ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি ঘোষণা দিয়ে আন্দোলনে নেমেছে, সভা-সমাবেশ করছে। প্রথম দু-একটা সভায় কোনো বাধা আসেনি। ফলে দেখা গেল বিএনপির সমাবেশে হাজার হাজার কিংবা লাখো লোক সমবেত হচ্ছেন। তার আগেই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে বাধা দেয়া হবে না। শুরুর দিকে আওয়ামী লেঠেল বাহিনী সম্ভবত সেটা মেনে চলেছে। পুলিশও শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার কাজে নিয়োজিত ছিল। বাধা দেয়নি। কিন্তু যখন দেখা গেল বিএনপির সমাবেশে লাখো লোক সমবেত হয়ে এক দাবি তুলছে আগামী নির্বাচন হতে হবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে। আর তারা বর্তমান নির্বাচন কমিশন মানে না। কারণ ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই নির্বাচন কমিশন সরকারের অঙ্গুলি হেলেনেই চলছে। তাদের দ্বারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তার প্রমাণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশন যে আলোচনা করেছে তাতে আওয়ামী লীগ ও তার কিছু পকেট দল ছাড়া বাকি সবাই ইভিএমের ভোটে বিরোধিতা করেছে। এমনকি আওয়ামী লীগের পরম মিত্র জাতীয় পার্টি বলেছে, তারা ব্যালটে নির্বাচন চান, ইভিএমে নয়। তবে ইভিএম সমর্থন করেছে মাইজভা-ারী তরিকত ফেডারেশন। নির্বাচন কমিশনে আওয়ামী লীগ তাদের কথা এই মাইজভা-ারীর মাধ্যমেই প্রকাশ করেছে। মাইজভা-ারী নির্বাচন কমিশনে যাদের নাম সুপারিশ করেছিল সিইসিসহ তাদের অধিকাংশ নির্বাচন কমিশনে ঠাঁই পেয়েছে। এ এক রহস্য। সে কারণে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় নাগরিক এক বিবৃতিতে ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন না করার আহ্বান জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের কাছে। ধারণা করি, সরকারের মদদে নির্বাচন কমিশন এসব আহ্বানে কোনোরূপ সাড়া দেবে না।
বিএনপি তো আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছে যে, এই সরকার ও কমিশনের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন যে, সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যালটে নির্বাচন দিতে প্রস্তুত। যদিও তিনি জানেন যে, বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ঐকমত্য একেবারেই অসম্ভব। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন যে, নির্বাচন ইভিএমের মাধ্যমেই হবে। নির্বাচন কমিশন সে চেষ্টাই করছে। তিনশ’ আসনে ইভিএমে নির্বাচন করার জন্য তারা প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। সেই বিবেচনায় হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে তারা আরো ইভিএম মেশিন কেনার প্রকল্প চূড়ান্ত করেছে। সে সঙ্গে সিইসি হাবিবুল আউয়াল একেবারে আওয়ামী লীগের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলেছেন, কাউকে হাতে পায়ে ধরে নির্বাচনে আনা হবে না। কেউ অংশ নিক বা না নিক যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এ রকম একটা পরিস্থিতিতে বিএনপি দেশব্যাপী নানা ধরনের সভা-সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এই সমাবেশের শুরুর দিকেই সরকার ও তার পুলিশ বাহিনী একেবারে মারমুখী হয়ে ওঠে। তারা ভোলায় দু’জন বিএনপি কর্মীকে বুকে গুলি করে হত্যা করেছে। সরকারের প্রিয় ভাষা ‘আঙুল চোষা’ সাধারণত বিএনপি কর্মীরা খুন হলে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, আক্রান্ত হলে কী পুলিশ বসে বসে আঙুল চুষবে? কিন্তু আঙুল চুষবে না বটে, প্রথমত, ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে ভয় দেখাবে, তারপর পায়ের নীচের অংশে গুলি করতে পারে, বুক বরাবর নয়। অথচ ভোলায় পুলিশ সেই কা-ই করেছে। আর বিএনপিরই শত শত নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিয়েছে। অথচ ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মারামারি থামাতে পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ করেছিল বরগুনায়। কারণ সেখানে এসপিসহ ভিআইপিরা উপস্থিত ছিলেন। তাদের নিরাপত্তার জন্যই পুলিশ লাঠিচার্জ করেছেন। সেজন্যই ৯ জন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পুলিশের তাহলে সেখানে করণীয় কী ছিল? তাদের কি এ মারামারির মধ্যে বসে বসে আঙুল চোষা উচিত ছিল? এ রকম অবিরাম বৈষম্যের ভিতর দিয়েই চলছে প্রশাসন ও রাজনীতি। কোনো না কোনো দিন তো এর জবাবদিহি করতেই হবে।
