মানুষ বলে দিন আনি, দিন খাই। এখন আমাদের অবস্থাটা হয়েছে ডিম আনি, ডিম খাই। আবার ডিমের দাম যে হারে বাড়ছে তাতে ডিম খেয়েও কুলাতে পারছি না। এখন খাওয়ার মান কমেছে সেইসঙ্গে বেড়েছে খরচ। গত মাসে ১৪ হাজার টাকা বাড়ি থেকে নিয়েছি। আগে নিতাম ১২ হাজার টাকা। তারপরও আমার ৫০০ টাকা ধার করতে হয়েছে। এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর শুক্রাবাদের একটি মেসে থাকা শিক্ষার্থী আফসানা চৌধুরী প্রিয়ন্তী। তিনি বলেন, রুম ভাড়া সাড়ে চার হাজার টাকা, আনুষঙ্গিক ৫০০ টাকা। এরপর খাওয়ার পেছনে আগে খরচ হতো মাসে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা।
এবার পাঁচ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। এরপরও শুধু ডিম খাই। দুই রুমের ফ্ল্যাটের এই মেসটিতে তারা চারজন থাকেন। প্রত্যেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মেসের খরচের তালিকায় খাতায় দেখা যায়, জুন মাসে খরচ ছিল (বুয়া, ময়লা ও ইন্টারনেট বিলসহ) ১৫ হাজার ২৩০ টাকা, জুলাইয়ে ১৫ হাজার ৭৪১ টাকা, আগস্টে ১৬ হাজার ৮৪০ টাকা।
প্রিয়ন্তী বলেন, তেলের মূল্য যখন অত্যাধিক হলো তখন কয়েকদিন অর্ধেকটা করেও ডিম খেয়েছি। আমরা সাপ্তাহিক বাজার করি আগে বাজারে মাছ ও ব্রয়লার মুরগি থাকতো মাস্ট। এখন হয় মুরগি কিংবা মাছ কেনা হয়। পাবদা মাছের কেজি ক’দিন আগেও দুই থেকে আড়াইশ’ টাকায় মিলতো। এখন তিনশ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ টাকা লাগে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দুরবস্থায় পড়েছেন দেশের সাধারণ জনগণ। এরই মাঝে মেসের শিক্ষার্থীদের অবস্থা আরও নাজুক। সীমিত অর্থ সেইসঙ্গে টিউশনির টাকায় কোনোভাবে চলছে মেসে থাকা শিক্ষার্থীদের জীবন। তারা বলছেন, একদিকে কমছে খাবার মান। অন্যদিকে বাড়ছে খরচ। প্রতিমাসেই বাড়ছে মিলরেট। আর ধারদেনা নিত্য দিনের ঘটনা। শুক্রাবাদেই আরেকটি তিনরুমের ফ্ল্যাটে থাকেন ১৩ জন। তিন রুমে ৯ জন ও ডাইনিং স্পেসে চার জন। এই ছাত্রাবাসে এসেছে আমুল পরিবর্তন। সাদেকুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা মাসের শুরুতে তিন হাজার করে টাকা দেই। এই টাকায় সপ্তাহে অন্তত চারবেলা মাছ ও চারবেলা মুরগী খাওয়া যেতো অনায়াশেই।
সেইসঙ্গে থাকতো কোনো ভাজি বা ভর্তা। কিন্তু এখন মাছ বা মুরগি রান্না হলে থাকে না ভাজি-ভর্তা। আবার শুধু ভাজি ভর্তা দিয়েও খেতে হয়। আবার বাকি দিনগুলোতে সাধারণত ডিম রাখা হতো। ডিমের দাম বাড়ায় সেটাও আর নিয়মিত রাখা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, আগের থেকে বাড়ি ভাড়াতেও ৩০০-৫০০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে। কারণ সার্ভিস বিল রীতিমতো দ্বিগুণ হয়েছে। খালা আমাদের এখানে দুইবেলা রান্না ও মেস পরিষ্কারের কাজ করেন। আমাদের দিতে হয় ৬ হাজার টাকা। জুন মাসে খালা ৫০০ টাকা বেতন বৃদ্ধি করতে বলেন। এরপর অন্য খালাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাড়ে সাত থেকে আট হাজার টাকার নিচে কাজ করবেন না। বাধ্য হয়ে ৫০০ টাকা বেতন বাড়িয়ে দেয়া হলো। দুই মাস না যেতেই আবার ৫০০ টাকা বেতন বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন। এখন আমাদের বাধ্য হয়েই তা দিতে হবে। এখন আমাদের মিলরেট হয়েছে ৪৬ টাকা। যা দু’মাস আগেও ছিল ৩৮ টাকা। ফার্মগেটে একটি মেসে থাকেন জিসান রহমান। তিনি বলেন, আমাদের ক্যাম্পাস ধানমণ্ডি থেকে আশুলিয়ায় শিফট হয়েছে। আগে রিকশায় যাতায়াত করতাম ৩০ টাকা করে দিনে ৬০ টাকা খরচ হতো।
