আসিফ আরসালান
গত সপ্তাহে এই কলামে আমি বলেছিলাম যে লোড শেডিংয়ের কারণগুলো সাধারণভাবে জানা আছে। কিন্তু সেগুলোর পেছনে সমর্থন দেয়ার মত পরিমিত পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। এরপর এক সপ্তাহ গত হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। দেখা যাচ্ছে যে শুধুমাত্র বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেই ভয়াবহ সংকট নয়, সমগ্র অর্থনীতিই ভয়াবহ সংকটে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। এ সম্পর্কে স্থান সংকুলান হলে কিছু আলোচনা করবো। কিন্তু এরমধ্যে বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ কিছুটা কমলেও অন্যান্য দেশে বাড়তির দিকে। অন্যান্য দেশের অবস্থা জেনে হোক বা না জেনে হোক, গত ২৬ জুলাই ‘দৈনিক সমকালে’ একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরটির শিরোনাম, ‘চতুর্থ ডোজ নেয়ার হিড়িক’। খবরে বলা হয়েছে যে এক শ্রেণির প্রভাবশালী মানুষ প্রভাব খাটিয়ে টিকার চতুর্থ ডোজ নিচ্ছেন। বলা হয়েছে যে এরই মধ্যে রাজধানীর চারটি থেকে পাঁচটি সরকারি হাসপাতালের পরিচালক ও উপ পরিচালককে ম্যানেজ করে বর্তমান মন্ত্রী এমপি, সচিব, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও তাদের কয়েক হাজার স্বজন গোপনে চতুর্থ ডোজ নিয়েছেন। আরো বলা হয়েছে যে বুস্টার ডোজের জন্য বরাদ্দ ফাইজারের টিকা দিয়েই এপ্রিল মে মাসে গোপনে চতুর্থ ডোজের কার্যক্রম শুরু হয়। এখন প্রতিদিনই প্রভাবশালীরা টিকা কেন্দ্রে হাজির হচ্ছেন। বাধ্য হয়ে কর্মীরাও তাদেরকে টিকা দিচ্ছেন।
রিপোর্টে আরো বলা হয় যে ইসরাইলসহ কয়েকটি দেশ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের চতুর্থ ডোজ টিকা দিলেও বাংলাদেশ সরকার অফিসিয়ালি এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করেনি। বিষয়টি নাকি স্বাস্থ্য অধিদফতরের নজরে আনা হয়েছে। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয়নি। সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দিয়ে রিপোর্টে বলা হয়েছে যে রাজবাড়ী-২ আসনের এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ জিল্লুল হাকিম তার নির্বাচনী এলাকা থেকে চতুর্থ ডোজ টিকা নিয়েছেন। এই টিকা নেয়ার সংবাদ তিনি দৈনিক সমকালের কাছে স্বীকার করেছেন। তার মতে অনেক এমপি চতুর্থ ডোজ নিয়েছেন।
রিপোর্টে বলা হয়েছে যে রাজধানীর একাধিক টিকা কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর চার থেকে পাঁচটি সরকারি হাসপাতালে এসে এসব ব্যক্তি চতুর্থ ডোজ নিচ্ছেন। তৃতীয় ডোজ নেয়ার পর যাদের চার মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে সেই সব ব্যক্তিকে বেছে বেছে এই টিকা দেয়া হচ্ছে। তবে এই সব টিকা গ্রহীতাদের আলাদা কোনো তালিকা এখন পর্যন্ত করা হচ্ছে না। এদেরকে তৃতীয় ডোজের তালিকার সাথে যুক্ত করা হচ্ছে। ফলে এখন পর্যন্ত ঠিক কতজন মানুষ চতুর্থ ডোজ নিয়েছেন তার সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি।