এসব ব্যবস্থা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। সে কথাই বলতে এসেছিলেন জাতিসংঘ ও মানবাধিকারের চেয়ারম্যান মিশেল ব্যাচেলেট। তিনি বাংলাদেশের মানবাধিকারের পরিস্থিতিতে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রেস ব্রিফিং করেন। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে বলা হতে থাকে যে, তিনি কোনো উদ্বেগ-প্রকাশ করেননি। বাংলাদেশের মিডিয়াগুলো সরকারের ঢাক পেটাতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়নি এসব কথা প্রচার করে। বিষয়টি কমিশনের দৃষ্টিগোচর হলে তারা পুনরায় প্রেস ব্রিফিং করে জানায় যে, মিশেলের বক্তব্য ভুলভাবে প্রচার করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের গুম, খুন ও মানবাধিকার নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কদিন আগেও জাতিসংঘ সে কথা পুনরাবৃত্তি করেছে। কিন্তু দু’কান কাটারা রাস্তার মাঝখান দিয়েই হাঁটছে।
সম্প্রতি এ আন্দোলনের সময় যুবদলের মিছিলের ওপর কীভাবে পুলিশ গুলি চালায়। বুক বরাবর গুলিতে তাতে এক যুবদল কর্মী নিহত হন। এবার তো বিষয়টা আরো স্পষ্ট ছিল যে, ওই যুবদল কর্মী ছিলেন একেবারেই মিছিলের সামনে। বুক বরাবর গুলিতে তিনি মারা যান। এমনকি আওয়ামী লীগের কর্মীরাও একে নিশ্চয়ই খুন বলেই মনে করেছিলেন। তাই তারা দাবি করলেন যে, নিহত যুবক প্রকৃতপক্ষে যুবলীগের কর্মী। প্রতিবাদে তারা মিছিলও বের করে। পুলিশ ওই কর্মীর লাশ হস্তান্তরে নানারকম গড়িমসি করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মধ্যরাতে কড়া পুলিশ প্রহরায় তার লাশ দাফন করে দেয়। এই বর্বরতা সীমাহীন। তারপর এই হত্যাকা-ের জন্য বিএনপির শত শত নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করে।
পত্র-পত্রিকার রিপোর্টে দেখা যায়, বিএনপির চলমান কর্মসূচিতে হামলার জন্য ছেচল্লিশটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২৯টির বাদী পুলিশ বাকি ১৭ টি মামলা করেছেন সরকারি দলের নেতারা। এই ৪৬টি মামলায় আসামী করা হয়েছে ২১,৭০৯ জনকে। এর মধ্যে ২,৭৭৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বাকিরা অজ্ঞাতনামা। অজ্ঞাতনামা মানে যখন যাকে খুশি ওই মামলায় ধরে ফেলা যাবে। এসব আসামীরা বেশিরভাগই বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী। এর মধ্যে অসুস্থ, বয়স্ক ও প্রবাসী ব্যক্তিরাও রয়েছেন। গত ২২ আগস্ট থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২২ দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির ৪৮টি কর্মসূচিতে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ২৫টি স্থানে বিএনপির নেতাকর্মীদের বাড়িঘর, গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাংচুর হয়েছে। আর বিএনপির ডাকা সমাবেশস্থলে আওয়ামী লীগ হুট করে সমাবেশ ডাকায় ১৭টি স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রশাসনের মাধ্যমে বিএনপির সমাবেশ হতে না দেয়া। পত্রিকাটি মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, আসামী হিসেবে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের বেশিরভাগই বিএনপির নেতাকর্মী। তবে অসুস্থ, বয়সের কারণে চলাফেরা করতে পারেন না, দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে আছেন, ব্যবসায়িক কাজে অন্যত্র ছিলেন, এমন ব্যক্তিদেরও আসামী করা হয়েছে। এ রকম একজন আসামী খারনৈ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস আলী (৭৫) তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ, ভালোভাবে চলাফেরাও করতে পারেন না। ঘটনার দিন তিনি এলাকাতেও ছিলেন না। তারপরও তাকে আসামী করা হয়েছে। সুন্দরীঘাট এলাকায় মমরুজ খাঁ নামের একজন শারীরিক প্রতিবন্ধীকে অহেতুক আসামী করা হয়েছে। এছাড়া বামনগাঁও এলাকায় সাইদুল নামক একজনকে আসামী করা হয়। কিন্তু এলাকায় ওই নামের কোনো ব্যক্তিই নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নেত্রকোনার কমলাকান্দা থানার ওসি মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ খান বলেন, এসব বিষয় তদন্ত করা হচ্ছে। মামলার ৪৫ নম্বর আসামী নূরনবী পেশায় ঠিকাদার, তার দাবি তিনি কখনও বিএনপির রাজনীতি করেননি। একলাসপুরের এক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। বেগমগঞ্জের মামলার ২১ নম্বর আসামী ঢাকায় থাকেন। ঘটনার দিন এলাকায় ছিলেন না। ৪৩ নম্বর আসামী সামসুদ্দীন হেলাল ঢাকায় ব্যবসা করেন। ঘটনার দিন অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে ছিলেন। তিনি কোনো দল করেন না। ১১ নম্বর আসামী অসুস্থ এবং বেশ কিছুদিন ধরে বিদেশে আছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
মামলায় কাদের আসামী করা হয়েছে, জানতে চাইলে যুবলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম প্রথমে বলেন, তিনি সব আসামীকে চেনেন। এরপর নাম ধরে কয়েকজনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ থেকে নামগুলো দেয়া হয়েছে। তারা ভালো বলতে পারবেন। খানিক পরে তিনি বলেন, বিএনপিকে যারা টাকা-পয়সা দিয়ে সহায়তা করে তাদের আসামী করা হয়েছে। ‘সুশাসনের এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল’। কিন্তু জনতা জাগছে। এসব অপশাসন, হয়রানি, ভোগান্তির জবাব একদিন দিতেই হবে।