অবশেষে তিস্তা মহাপ্রকল্পের জট খুলতে শুরু করেছে। ভারতের চাপে দীর্ঘদিন ফাইল আটকে রাখার পর চীনের অর্থায়নে তিস্তার নদীর জীবনরক্ষার মহাপ্রকল্পের ফাইল নড়তে শুরু করেছে। অনেক আগেই তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্পের নদীর বাম তীর সম্ভবতা যাচাইয়ের কাজ প্রায় শেষ করেছে। এখন প্রকল্পের প্রস্তাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডে থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। চীনের অর্থায়নে এই মহামেগা প্রকল্পের কাজ তিন ধাপে শুরু হবে।
গত ১৬ জুন একটি টিভি চ্যানেলে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেছেন, চীনের সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা অর্থায়নে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে নদীটির বিস্তৃত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুজ্জীবনে একটি প্রকল্প। জানতে চাইলে পানি উন্নয়নের উত্তরাঞ্চল রংপুরের প্রধান প্রকৌশলী মুহাম্মদ আমিরুল হক ভূঞা ইনকিলাবকে বলেন, ইতোমধ্যে তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্পে নদীর বাম তীর রক্ষার কাজ শুরু হবে। এ প্রকল্পের সম্ভবতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করেছে। যে কোনো সময় প্রকল্পের প্রস্তাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডে থেকে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আর তিস্তা মহাপরিকল্পনায় থাকা তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্প পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে থেকে দেখভাল করা হচ্ছে। এ বিষয় বলা যাবে না। এ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক অবসরে যাওয়ার কারণে নতুন পিডি নিয়োগ হয়নি। ডালিয়া থেকে চিলমারী পর্যন্ত তিস্তার বাম তীর প্রকল্পের কাজ আগে শুরু হবে।
তিস্তার পানি চুক্তির খসড়া চূড়ান্তের পরও ২০১২ সাল থেকে তিস্তা চুক্তি আটকে রয়েছে। ভারতের সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহ ঢাকায় এসে তিস্তা চুক্তি করার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কারণে চুক্তি হয়নি। তখন থেকে ঝুলে রয়েছে তিস্তা চুক্তি। এর মধ্যে চীন তিস্তা নদীর খননসহ দুইপাশে ১৭৩ কিলোমিটার তীরে উন্নয়নের প্রস্তাব দেয়। চীনের অর্থায়নে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্পের কাজের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু হয়। তিস্তা মহাপ্রকল্পের ব্যপারে সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও প্রশাসনের কিছু দিল্লিঘেঁষা আমলার বাঁধার কারণে তিস্তা প্রকল্পের ফাইল চাপা দিয়ে রাখা হয়। এখন ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় চীনের অর্থায়নে তিস্তা মহাপ্রকল্পের কাজ শুরু করার উদ্যোগ নেয়া হয়।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারতের সাথে তিস্তার পানি চুক্তির প্রয়োজন পড়বে না। ১০ থেকে ১২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তিস্তা নদীর দুইপাশে ১৭৩ কিলোমিটার নদীর তীরে নগর-বন্দরের পরিকল্পনা, থাকছে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প, থানা ও কৃষিসেচ প্রকল্প। আগামী বছর শুরুতে ডিমলা থেকে শুরু হয়ে চিলমারী পর্যন্ত কাজ তিস্তা বাম তীর প্রকল্প করতে চায় সরকার। তবে তিস্তার এ প্রকল্প বাস্তবায়নের ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আপত্তি নেই বলে সরকারী পর্যায় থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের বক্তব্যে মনে হচ্ছে, তিস্তা মহাপরিকল্পনা ‘আঁধার কেটে গেল’ ১৩ বছর। ভারতের চাপে এতোদিন তিস্তা মহাপ্রকল্পের ফাইল আলফিতায় আটকে রাখা হলেও তিস্তা নদীর ভাঙন ও বন্যা থেমে নেই। রংপুরের ৮ জেলার মাসুষ উন্নয়ন বঞ্চিত। নদীতে বিলীন হাজারো পরিবার। নদী ভাঙনে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। বিলীন হচ্ছে হেক্টরের পর হেক্টর ফসলি জমি। খরাকালে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও খননের কাজ শুরুর দাবিতে মানববন্ধন করেছেন রংপুর বিভাগের বাসিন্দারা।
নাম প্রকল্পে অনিচ্ছুক পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ভারত সফর থেকে আসা এক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, এবার তিস্তা চুক্তি না হলেও তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে বাঁধা নেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে। তিনি বলেন, তবে ভারত সরকার চায় তিস্তা চুক্তি সমাধান।
এ প্রসঙ্গে তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্পের সাবেক পরিচালক ও প্রধান প্রকৌশলী আজিজ মুহাম্মদ চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, চীনের প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে উত্তরাঞ্চলের জেলারগুলোর চিত্র পাল্টে যাবে। তিস্তার নদী খনন, নদীর দুপাড়ে তীর রক্ষাকাজ, চর খনন, দুইপাড়ে স্যটেলাইট শহর নির্মাণ এবং হাজার হাজার বাড়িঘর রক্ষা পাবে।
