বন্যা ও খরার কারণে কৃষক আমন ধানের চাষ সময়মতো করতে পারেনি। এতে ফলন কম হওয়ার শঙ্কা করছে কৃষক। দুই দফা বন্যার কারণে সিলেট ও সুনামগঞ্জে সময়মতো আমনের আবাদ শুরু করা যায়নি। এ ছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেক জেলায় জুলাই-আগস্ট মাসে বৃষ্টি না হওয়ায় আমনের ক্ষেত শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। খরার কারণে যশোর, খুলনা, রংপুর, গাইবান্দা, কুড়িগ্রাম, নওগাঁ, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলসহ আরও অনেক জেলায় আগস্টের শেষ সপ্তাহ পর্যন্তও কৃষক আমন রোপণ করতে পারেনি। দীর্ঘ খরায় সেচ ব্যাহত হয়েছে। এ ছাড়া সার ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় চাষাবাদে খরচ বেড়ে চরম সঙ্কট তৈরি করেছে, যা আমনের সার্বিক উৎপাদনকে ব্যাহত করবে।
চলতি বছর আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫৯ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমি। তবে চাষ হয়েছে ৫৬ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, দেশের মোট চালের চাহিদার ৩৬ থেকে ৩৮ শতাংশ আসে আমন থেকে, আউশ থেকে ৬ থেকে ৭ শতাংশ। আর বাকি প্রায় ৫৫ শতাংশ আসে বোরো ধান থেকে।
গত আউশের মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন কম হয়েছে প্রায় ৫ লাখ টন। এখন আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত বছর ১ কোটি ৪৯ লাখ টন আমন উৎপাদন হলেও এ বছর সার ও সেচ সঙ্কটে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। সে জন্য চলতি মৌসুমে ২০-২৫ লাখ টন আমন উৎপাদন কম হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। এর ফলে হুমকিতে পড়বে খাদ্য নিরাপত্তা।
জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত আমন রোপণের মৌসুম হলেও আগস্টের শেষ পর্যন্ত এবার আবাদ করা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এ ছাড়া দেরিতে যেসব জমিতে আমন রোপণ করা হয়েছে সেগুলোতে যদি সামনের দিনগুলোতে মাঝে মাঝে বৃষ্টি অব্যাহত থাকে তাহলেও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম ফলনের সম্ভাবনা আছে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন।
বগুড়ার গাবতলী উপজেলার কৃষক আরিফুল হক বলেন, এবার অনেক কষ্টে দুই বিঘা জমিতে আমন ধান রোপণ করেছি। বৃষ্টি না হওয়ায় শ্যালো মেশিনের পানি দিয়ে ধান রোপণ করেছি। এখন পর্যন্ত শ্যালো মেশিনের পানি দিয়ে আবাদ করতে হচ্ছে। তবে, দেরিতে লাগানো ও পর্যাপ্ত পানি না থাকায় ফলন কম হবে। আশ্বিন মাস এবং কার্তিক মাসে যদি মাঝে মাঝে বৃষ্টি না হয় তাহলে এসব ক্ষেতে ফলনের সম্ভাবনা একেবারেই নেই।
এ বিষয়ে শেরে বাংলা কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রকিবুল হাসান ইনকিলাবকে বলেন, বিরূপ আবহাওয়ার কারণে এ বছর আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। দীর্ঘ খরায় সেচ ব্যাহত হয়েছে। সার ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় চাষাবাদে খরচ বেড়ে কৃষিখাতে চরম সঙ্কট তৈরি করেছে। এটা আমনের সার্বিক উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে। উৎপাদন খরচ যখন বাড়ে তখন কৃষক উপকরণ সঠিকভাবে দিতে পারে না। এ কারণে ফলন কমে। দ্বিতীয়ত, এবার আমন রোপণ বিলম্ব হয়েছে, সেটাও ফলন কমার বড় কারণ। সব মিলিয়ে চলতি বছর লক্ষ্যমাত্রার ১০ শতাংশেরও বেশি জমিতে আবাদ হয়নি। উৎপাদনও কমবে সেই হারে। এতে ধারণা করা যায় যে চলতি মৌসুমে ২০-২৫ লাখ টন আমন উৎপাদন কম হতে পারে। তবে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে কৃষি উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয় সে বিষয়টিকে সরকারের অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে সার-ডিজেলসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণে সর্বোচ্চ ভর্তুকি দিতে হবে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে আমন উৎপাদন ব্যাহত হবে না। এবারো আমনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। সার ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি কোনো রকম প্রভাব ফেলবে না। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, সারাদেশে সারের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরির ষড়যন্ত্র চলছে। তবে এবিষয়ে আমরা অর্থাৎ কৃষি মন্ত্রণালয় সজাগ। ইতোমধ্যে এবিষয়ে মাঠপর্যায়ে দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আশা করি সার ও জ্বালানি সঙ্কটের জন্য কৃষকের উৎপাদন ব্যাহত হবে না। সার পর্যাপ্ত রয়েছে, জ্বালানির ক্ষেত্রেও ডিজেলে ভর্তুকি দেওয়া যায় কি-না সে বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। যদিও এর আগে চলতি আমন মৌসুমে উৎপাদন লক্ষমাত্রা নিয়ে কৃষিমন্ত্রী নিজেই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, আমন নিয়ে বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। জ্বালানি তেলের দাম বেশি। গ্রামগঞ্জে বেশিরভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। সেচ সঙ্কট তৈরি হয়েছে। অনেক এলাকায় বন্যার কারণে দেরিতে লাগানো আমনের ক্ষেত এখন সেচের অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। আবার অনেক এলাকায় বৃষ্টির অভাবে কৃষক জমিতে এখনো চারাই রোপণ করতে পারেনি। আগস্টের মধ্যে রোপণ করতে না পারলে ধানের উৎপাদন কমে যেতে পারে। তার সে শঙ্কা অনেকটা কেটে গেছে বলে তিনি মনে করেন।
আমনের ফলন প্রধানত বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। এ বছর অনেক কম বৃষ্টি হওয়ার কারণে আমনের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কৃষি বিভাগ বলছে, স্বাভাবিক বৃষ্টি না হলে আমন চাষে অন্তত তিন ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হন কৃষক। প্রথমত, সেচ দিতে বাড়তি খরচ হয়। দ্বিতীয়ত, ক্ষেতে আগাছা, রোগ ও পোকার আক্রমণ বেড়ে যায়। এতে ধানের ফলন কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তৃতীয়ত, উৎপাদিত ধান থেকে ভালো মানের চাল পাওয়া যায় না। জুলাইয়ের শুরু থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত আমন মৌসুম। আমন ধানের চারা রোপণের সময়কাল মধ্য জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। কিন্তু এবার মৌসুমের শুরু থেকেই খরা চলছে। এ কারণে কৃষককে অতিরিক্ত পানি সেচ দিতে হচ্ছে। সার ও ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে চাষে খরচ অনেক বেড়ে গেছে।
ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের কৃষক হারিছ উদ্দিন বলেন, বৃষ্টি না হওয়ায় সময়মতো ক্ষেত লাগাতে পারিনি। অন্যান্য বছর মৌসুমের শুরুতে লাগানোর সময় এবং চারা কিছুটা বড় হওয়ার পর বেশকিছু সার প্রয়োগ করতাম, যা এ বছর ঠিকভাবে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এক বস্তা ইউরিয়া ও টিএসপি সারের জন্য আগের চেয়ে সাড়ে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা বেশি লাগছে। অন্যবছর সেচের প্রয়োজন হতো না। এ বছর সেচ খরচ বেড়েছে ৪৫০ টাকা। এতো খরচের পর মৌসুম শেষে রোগবালাই থেকে টিকে উঠে ঠিকভাবে ফসল ঘরে তোলা নিয়েও চিন্তায় আছি। অহন আমরার আল্লার প্রতি ভরসা ছাড়া আর কিছু করনের নাই।
সোর্স : ইনকিলাব