হাতিরঝিলের পাশে ভবন নির্মাণে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করায় জমির মালিকরা পড়েছেন বেকায়দায়। সম্প্রতি গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদিত নতুন নীতিমালায় বলা আছে, ঝিলের পাশে প্লটে কোনো বহুতল ভবন নির্মাণ করা যাবে না। ঝিলপাড়ের ৩০০ মিটার দূরত্বের মধ্যে ৩৫ ডিগ্রি কোণে ভবনের উচ্চতা নির্ধারিত হবে। আর ১০ কাঠার নিচে জমি হলে সেখানে নকশা অনুমোদন দেবে না রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। ঝিলপাড়ের রাস্তাসংলগ্ন প্লটের আয়তন হতে হবে অন্তত এক বিঘা। এ ক্ষেত্রেও রাস্তার পাশে অন্তত ১০ ফুট জায়গা ছেড়ে দিতে হবে।
রাজউক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা সমকালকে বলেন, হাতিরঝিলের সৌন্দর্য রক্ষার বিষয়টি আমলে নিয়ে এ রকম নিয়ম করা হয়েছে। এসব কারণে নীতিমালা প্রণয়নের কাজ অনেক দিন ঝুলে ছিল। এখন নীতিমালা অনুমোদন হওয়ায় যে কেউ চাইলে ভবনের নকশার আবেদন করতে পারবেন।
রাজউকের এমন নীতিমালায় ক্ষুব্ধ ঝিলপাড়ের জমির মালিকরা। তাঁরা বলছেন, এমন নীতিমালার কারণে ছোট প্লটগুলোকে বড় প্লটের মালিকরা খেয়ে ফেলবেন। এক-দুই কাঠা জমির মালিকরা বিপাকে পড়বেন। ঝিলপাড়ের ১০ কাঠার জমির মালিক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘এই ১০ কাঠারও ১০ ফুট চলে গেলে থাকবে কী? পাশের জনের জমি আছে ২ কাঠা। তাঁরটা নিলেও তো এক বিঘা হবে না। তাহলে কী করব।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘আমার দুই কাঠা জমি আছে। আশপাশে ওই রকম দেড়-দুই কাঠা জমির মালিক আরও আছেন। তাঁদের কারোর মধ্যে কোনো সুসম্পর্ক নেই। তাহলে তাঁদের কী হবে?’
এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, এ ধরনের কাজ করার আগে ল্যান্ড কনসুলেডেশন স্টাডি করার প্রয়োজন ছিল। পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলোচনা করে যাঁদের ছোট জমি আছে সেগুলোকে অন্তত ১০ কাঠা বা এক বিঘায় পরিণত করা যেত। সেটি না করায় স্থানীয়রা অনেক ক্ষেত্রেই একমত হতে পারবেন না। তাঁরা প্রত্যেকেই বেশি লাভবান হতে চাইবেন। একজন আপত্তি দিলে অন্য দু’জন একমত হলেও জমির পরিমাণ ১০ কাঠা করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাহলে নকশার অনুমোদন পাবেন কীভাবে? তিনি আরও বলেন, এ কারণে এলাকায় আধুনিকায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। হয়তো একজন প্রভাবশালী আরেকজনের কাছ থেকে জোর করে জমিও কিনে নিতে পারেন। তখন দুর্বল ব্যক্তির কিছু করার থাকবে না।
নীতিমালায় যা আছে: নতুন নীতিমালায় হাতিরঝিলের রাস্তার পাশের প্লটগুলোকে ১০ ফুট করে জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। এক বিঘার কম আয়তন হলে কোনো প্লটে ভবনের নকশার অনুমোদন দেবে না রাজউক। সে ক্ষেত্রে ছোট আকৃতির কয়েকটি প্লট মিলে অন্তত এক বিঘার প্লট তৈরি করতে হবে জমির মালিকদের। একইভাবে ভেতরের প্লটগুলোর আয়তন হতে হবে অন্তত ১০ কাঠা। সে ক্ষেত্রে ওই প্লটের পাশে অন্তত ২৪ ফুট প্রশস্ত রাস্তা থাকতে হবে। জমির মালিকদের জায়গা ছেড়েই এটা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতি ভবনে ৫ ফুট জায়গা সেটব্যাক হিসেবে রাখতে হবে।