এখন যেতে ভার্সিটির বাসে লাগে ২৫ টাকা। আর ভেঙে আসতে খরচ হয় প্রায় ৭০ থেকে ৮০ টাকা। আগে দুপুরে মেসে খেতাম, এখন বাইরে খেতে ৭০ থেকে ৮০ টাকা খরচ হয়। বাড়তি খরচের সঙ্গে যোগ হয়েছে উচ্চমূল্য, মানিয়ে নিতে পারছি না আর। কাটছাঁট করে চলছি। মোবাইলে ক্যামেরাটা নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক করতে আড়াই হাজার টাকা লাগবে। আব্বুর কাছ থেকে নিলাম কিন্তু পকেটে টাকা নাই বিধায় এই টাকা খরচ হয়ে গেল। তিনি বলেন, বাড়তি খরচের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছি না। আগে প্রতিনিয়ত রিকশায় উঠতাম। এখন রিকশায় খুব প্রয়োজন ছাড়া উঠি না। মেসগুলোতে সাধারণত একজন ম্যানেজারের তত্ত্বাবধানে চলে। তিনিই হিসাব রাখেন সবকিছুর। শুক্রাবাদের দুটি, ফার্মগেটের একটি, রংপুরের একটি ও রাজশাহীর একটি মেসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাদের প্রতিমাসেই বাড়ছে মিলরেট, কমছে খাবার মান। এই পাঁচটি মেসের মিলরেটের গড় করে দেখা যায়, জুন মাসে মিলরেট ছিল ৩৮ টাকা, জুলাইয়ে ৪৬ টাকা, আগস্ট মাসে এসে দাঁড়িয়েছে ৫৪ টাকা। অর্থাৎ দুই মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১৬ টাকা। রংপুরের মুন্সীপাড়ার ছাত্রাবাসে থাকেন ইয়ামিন মোল্লা। তিনি বলেন, আমাদের এখানে তিনবেলা খাবার রান্না হয়। সকালে সাধারণত আলু ভর্তা, ডাল ও অর্ধেক ডিমভাজি থাকে। কিন্তু এখন সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সকালে ডিম খাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের একবেলা খাবার জন্য সাধারণত দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের ব্রয়লার মুরগি আনা হতো।
এখন আমাদের এক কেজি ওজনের মুরগি আনতে হয়। আবার মাছ আকার ও প্রকার ভেদে আনা হতো দুই কেজি সমপরিমাণ। এখন এক কেজি মাছে চালাতে হয় মেস। তবুও বাড়ছে খরচ। অনার্স চতুর্থ বর্ষের এই শিক্ষার্থী বলেন, আমার বাবা কৃষক। কতো কষ্ট করে আমাকে টাকা পাঠান তা আমি ভালো করে জানি। দুটা টিউশনি করাই সেখান থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পাই। আর বাবার কাছ থেকে নেই তিন হাজার টাকা। আগে আমার থাকা-খাওয়া মিলে খরচ হতো চার হাজার টাকা। এখন থাকা আর খাওয়াতেই খরচ বেড়ে গেছে এক থেকে দেড় হাজার টাকা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি হল ছেড়ে এখন মেসে থেকে সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। টিউশনি একটা ছিল সেটাও হাতছাড়া হয়েছে ক’দিন আগে।
লেখাপড়া শেষে বাড়ি থেকে টাকা নিতেও লজ্জা লাগে। এখন মেসে আমার নিট খরচ বেড়েছে প্রায় দুই হাজার টাকা। আমাদের মেসে সকালে হাফ মিল ধরা হয়। প্রায় মাসখানেক যাবৎ সকালের মিলটা একটু বেলা করে খেয়ে দুপুরের মিল সাশ্রয় করছি। আর রাতের খাবারের একটা অংশ সকালের জন্য রেখে দেই। এভাবেই কোনোভাবে চলছে জীবন। আর ধারদেনা তো নিত্যদিনের ঘটনা। ঢাকায় পরীক্ষা দিতে গেলে আগে ন্যূনতম দুই হাজার খরচ হবে ধরে নিতাম। গেল শুক্রবার পরীক্ষা দিতে এসে আমার খরচ হয়েছে ২৭শ’ টাকা। এখন আমার ঘাড়ে ঋণ আছে সাড়ে ছয় হাজার টাকা। বর্তমানে একটু সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে একটা টিউশনি আর ভালোভাবে বাঁচতে চাই একটা চাকরি।
সোর্স : মানব জমিন