নাছির উদ্দিন শোয়েব : আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে আবারও তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটছে। গুম বা নিখোঁজ নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল উদ্বেগ জানিয়ে বাংলাদেশকে চিঠি দেয়ার পরও বন্ধ হয়নি তুলে নেয়ার ঘটনা। জাতিসংঘ সংস্থা চিঠি দিয়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ৩৪ জনের অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চেয়েছে। এরই মধ্যে রাজধানীর রামপুরা থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিচয়ে সদ্য এমবিবিএস পাস করা শাকির বিন ওয়ালী নামে এক চিকিৎসককে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করে তার পরিবার।
যদিও পরবর্তীতে তাকে গ্রেফতার দেখিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। সিটিটিসি বলছে- চিকিৎসক সাকিরকে তারা আটক করেছে। সংস্থাটি বলছে, শাকির নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলামের সক্রিয় সদস্য। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে তার পরিবার বলছে,শাকিরকে বেআইনিভাবে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আড়াল করার জন্য এমন অভিযোগ আনা হচ্ছে। আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে সকল অভিযোগ ভুল প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জও করা হয় পরিবার থেকে। ডা. শাকিরের বাবা চিকিৎসক এ কে এম ওয়ালী উল্লাহ বলেন, বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারছি যে তাকে কিছু মিথ্যা, বানোয়াট মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি আরও বলেন, আমরা শাকিরকে অন্যায়ভাবে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেবো। আইনের মাধ্যমেই প্রমাণ করবো আমার ছেলে নির্দোষ।
গত বছর গুম বা নিখোঁজের বিষয়ে জাতিসংঘ থেকে হঠাৎ বাংলাদেশকে চিঠি দেয়া হয়। এরপর আবারও বিষয়টি সামনে আসে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ৩৪ জনের অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল। এদিকে ৩৪ জন ব্যক্তির গুমের বিষয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদকে জবাব দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
এর আগে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, গত ১৪ বছরে দেশে ৬০৪ জনকে গুম করা হয়েছে। সব গুমের অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। গুমের শিকার সব নিখোঁজ ব্যক্তিকে অবিলম্বে খুঁজে বের করা, প্রতিটি গুমের অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন, দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গুমের শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারের যথাযথ পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানিয়েছে। একইসঙ্গে গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর করে গুম প্রতিরোধে সরকারের সদিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ থেকে ২০২০ (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত ৬০৪ জন গুমের শিকার হয়েছে বলে ভুক্তভোগী পরিবার ও স্বজনরা অভিযোগ তুলেছেন। এদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৮৯ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন ফেরত এসেছে। অন্যদের বিষয়ে সুর্নিদিষ্ট তথ্য গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়নি।
এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার, স্বজন বা প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, সাংবাদিক বা মানবাধিকার সংগঠনের তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, বিশেষ বাহিনী-র্যাব, ডিবি পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের তুলে নেওয়া হচ্ছে। প্রায়ই সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেফতার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করে। পরিচিত কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ছাড়া খুব কম ক্ষেত্রেই আলোচনা বা আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং উদ্ধারের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুম হওয়ার কিছুদিন পর হঠাৎ করেই তাদের কোনও মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় বা ক্রসফায়ারে তাদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। যারা ফিরে আসতে পেরেছেন তাদের ক্ষেত্রেও কী ঘটেছে তা জানা যায় না।
জানা গেছে, গত ২৫ আগস্ট কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে তিনজন মাদরাসা শিক্ষকসহ পাঁচ জনকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করা হয়। এই ঘটনায় কুমারখালী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন দুই ভুক্তভোগীর স্বজন। তারা জানায়, রাত ১১টা থেকে ১টার মধ্যে উপজেলার যদুবয়রা, পান্টি, বাগুলাট ও জগন্নাথপুর ইউনিয়ন এলাকা থেকে তাদের তুলে নেয়া হয়। এলাকাবাসী ও স্বজনরা জানান, নিখোঁজ ব্যক্তিরা সবাই এসবিএসএল নামের একটি অনলাইন ভিত্তিক (এমএলএম) ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই অনলাইন ব্যবসার তাদের প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের গোবরা গ্রামের মো. তফসের হোসেনের ছেলে মো. ইমরান হোসেন (তুষার)। তুষারের কার্যালয় ছিল পান্টি বাজার এলাকার নৌশের মোড়ে। গত ছয় মাস আগে এসবিএসএল কোম্পানি গ্রাহকের টাকা নিয়ে হওয়া হয়ে যায়। সেই থেকে বস তুষার পলাতক রয়েছেন।
গত ৯ জুন সমাজকর্মী মিজানুর রহমানকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেয়ার অভিযোগ করেন তার স্বজনেরা। তিনি রাজধানীর জুরাইনের বাসিন্দা। জুরাইনের বিক্রমপুর প্লাজার সামনে থেকে তাকে তুলে নেয়া হয় বলে অভিযোগ করা হয়। মিজানুর রহমানের স্ত্রী শামিম হাসেম খুকি জানান, আমার মেয়েকে সকালে সে ফোন করে জানায় তাকে পুলিশ পরিচয়ে একটি গাড়িতে তুলে নেয়া হচ্ছে। এরপর তার ফোন কেটে যায়। পরে ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। মিজানুর রহমানের বন্ধু মাহতাব উদ্দিন আহমেদ জানান, মিজানুর আমাকে ফোন দিয়ে জানায় তাকে পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে, আমি এখন শ্যামপুর থানায় আছি। মিজানুরের কথা শুনে আমি শ্যামপুর থানায় যাই। কিন্তু আমাকে ভেতরে যেতে দেয়নি। এ ব্যাপারে শ্যামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেন, তিনি পুলিশের ওপর হামলার ঘটনার সন্দেহভাজন। তবে তাকে আমরা আটক করিনি। ডিবি তাকে আটক করে থাকতে পারে।
২৬ জুন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার দলের এক নেতাকে তুলে নেয়ার অভিযোগ করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে। তিনি বলেছেন, ‘বিরোধীদল শূন্য না করলে নব্য-বাকশালি ব্যবস্থা কায়েম করা যাবে না বলে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের অদৃশ্য করছে’। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এসব বলেন। বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল অভিযোগ করে বলেন, কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পাবনার ঈশ্বরদী পৌর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া পিন্টুকে তুলে নিয়ে গেছে। তিনি তখন বলেন, আমাদের ধারণা সরকারের এজেন্সিগুলো পিন্টুকে তুলে নিয়ে গেছে। তাই অবিলম্বে তাকে জনসম্মুখে আনার জোর দাবি জানাচ্ছি।
এর আগে ২৭ মার্চ পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্য পরিচয়ে আশিকুর রহমান নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এক শিক্ষার্থীকে তুলে নেয়ার অভিযোগ ওঠে। রাজধানীর আজিমপুর এলাকার ভাড়া বাসা থেকে তাকে তুলে নেয়া হয় বলে অভিযোগ ছিল পরিবারের। আশিকুর রহমানের বাবা সিরাজুল ইসলাম জানান, আশিক ও তার বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। তারা একইসঙ্গে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। আশিক কোনো ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে না। অবিলম্বে ছেলেকে ফেরত চান তিনি। আশিকুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি জানান, ডিবি পুলিশ পরিচয়ে আশিককে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি কারণ জানতে চেয়েছিলেন। উত্তরে তাকে বলা হয়, জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়া হবে।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম