এক সময়ের আদর্শবাদী ছাত্রলীগ এখন শিক্ষার্থীদের কাছে যেন মূর্তিমান আতঙ্ক। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষক এবং সাধারণ মানুষ এ সংগঠনটির নাম শুনলেই আঁতকে ওঠেন। বিভীশিকার নাম যেন হয়ে গেছে ছাত্রলীগ। অথচ ভাষা আন্দোলন থেকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ’৬৯ গণঅভ্যুত্থান, ৯০’র দশকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ স্মরণীয়। সেই ঐতিহ্য ভুলে, ছাত্র রাজনীতির আর্দশচ্যুত হয়ে সেই ছাত্রলীগ এখন শিক্ষার্থীদের কাছে আতঙ্কের নামে পরিণত হয়েছে। চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, যৌন নিপীড়ন, খুনখারাবি, মাদক ব্যবসা, ছিনতাই, ধর্ষণ, শিক্ষার্থী নির্যাতন এমন কোনো অপরাধ-অপকর্ম নেই যেগুলোর সঙ্গে ছাত্রলীগের নাম আসছে না বা ছাত্রলীগ জড়িয়ে যাচ্ছে না। বেপরোয়া ছাত্রলীগ যে শেখ হাসিনা সরকারের সব ভালো অর্জনের মুখে চুনকালি মেখে দিচ্ছে সেটা আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ প্রকাশ্যে বলছেন। তারপরও বেপরোয়াই রয়ে গেছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনটি।
আ.লীগের নেতারা বলছেন, কথায় কথায় ‘নেত্রী মোদের শেখ হাসিনা’ বলে স্লোগান দিলেও ছাত্রলীগ গত কয়েক বছর ধরেই আওয়ামী লীগের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। ছাত্রলীগের একশ্রেণির নেতাকর্মী নানা ধরনের অন্যায়-অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হওয়ার খবর আওয়ামী লীগের জন্য, সরকারের জন্য একাধিকবার বিব্রতকর হয়েছে। ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার কোনো উদ্যোগই সফল হয়নি। কথা না শোনায় যাদেরকে ছাত্রলীগ দেখা শোনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তারাও এখন এড়াতে চান দায়িত্ব।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড মুখবুজে সহ্য করলেও সম্প্রতি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি ঘোষণার পর ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেন ছাত্ররাজনীতির সুযোগ না দেয়া হয় এজন্য ১০ হাজার ইমেল করেছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। এছাড়া প্রকাশ্যে এই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন অনেকে। তাদের ধারণা কমিটি গঠন ও ছাত্ররাজনীতি শুরু হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও আধিপত্য বিস্তার, সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণ, চাঁদাবাজী, সংঘর্ষ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ও সেশন জটের ঘটনা ঘটবে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আধিপত্য বিস্তার শুরু করেছে ছাত্রলীগ। টাকা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় এখন প্রতিটি ক্যাম্পাসেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন ছাত্র সংগঠনটি। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গেস্টরুম, র্যাগিং, ভর্তি ও সিট-বাণিজ্য কোনোটিই বন্ধ হয়নি, বরং বেড়েছে। গেস্ট রুম সংস্কৃতি না মানলে, নেতাদের কথা না শুনলে শিক্ষার্থীদের ওপর নেমে আসে অর্বণনীয় নির্যাতন, বের করে দেয়া হয়, হল-ছাত্রবাস থেকে। বুয়েটে আবরার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু বকর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারুক, পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎসহ অনেকেই প্রাণ দিতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় যাঁরা চালান তাদের চোখের সামনেই এসব ঘটলেও তাঁরা হয় নির্বিকার, নয়তো ক্ষমতাসীন দলের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন। প্রতিপক্ষ না থাকায় প্রায় ঘটছে নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারে সংঘর্ষ অথবা প্রতিপক্ষ কাউকে পেলে চলে মারধর এতে কারও মৃত্যু হয়েছে, নয়তো হাসপাতাল ঘুরে আসতে হয়েছে কিংবা হল থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
