনি বলেন, যদিও এগুলো দূরের কথা, যদির কথা। তবে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কে যদিটা গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে দেখা হয়। নিশ্চই আমাদের দেশের সরকার বা এগুলো নিয়ে যারা গভীর চিন্তা করেন স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলোচনা করছে। স্থানীয়দের আতঙ্ক নিয়ে তিনি বলেন, স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্গ থাকবে। কারণ কিছু এলাকা বর্ডারের কাছাকাছি। এখানে গ্রাম আছে ও লোকজন আছে। তাই এরকম পরিস্থিতিতে শুধু তাদের মধ্যে নয় আমাদের সকলের মধ্যে উৎকণ্ঠা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক ভালো না অনেক আগে থেকে। এক সময় আমাদের সামরিক অবস্থা ভালো ছিল। আমরা মিয়ানমারের বেশ কয়েক মাইল ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলাম। কিন্তু চীন ও ভারতের মধ্যেস্থতায় বাংলাদেশ সরে আসে। বর্তমান সরকার আসার পর সম্পর্কটা ভালো হয়নি। তিনি বলেন, আরাকান আর্মি সম্প্রতি বেশ কয়েকটি গেরিলা যুদ্ধে জয়লাভ করেছে। তারা হুটহাট বেশ কিছু স্থান দখল করেছে। তারমধ্যে সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে। তিনি বলেন, এই পরিস্তিতি সীমান্তে সৈন্য মোতায়েন করা দরকার। কারণ দুর্বলদের সবাই আঘাত করতে চায়। জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হেল কাফী মানবজমিনকে বলেন, জরুরি ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরিষদে অভিযোগ দেওয়া উচিত। কারণ এভাবে চলতে দেওয়া যায় না।
অনেক সময় ক্ষুদ্র আঘাত থেকে বড় আঘাতের সৃষ্টি হয়। বড় বিপদের সম্ভাবনা থাকে। তাই আমি মনে করি এখনও বিষয়টি ছোট আছে তাই সমাধান করা উচিত। তিনি বলেন, যুদ্ধ কোন সমাধান না। যুদ্ধে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশের সকল উন্নয়ন যুদ্ধের কারণে চুরমার হয়ে যাবে। যুদ্ধের পরে সেগুলো গড়তে হলে বড় ধরণের সংকটে পড়তে হবে। তাই জাতিসংঘের মাধ্যমেই এর স্থায়ী সমাধান করতে হবে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে সুরাহা করা দরকার। এছাড়া ভারত, চীনের সঙ্গেও আলোচনা করা দরকার বারবার এমন হচ্ছে। নিরাপত্তার বিষয়ে তিনি বলেন, আগে নিরাপদ থাকতে হবে আমাদের। তবে আমি আক্রমণ করবো না। আবার আমাকে যদি কেউ আক্রমণ করে তবে প্রতিহত করতে হবে।