জানা গেছে, এ প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদী ড্রেজিং করে ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, নদীর দু’পাড়ে ১৭৩ কিলোমিটার তীর রক্ষা, চর খনন, নদীর দুই ধারে স্যটেলাইট শহর নির্মাণ, বালু সরিয়ে কৃষিজমি উদ্ধার করা হবে। এতে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা এবং প্রতি বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলার মানুষের ভাগ্যের চাকা।
চীনের তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারত থেকে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত পানি আর প্রয়োজন পড়বে না। নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বৃদ্ধি পাবে। বন্যায় উছলে ভাসাবে না গ্রাম-গঞ্জ জনপদ। সারা বছর নৌ-চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। নৌবন্দর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দুইপাড়ে থানা, কোস্ট গার্ড, সেনাবাহিনীর জন্য ক্যাস্পের ব্যবস্থা প্রস্তাবও রাখা হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরে তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্পটি ২য় প্রকল্প বাংলাদেশের। এবার পদ্ম সেতু চালু হওয়ার পরে নতুন করে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে।
জানা যায়, পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুই পাড়ে পরিবকল্পিত স্যাটেলাইট শহর, নদী খনন ও শাসন, ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা, আধুনিক কৃষিসেচ ব্যবস্থা, মাছচাষ প্রকল্প পর্যটনকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এতে ৭ থেকে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন নামে একটি প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। এই বড় প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশন থেকে এর মধ্যেই ইআরডিতে পাঠানো হয়েছে। চায়না পাওয়ার কোম্পানি দুই বছর থেকে তিস্তা পাড়ে নির্মিতব্য প্রকল্প বাস্তবায়নে নকশা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করেছে। তিস্তা নদীর পাড়ের জেলাগুলো নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধায় চায়নার তিনটি প্রতিনিধি দল কাজ করছেন।
জানতে চাইলে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম ইনকিলাবকে বলেন, চায়না পাওয়ার কোম্পানি দুই বছর ধরে তিস্তা পাড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাপরিকল্পনার নির্মিতব্য প্রকল্প বাস্তবায়নে নকশা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করেছে। যে যাই বলুক, এ সরকারের আমলে তিস্তা প্রকল্প এবং তিস্তা ব্যাজেরে কাজ উদ্বোধন করা হবে। পানিসম্পাদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার ইনকিলাবকে বলেন, এরই মধ্যে প্রকল্পের প্রস্তাবনার পরিকল্পনা কমিশন থেকে ইআরডিতে পাঠানো হয়েছে। এটি শেষ হলে আগামী নভেম্বর বা ডিসেম্বর চীনের সঙ্গে চুক্তি হবে। এর পরে টেন্ডার প্রক্রিয়ার শুরু করা হবে।
উত্তরাঞ্চলের মানুষকে তিস্তা নদী ঘিরে মহাপরিকল্পনা উপহার দিতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার। ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদীর দুই পাড়ে ২২০ কিলোমিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হবে। বাঁধের দুই পাশে থাকবে সমুদ্র সৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ। যাতে পর্যটকরা লং ড্রাইভে যেতে পারেন। এছাড়া এই রাস্তা দিয়ে পণ্য পরিবহন করা হবে। নদী পাড়ের দুই ধারে গড়ে তোলা হবে হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন নগরী। টাউন নামের আধুনিক পরিকল্পিত শহর, নগর ও বন্দর গড়ে তোলা হবে। তিস্তা পাড় হয়ে উঠবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো সুন্দর নগরী। এতে করে উত্তরের জেলা লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলার আর্থিক সমৃদ্ধি স্থায়ী রূপ নেবে। পাল্টে যাবে এসব জেলার মানুষের জনজীবন। তিস্তা পাড়ের মানুষের দুঃখের দিন শেষ হয়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে চীন সরকারের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে যান। সেই সময় চীনের সঙ্গে উন্নয়ন প্রকল্প ও বাণিজ্য বিষয়ে বেশ কয়টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও স্মারক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। সেই সময় শেখ হাসিনা এক সময় চীনের দুঃখ খ্যাত হোয়াংহো নদী নিয়ন্ত্রণ করে চীনের আশীর্বাদে পরিণত করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের তিস্তাকে আশীর্বাদে রূপ দেয়া যায় কি-না তার প্রস্তাব করেন। চীন সরকার নিজ উদ্যোগে ও নিজ খরচে দুই বছর ধরে তিস্তা নদীর ওপর সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষা শেষে একটি প্রকল্প নির্মাণের প্রস্তাব দেয়।
সোর্স : ইনকিলাব