শুধু ঢাকায় নয়, রাজশাহী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশাল, খুলনা নানা প্রান্তেই এসব ঘটছে। ছাত্রীরাও পিছিয়ে নেই। ইডেন কলেজের এক নেত্রীর রেকর্ডকৃত অডিওতে যে ধরনের ভাষা শোনা গেছে, কলেজের একজন ছাত্রীকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি, শাসন আর কলেজ প্রশাসনের বিরুদ্ধে দম্ভোক্তি দেখিয়ে এখনো বহাল তাবিয়তে তিনি। কলেজ কিংবা ছাত্রলীগ কারো পক্ষ থেকেই নেয়া হয়নি কোন ব্যবস্থা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছাত্রলীগ নেতারা যত বড় অপকর্মই করুক না কেন কেউ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। আর এটি তাদের আরও বেপরোয়া হয়ে উঠার অন্যতম কারণ। জানা যায়, মহামারিজনিত দীর্ঘ বন্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রথম পাঁচ মাসে হলগুলোয় ১৮ শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। একই পরিস্থিতি রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মানবাধিকারবিষয়ক প্ল্যাটফর্ম ‘স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট টর্চার (এসএটি)’ তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই এসব নির্যাতনে জড়িত। ক্ষমতার সঙ্গে অন্যায় ও অনিয়মের এই যে যোগসূত্র, তা আর ছিন্ন হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মীরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভরসার জায়গা। তাদের পড়াশোনার সুযোগ করে দেয়াসহ যাবতীয় প্রয়োজনে প্রশাসনের সাথে কথা বলার জন্য এবং সেটি নিশ্চিত করার জন্য ছাত্রলীগ কাজ করে। ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে আসা এটা হচ্ছে যে, আমরা শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতির উপরই আমরা সবসময় ভরসা করি। শিক্ষার্থীরা তাদের প্রয়োজনে যখন তাদের ভালো লাগে তাদের ল্যাব, পরীক্ষা, ক্লাস এসবের সাথে সমন্বয় করেই তারা আসে। শিক্ষার্থীদের জোর করে কর্মসূচিতে নেয়ার অভিযোগ মানতে নারাজ সাদ্দাম।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, দুর্ভাগ্যের বিষয় রাজনীতি ক্রমেই জ্ঞান ও যুক্তিনির্ভরতার বদলে পেশিশক্তিনির্ভর হয়ে পড়ায় ছাত্ররাজনীতির সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে গেস্টরুম, র্যাগিং, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং কথিত বড় ভাইদের সঙ্গে সহমত হওয়া। গেস্টরুম সংস্কৃতি এবং ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের বাধ্যবাধকতা নিয়ে যে আতঙ্ক তা খুবই হতাশার।
তারা বলছেন, ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বাণী উদ্ধৃত করা আছে। শেখ হাসিনা বলছেন : ‘উচ্চ আদর্শ এবং সাদামাটা জীবন- এই হোক তোমাদের জীবনাদর্শ’। খুব ভালো পরামর্শ। শেখ হাসিনা যেহেতু ছাত্রলীগের ‘আদর্শিক নেত্রী’ সেহেতু তার আদেশ-নির্দেশ-পরামর্শ অবশ্য অবশ্যই ছাত্রলীগের মেনে চলা উচিত। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টোটা। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যে ‘উচ্চ আদর্শ এবং সাদামাটা জীবনযাপন’ করছেন না সেটা অনেকেই খেয়াল করছেন। ছাত্রলীগের অনেক নেতাই বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত। কেউ কেউ নাকি গাড়ি-বাড়িরও মালিক। ছাত্রলীগের কমিটিতে ঢোকার জন্যও নাকি মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন হয়। এগুলো কোনো মিথ্যা অভিযোগ নয়। তাজ্জবের বিষয় হলো ছাত্রলীগকে ‘সুপথে’ আনার কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায় না ।
বরং একের পর এক খারাপ কাজে ছাত্রলীগের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় মানুষ ছাত্রলীগকে একটি ‘অপরাধী’দের অথবা ‘অপরাধপ্রবণ’ সংগঠন হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত হচ্ছে। ধমক দিয়ে, শাসিয়ে ছাত্রলীগকে নিবৃত্ত করতে পারছেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। বিষয়টি উদ্বেগের, আশঙ্কার এবং হতাশার।
ছাত্রলীগ দেখভালের দায়িত্ব যাদের দেয়া হয়েছে তাদের অন্যতম আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, ছাত্রলীগের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে সম্প্রতি তিনি গণমাধ্যমে ছাত্রলীগের কমিটি বাণিজ্যসহ নানা অনিয়ম নিয়ে নিজের হতাশার কথা জানিয়ে বলেন, কোন অবস্থাতেই ছাত্রলীগের কমিটির কেউ আর্থিক লেনদেনে থাকতে পারবে না। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলবে আমার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ মিথ্যা।এটাকে প্রমাণ করতে হবে।আমাদের কাছে এমন অভিযোগ আসে।আমরা যথারীতি তাদের জিজ্ঞেসও করি। তারা বলে এসবের কোন ভিত্তি নেই।
আবদুর রহমান আরও বলেন, আমি নৈতিক ভাবে মনে করি ছাত্রলীগ যারা করবেন। যারা নেতৃত্বে আসবেন তাদের নৈতিক হতে হবে।একজনকে পরিবর্তন করে আরেকজনকে আনা হলেও একই অভিযোগ উঠছে।রাজনীতি করতে হলে দলের প্রতি একাত্মবোধ থাকার কোন বিকল্প নেই। কোন অনিয়মে জড়ানো যাবে না।”
সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড : গত বুধবার রাজশাহী জেলা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সাকিবুল ইসলাম রানার একটি অডিও ভাইরাল হয়। যেখানে তিনি নিজ সংগঠনের এক নেত্রীকে তার কাছে মেয়ে পাঠাতে বলেন। এই ঘটনায় তোলপাড় চলছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ঘটনার দুইদিন পর তদন্ত কমিটি করেছে ছাত্রলীগ। যদিও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ প্রতিটি ঘটনায় যখন আলোচিত হয় ছাত্রলীগ কোনমতে ধামাচাপা দিয়ে সেটিকে আড়াল করে দেয়। আবার একই রকম ঘটনা ঘটে ভিন্ন স্থানে। ফলে আগের ঘটনা আর আলোচনা হয় না। এভাবে পার পেয়ে যায় অপকর্ম করা নেতাকর্মীরা।
ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড ঘেটে দেখা যায়, চলতি বছরেই অসংখ্য সংঘর্ষ, হামলা, চুরি, ছিনতাই, অপহরণ, ধর্ষণের ঘটনায় জড়িয়েছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) কাজী নজরুল ইসলাম হল এবং শেখ মুজিবুর রহমান হলের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ৯ সেপ্টেম্বর দফায় দফায় সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগে দুই গ্রুপ। হয়েছে। ৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে কয়েক দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে ১২ ছাত্রলীগ কর্মী আহত হয়। ৩০ আগস্ট ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শাহজালাল হলে শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের ঘটনা সমাধান করতে গিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হন সহকারী প্রক্টর রিজওয়ানুল হক কনক। ৫ আগস্ট রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়িতে কলেজছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে স্থানীয় ছাত্রলীগের দুই নেতাসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে এক যুবকের মোটরসাইকেল, মোবাইলফোন ও টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের দুই কর্মীর বিরুদ্ধে। ২৪ জুলাই কর্মসূচিতে না যাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের এক শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে ওই হলের ছাত্রলীগের দুই কর্মীর বিরুদ্ধে। ২৩ জুন মধ্যরাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) নবাব আব্দুল লতিফ হলে অবস্থানরত এক আবাসিক ছাত্রকে মারধরের পর সিট বিছানাপত্র নামিয়ে দেয় ছাত্রলীগ নেতা। ২১ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জগন্নাথ হলে এক শিক্ষার্থীকে তার কক্ষে ঢুকে বেধড়ক মারধর ও হল থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ উঠে হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। ২২ জুন নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে অপু (২২) নামের এক ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহকালে ২০ জুন রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রটের (বাসদ) ওপর হামলার অভিযোগ করে। রাজধানীর গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লাইড হিউম্যান সায়েন্সে (হোম ইকোনমিক্স কলেজ) ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে না যাওয়ায় গত ৯ জুন এক ছাত্রীকে মারধর করা হয়। ৮ জুন চট্টগ্রামে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকিসহ গণতন্ত্র মঞ্চের কেন্দ্রীয় নেতাদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।
৩ জুন রাজধানীর বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি সেলিনা আক্তার শেলীর অতর্কিত হামলায় নতুন হলের দুই শিক্ষার্থী আহত হয়। ১৯ মে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জুবায়ের আহমেদকে আটক করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। ১৯ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজির অভিযোগে অস্ত্রসহ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি দেলোয়ার হোসেন সাঈদী ওরফে সাহেদী হোসেনকে। ১৬ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শহীদ হবিবুর রহমান হলে জাবের হোসেন নামে এক আবাসিক শিক্ষার্থীকে সিট থেকে নামিয়ে দেয় হল ছাত্রলীগের সভাপতি মোমিন ইসলামের বিরুদ্ধে। ১৪ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিজয় একাত্তর হলের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে হলের ছাত্রলীগ কর্মী। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে ফুল দিতে গিয়ে ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের হাতাহাতি ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে ১৫ মে। ১৩ মে ইডেন মহিলা কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পর দুই গ্রুপে সংঘর্ষ হয়। এসময় ভাঙচুর করা হয় বেশ কয়েকটি কক্ষ। এছাড়া নতুন কমিটির সভাপতি-সম্পাদকের কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন কলেজ ছাত্রলীগের বিক্ষুব্ধ কর্মীরা।
১৫ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মোটরসাইকেল চালানোর সময় সম্ভাব্য দুর্ঘটনার বিষয়কে কেন্দ্র করে এক শিক্ষার্থীকে দলবল নিয়ে মারধর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ১১ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শেরে-ই-বাংলা হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থীকে হলে থেকে বের করে দিয়ে অনাবাসিক শিক্ষার্থীকে তোলা হয়। ৩১ মার্চ শরীয়তপুরে ছাত্রলীগের সভাপতিকে দাওয়াত না দেওয়ায় শিক্ষককে লাথি মারেন ওই নেতা। অভিযোগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। একই দিন রাজধানীর ঢাকা কলেজ ও সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ শাখা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত হয় ১৫ শিক্ষার্থী।
২৩ মার্চ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কেন্দ্র করে বিবাদে জড়িয়ে দুটি পক্ষ আবাসিক হলে অন্তত ১০টি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়েছে। এ সময় আহত হয় দুই শিক্ষার্থীও। ২২ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে হরতালের লিফলেট প্রচারকালে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালানো হয়।
২১ মার্চ কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) হল শাখা ছাত্রলীগের নেতাকে চিনতে না পেরে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করায় মার্কেটিং বিভাগের এক শিক্ষার্থী মারধর করা হয়। একই দিন বরিশালের বানারীপাড়ায় বেলচা ও বাঁশের লাঠি দিয়ে চার ইটভাটা শ্রমিককে মারধরের অভিযোগ উঠে ফোরকান হাওলাদার নামে এক ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে।
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ১২ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপের কর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় পাঁচজন আহত হয়।
৮ মার্চ বিনা টাকায় খাবার না পেয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) হলের ডাইনিংয়ের এক বাবুর্চিকে পেটানোর অভিযোগ উঠে শাখা ছাত্রলীগের তিন কর্মীর বিরুদ্ধে। কলেজের ছাত্রীদের উত্ত্যক্তের ঘটনাকে কেন্দ্র গত ৫ মার্চ সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলা ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এতে উভয়পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হয়। একই দিন চট্টগ্রাম মহানগরীর হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজে ভাঙচুর চালায় ওই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের একাংশ। রুমে গান বন্ধ করাকে কেন্দ্র করে ৩ মার্চ বিশ্বজিৎ নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে ছাত্রলীগকর্মী সাব্বির আহমেদ। