কখনও বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতর এসে পড়ছে মিয়ানমারের গোলা, কখনও এ দেশের আকাশসীমায় দেখা যাচ্ছে তাদের হেলিকপ্টার, আকাশ থেকে করা হচ্ছে গুলিবর্ষণ। আর সীমান্তের ওপার থেকে প্রায় প্রতিদিনই ভেসে আসছে গোলাগুলির আওয়াজ। তবে এবার আর সেসব নয়, গতকাল শুক্রবার মিয়ানমারের মর্টার শেলে নিহত হয়েছেন রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ ইকবাল (১৯)। তিনি ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের জিরো পয়েন্টের রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের বাসিন্দা মনির হোসেনের ছেলে। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ছয়জন। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন শূন্যরেখার রোহিঙ্গা নেতা দিল মোহাম্মদ।
এদিকে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ৩৪ নম্বর পিলার সংলগ্ন তুমব্রু জিরো পয়েন্টের ওপারে দুই দফায় আটটি বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। গতকাল রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে বিমান থেকে এ বোমাগুলো নিক্ষেপ করা হয়েছে। এর মধ্যে রাত ১০টায় প্রথম দফায় তিনটি এবং সাড়ে ১০টায় পাঁচটি বোমা নিক্ষেপ করা হয়। তবে রাতের অন্ধকারে দুর্গম এলাকা হওয়ায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে কিনা তা জানা যায়নি। সীমান্ত এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মর্টার শেলের ঘটনায় আহতরা হলেন- অস্থায়ী রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরের বাসিন্দা সেলিম উল্লাহ (৩৫), তাঁর স্ত্রী সাবেকুন নাহার (২৪) ও মেয়ে সাদিয়া জান্নাত (১০); ছৈয়দ করিমের ছেলে নবী হোসেন (২২), করিমের ছেলে ভুলু (৪৪) ও রহিম উল্লাহর ছেলে মোহাম্মদ আনাছ (১২)।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলে জিরো পয়েন্টের এক রোহিঙ্গা মারা গেছেন বলে শুনেছি। এলাকার লোকজন আতঙ্কে আছেন, গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
এদিকে ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ২০২২ সালের চলমান এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্র পরিবর্তন করে আজ শনিবার থেকে উখিয়ার কুতুপালং উচ্চ বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান হোসেন সজীব।
বেশ কিছুদিন ধরে এমন ঘটনায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন সীমান্তবর্তী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার ৫০ হাজার মানুষ। এরই মধ্যে গতকাল রাত ৮টার দিকে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু বাজারের পাশে আবারও চারটি মর্টার শেল এসে পড়েছে। এর আগে গতকাল বিকেলে ঘুমধুম ইউনিয়নের হেডম্যানপাড়ায় বাংলাদেশের ৩০ ফুট ভেতরে মাইন বিস্ম্ফোরণে গুরুতর আহত হন অথোয়াইং তংচঙ্গা। তিনি কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। স্থানীয়দের ধারণা, সীমান্তে পুঁতে রাখা এমন আরও বেশ কয়েকটি মাইন এখনও অবিস্ম্ফোরিত রয়ে গেছে।
এর আগে ৩ সেপ্টেম্বর যুদ্ধবিমান থেকে ছোড়া দুটি এবং ২৮ আগস্ট আরও দুটি অবিস্ম্ফোরিত মর্টার শেল তুমব্রু সীমান্তে এসে পড়ে। তবে ওই সময় কেউ আহত হননি।
সরেজমিন স্থানীয় বাসিন্দা ও সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ওয়ালিডং পাহাড়ে মাসখানেক ধরে সংঘর্ষ চলছে। দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) গোলাগুলির শব্দ এপারের মানুষকেও আতঙ্কিত করে তুলেছে। এর মধ্যে গত বুধবার গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যায়নি। তবে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে আবার তা শুরু হয়েছে। গতকাল সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত বাংলাদেশের তুমব্রু বাজার থেকে ওপারে মুহুর্মুহু গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
ঘুমধুম ইউনিয়নের বাইশপারি এলাকার বাসিন্দা নুরুল আলম বলেন, চলতি আমন মৌসুমে প্রায় তিন একর জমিতে ধান চাষ করেছি। কিন্তু গুলির ভয়ে ধানের পরিচর্যা দূরের কথা, ঘর থেকেই বের হতে পারছি না।
ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাতায়াতও বন্ধ করে দিয়েছি। সামান্য যে টাকা জমা ছিল, গত এক মাসে তাও শেষ হয়ে গেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনে ভয়াবহ সংকটের মধ্যে পড়তে হবে।
তুমব্রু এলাকার বাসিন্দা আবু ছৈয়দ বলেন, আমি বাইরে কাজ করে সংসার চালাই। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহে সীমান্তের ওপারে গোলাগুলি এবং এপারে নিরাপত্তার জন্য বিজিবির কঠোর নজরদারির কারণে নিয়মিত কাজ করতে পারছি না।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের আচারতলী, ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী, তুমব্রু, বাইশপারি, মগপাড়া, গর্জন বনিয়া, বরইতলী, পাত্তার ঝিরি ও ঘুমধুম এলাকার বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন।
তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, গোলাগুলির কারণে ঘুমধুম ইউনিয়নের প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিতির হার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমে গেছে। সীমান্তের এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এলাকার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, শূন্যরেখার আশপাশের জমিতে বাংলাদেশি কৃষকরা জুম, ধান ও শাকসবজির চাষাবাদ করেন। সীমান্তে ব্যাপক গোলাগুলি ও বাংলাদেশ অংশে গুলি এসে পড়ায় চাষিরা আতঙ্কে জমিতে যাওয়ার সাহস করছেন না।
নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস বলেন, সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা এর খোঁজ নিচ্ছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে টেকনাফ সীমান্ত এলাকায় ১২ হাজারের বেশি জেলের বসবাস। এর মধ্যে নাফ নদে মাছ শিকার করে জীবন চালাতেন প্রায় ৫ হাজার জেলে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে পাঁচ বছর ধরে মাছ শিকার বন্ধ রেখেছে সরকার। ফলে ওই সব জেলের পরিবারে নেমে এসছে চরম অভাব-অনটন। তেমনই একজন টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তের আবুল কালাম। তিনি জানান, রোজগার বন্ধ থাকায় পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে আছেন।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) এরফানুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে জেলে-চাষিসহ সীমান্তের যেসব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের বিভিন্ন দাতা সংস্থার মাধ্যমে জীবিকা পরিবর্তন করে, নতুনভাবে আয়ের পথ করে দিচ্ছি।
সোর্স : সমকাল