এমনিতেই নানা ধরনের সংকটের মধ্যে আছে দেশের আর্থিক খাত। এর ওপর অর্থনীতিতে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে মেগা প্রকল্প। কেননা আগামী ২০২৪-২৬ সালের মধ্যে এসব মেগা (বড়) প্রকল্পের ঋণ পরিশোধে বড় ধাক্কা আসবে। দেশি-বিদেশি ঋণ পরিশোধের সময় এগিয়ে আসায় অর্থনীতির জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং অর্থমন্ত্রীকে দায়িত্ব নিয়ে উদ্যোগী হয়ে কাজ করা দরকার। কেননা প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন শেষ হচ্ছে না। ফলে এগুলো থেকে অর্থনীতিতে যে সুবিধা যোগ হওয়ার কথা, তা হচ্ছে না। এদিকে ঋণ পরিশোধের সময় ঘনিয়ে আসায় তা অর্থনীতির জন্য চাপ সৃষ্টি করবে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ নেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত সঠিক।
বৃহস্পতিবার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের কাছে এমন অভিমত ব্যক্ত করেন। ওয়েবিনারে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশের বৃহৎ ২০ মেগা প্রকল্প : প্রবণতা ও পরিস্থিতি’ শীর্ষক আলাপচারিতায় তিনি এসব কথা বলেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে বিদেশি দায়দেনা পরিশোধ করা হয় ১ দশমিক ১ শতাংশের মতো। ২০২৬ সাল নাগাদ তা দ্বিগুণ হতে পারে। এই হার ২ শতাংশে পৌঁছানোর আশঙ্কা আছে। তবে এতে কতটা ধাক্কা আসবে, তা নির্ভর করবে ওই সময়ে দেশের রিজার্ভ পরিস্থিতি কেমন থাকে এবং অর্থনীতি কতটা সুসংহত থাকে এর ওপর।’ তিনি আরও বলেন, ‘বড় প্রকল্পের ক্ষেত্রে রাশিয়া, চীন ও জাপানকেই বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে চীনের ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বেশ কম।’ তবে মেগা প্রকল্পগুলো নেওয়ার উদ্দেশ্য এবং উদ্যোগ দুটোই ঠিক ছিল বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। সেই সঙ্গে যে সুদে ঋণ নেওয়া হয়েছে, সেটিও সঠিক এবং ভালো উদ্যোগ ছিল। ফলে এটি একটি স্বস্তির জায়গা তৈরি করেছে। এসব মেগা প্রকল্পের মোট ৪৫টি ঋণ প্যাকেজের মধ্যে ৫টি হচ্ছে বৈদেশিক অনুদান। বাকি ৪০টির মধ্যে ৩৩টিই হচ্ছে সাশ্রয়ী রেটে বৈদেশিক ঋণ নেওয়া। ৫টি প্যাকেজের ঋণ বাণিজ্যিক (বেশি সুদের) ঋণ এবং ২টি হচ্ছে মধ্যবর্তী সাশ্রয়ী (অর্থাৎ সস্তাও নয়, আবার চড়া সুদও নয়) ঋণ। যেমন রাশিয়ার কাছ থেকে নেওয়া ঋণ। তিনি বলেন, মেগা ২০টি প্রকল্পের যে বৈদেশিক ঋণ আছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অংশ রাশিয়ার ৩৬ শতাংশ। জাপানের ৩৫ এবং চীনের ২১ শতাংশ। ২০২২-২৩ সালের মধ্যেই প্রায় ১৩টি প্রকল্পে লোন প্যাকেজের রেয়াতকাল শেষ হবে। এজন্য ২০২৪-২৬ সালের মধ্যে ঋণ পরিশোধের বড় চাপ আসবে। এক্ষেত্রে সবার আগে বেশি চাপ আসবে চীনের ঋণের ক্ষেত্রে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের পর্যালোচনা করা ২০ মেগা প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতু প্রকল্প। এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু এবং চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি রয়েছে। এসব প্রকল্পে প্রায় ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশ বিদেশি ঋণ। অর্থাৎ ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ আছে। দেবপ্রিয় আরও বলেন, ২০০৯ সাল থেকে বড় প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের জাতীয় ঐকমত্য দেখা গেছে। বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখা যায় বলে রাজনীতিবিদরা এতে আগ্রহ দেখান। তবে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মেগা প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। মেগা প্রকল্পের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, ২০টি মেগা প্রকল্পের মধ্যে ১১টিই সড়ক ও যোগাযোগ অবকাঠামোসংশ্লিষ্ট প্রকল্প। ৪টি রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির এবং ২টি করে প্রকল্প রয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের। এ থেকে বোঝা যায়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্ব কম ছিল। আলোচিত ২০টি প্রকল্প ২০২৮ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও চলতি দশকে সবকটি শেষ করা সম্ভব হবে না। প্রকল্প বাস্তবায়নে একধরনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব এবং দুর্নীতির মতো ঘটনা আছে। সরকারের উচিত এসব খুঁজে বের করে কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দেবপ্রিয় বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আইএমএফ-এর সঙ্গে আলোচনা শুরু করাটা একটি ভালো দিক। তিনি বলেন, ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) হোক বা সাড়ে চার বিলিয়ন (৪৫০ কোটি) ডলার হোক, আইএমএফ-এর কাছে অর্থ নেওয়ার প্রয়োজন আছে। এর ফলে মধ্য মেয়াদে অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করবে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তার পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারী ও উন্নয়ন সহযোগীরা একধরনের আস্থা পাবেন। তারা মনে করবেন, বাংলাদেশকে একধরনের পরিবীক্ষণ ও নজরদারিতে রাখছে আইএমএফ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, বর্তমান আর্থিক সংকট মোকাবিলায় সরকারি সব উদ্যাগই স্বল্পমেয়াদি। দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা বা উদ্যোগ নেই। সেই সঙ্গে মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে যোগ্য নীতি নেতৃত্বের প্রয়োজন।
সোর্স : যুগান্তর