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহম্মেদ আকাশ কলেজ ছাত্রীকে অপহরণ করার পর গত ২ মার্চ তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ছাত্রলীগের রাজনীতি না করায় ২৮ ফেব্রুয়ারি ওয়ালিদ নিহাদ নামে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাককানইবি) জুনিয়র এক শিক্ষার্থী মারধর করা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া থানায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত চারজন আহত হয়। র্যাগ দেওয়াকে কেন্দ্র করে ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে এক ছাত্রলীগ নেতাকে মেরে রক্তাক্ত করার অভিযোগ উঠে একই সংগঠনের নেত্রী বেনজীর হোসেন নিশির বিরুদ্ধে। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) মাদার বখ্শ হল থেকে বিছানাপত্রসহ এক আবাসিক শিক্ষার্থীকে কক্ষ থেকে বের করে দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। একই দিনে শ্যালিকাকে ধর্ষণের অভিযোগে গোপালগঞ্জের সরকারি মুকসুদপুর কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম কাজীকে (২৪) গ্রেফতার করে পুলিশ। এ ঘটনায় তার শ্বশুর তাকে প্রধান আসামি করে চারজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে একটি মামলা করেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তা ও ছাত্রলীগের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় অফিসার পরিষদের দপ্তর ও প্রচার সম্পাদক মাহমুদুল কবির খানসহ ১০ জন কর্মকর্তা আহত হন। ১০ ফেব্রুয়ারি রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ছাত্রলীগ নেতাসহ দুই যুবককে আটক করে পুলিশ। ২৬ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিজয় একাত্তর হলে এক অসুস্থ শিক্ষার্থীকে গেস্টরুমে না আসায় তাকে ধরে এনে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের ছয় কর্মীর বিরুদ্ধে। তারা ওই শিক্ষার্থীকে এক ঘণ্টা জ্বলন্ত বাতির দিকে তাকিয়ে থাকার শাস্তি দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। পরে তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী হলে ছাত্রলীগের সিনিয়রকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে জুনিয়র নেত্রীর বিরুদ্ধে। ১৫ ফেব্রুয়ারি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। ১২ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) অনুষ্ঠিত কাওয়ালি কনসার্টে হামলা চালিয়ে মঞ্চ ভাঙচুর ও দর্শনার্থীদের পেটায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সামনে বসাকে কেন্দ্র করে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জসীম উদদীন হল ছাত্রলীগ কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যসহ অন্তত ১৩ জন আহত হন। একই দিনে টাঙ্গাইলে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর র্যালিতে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্যকে একাধিকবার ফোন ও ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ১নং সহ সভাপতি রেজাউল করিম চৌধুরী প্রশ্ন শুনে ফোন রেখে দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি স্বীকার করতে রাজি নন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্রলীগ প্রশাসন চালায় না। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় প্রশাসন রয়েছে। তারাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কে আসবে কে আসবে না এসব ছাত্রলীগের কোনো বিষয় না। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করেই ছাত্রলীগের রাজনীতি করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট স্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক ও বিজয় একাত্তর হলের প্রভোস্ট প্রফেসর আব্দুল বাছির বলেন, আমার বিজয় একাত্তর হলে এমন কিছুই নেই। এখানে সবকিছুই হল প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে। তবে অন্যান্য হলে যদি হল প্রশাসনের বাইরে কোনো ছাত্র সংগঠনের প্রভাব থেকে থাকে তাহলে তা দুঃখজনক। এ বিষয়ে স্ব স্ব হল প্রশাসন ভালো বলতে পারবে।
সোর্স : ইনকিলাব