ওই পরিমাণ প্রশস্ত রাস্তা না থাকলে ভূমি মালিকদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে প্লটের সামনের রাস্তার প্রশস্ততা বাড়িয়ে রাজউকের কাছে ভবনের নকশার আবেদন করতে হবে। এছাড়া পুরো হাতিরঝিলের চারপাশের ৩০০ মিটার দূরত্বের ভবনগুলোর উচ্চতা ৩৫ ডিগ্রি কোণে নির্ধারিত হবে, যাতে পুরো হাতিরঝিলকে একটি ফানেলের মতো মনে হয়। দূরবর্তী ভবনের বাসিন্দারাও ঝিলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই হাতিরঝিলের পাশের বাসিন্দারা ভবন নির্মাণ করতে পারছিলেন না। এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছিল। বিষয়টি সমাধানে ২০১২ সালে ‘রাজউক বাস্তবায়নাধীন বেগুনবাড়ি এলাকার হাতিরঝিল-সংলগ্ন চতুর্পার্শ্বের ৩০০ মিটার দূরত্বে বিশেষ ড্যাপ বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ২৫ সদস্যের ওই কমিটির আহ্বায়ক করা হয় পূর্ত সচিবকে। এছাড়া রাজউকের ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুজিবর রহমান, অধ্যাপক শামসুল হক, অধ্যাপক ইশরাত ইসলামসহ নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা ছিলেন ওই কমিটিতে। বিভিন্ন সময় কমিটি এ নিয়ে বৈঠক করে। সর্বশেষ গেল ৭ ফেব্রুয়ারির বৈঠকে একটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করে কমিটি। সম্প্রতি নীতিমালাটির অনুমোদন দেয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
রাজউকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, হাতিরঝিলের পাশে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের প্লট রয়েছে। প্রতিটি প্লটের সঙ্গে রাস্তার সংযুক্তি সড়ক থাকলে হাতিরঝিলের মূল সড়কে যানজট তৈরি হবে। প্লটের আকার অন্তত এক বিঘা হলে ওই প্লটের সঙ্গে সংযুক্তি সড়ক থাকলে যানজট সৃষ্টি হবে না। ওইসব প্লটের মালিক হাতিরঝিলের পাশে জায়গা ছেড়ে দিলে আলাদা সার্ভিস রোড করা যাবে। তাহলে যানবাহন ও পথচারীর স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত হবে না।
এ ব্যাপারে কমিটির সদস্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও নগর পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক সমকালকে বলেন, এ ধরনের বিশেষায়িত এলাকার উন্নয়ন করতে গেলে পুরো এলাকার ভূমি মালিকদের নিয়ে বসতে হয়, যাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হন। এখানে যাঁরা হাতিরঝিলের রাস্তার পাশের প্লটের মালিক তাঁরা বেশি দাম দিয়ে জমি কিনেছেন। এখন তাঁকেই বেশি জমি ছেড়ে দিতে হচ্ছে। আবার ভবনের উচ্চতাও পাচ্ছেন কম। এতে তিনি লোকসানের মুখে পড়ছেন। তারপরও যেটা করেছে সেটা মন্দ না। এতে করে সবাই ঝিলের সৌন্দর্যটা উপভোগ করতে পারবে।
কমিটির অন্য সদস্য বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম বলেন, হাতিরঝিলের চারপাশের এলাকাকে এখন ‘বিশেষায়িত’ বলা হচ্ছে। এখন ছোট জমিগুলো মিলে একসঙ্গে উন্নয়ন করলে আর ঘিঞ্জি থাকবে না। আবার ঝিলের পাড়েই যদি ১৫ থেকে ২০ তলা ভবন উঠে তাহলে পেছনের প্লটের মালিক লেকের সৌন্দর্যটা পাবেন না। এসব বিবেচনায় নিয়ে এমনটা করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে নীতিমালা প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ল্যান্ড কনসুলেডেশন স্টাডি করে নীতিমালাটা করলে ভালো হতো। বাস্তবতা হলো বিভিন্ন কারণেই রাজউক সেটা করতে পারেনি। এটা রাজউকের সীমাবদ্ধতা বলা যায়।
সোর্স : সমকাল