বলা হয়েছে যে এ সম্পর্কে সরকারের আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না থাকায় চতুর্থ ডোজ গ্রহণকারীদের আলাদা কোনো তালিকা করা হচ্ছে না। বলা হয়েছে যে এপ্রিল মে মাসে গোপনে চতুর্থ ডোজ দেয়া শুরু হলেও এখন অনেকটা প্রকাশ্যে সেটি দেয়া হচ্ছে। টিকাদান কর্মীরা বলছেন যে পরিচালক ও উপ পরিচালকের রেফারেন্স নিয়ে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি আমাদের কাছে আসলে আমাদের করার কিছু থাকে না। প্রতিদিনই মন্ত্রী ও এমপিদের এই ধরনের আবদার মেটাতে হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, চতুর্থ ডোজ দেয়ার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো নির্দেশনা নাই। তবে বয়স্ক ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী কেন্দ্রে এলে আমরা না করছি না। কারণ আমাদের হাতে পর্যাপ্ত টিকা রয়েছে। তবে এটা দেখা হচ্ছে যে তৃতীয় ডোজ নেয়ার পর চার মাস পার হয়েছে কিনা। কেউ যদি কেন্দ্রে এসে টিকা নিতে চায়, আমরা তাকে দিচ্ছি। তবে ব্যাপকভাবে প্রচার করছি না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত শনিবার পর্যন্ত দেশে ১২ কোটি ৯৬ লাখ ৩৭ হাজার মানুষ প্রথম, ১২ কোটি ২ লাখ ৩৮ হাজার ৮২৪ জন দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার পেয়েছেন ৩ কোটি ৪১ লাখ ৩৬ হাজার ৯ জন। এখন পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যার ৭৬ দশমিক ১২ শতাংশ প্রথম, ৭০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ দ্বিতীয় ও ২০ শতাংশ মানুষ তৃতীয় ডোজ পেয়েছেন।
॥ দুই ॥
স্বাস্থ্য অধিদফতর বয়স্ক ও ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের চতুর্থ ডোজ দেয়ার মধ্যে আমরা কোনো অপরাধ খুঁজে পাই না। তবে যেহেতু সরকারের হাতে এখনও দেড় কোটিরও বেশি টিকা রয়েছে এবং এখন মানুষ টিকা নেয়ার জন্য আগের মত হামলে পড়ছেন না, তাই যদি একটা মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড সেট করে চতুর্থ ডোজ দেয়া হয় তাহলে সেটা মানুষের বৃহত্তর কল্যাণেই আসবে। তবে লুকোছাপা করে দেয়া অথবা প্রভাবশালীদের প্রভাবে দেয়াটা অন্যায় এবৎ অবিচার। যদি এমন হয় যে ৬০ বছর অথবা ৭০ বছর এবং তদূর্ধ্ব ব্যক্তিদের দেয়া হবে তাহলে সেটি জনগণের কাছে অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হবে।
এ ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছি। আমার আপন বোন ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে থাকে। আমার ছেলে মেয়েরা অস্ট্রেলিয়া থাকে। আপন ভাগ্নে ভাগ্নিরা কানাডা, সুইডেন, শেফিল্ড, গ্লাসগো, বার্লিন প্রভৃতি জায়গায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে যাদের আত্মীয় স্বজন বিদেশে বসবাস করেন তাদের সাথে বাংলাদেশে বসবাসকারী আত্মীয় স্বজনদের প্রতিদিন কথা হয়। হোয়াটস এ্যাপ, ইমো, ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার, ভাইবার প্রভৃতি সামাজিক মাধ্যমে এখন বিদেশের সাথে প্রতিদিন নিয়মিত কথা হয়। সুতরাং শুধু আমার আত্মীয় স্বজন নয়, আপনাদের আত্মীয় স্বজনদের নিকট থেকেও আপনারা খবর পাচ্ছেন যে ঐ সব দেশে অফিসিয়ালি চতুর্থ ডোজ দেয়া শুরু হয়েছে। আমি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, জার্মানি প্রভৃতি দেশের নাম। কানাডার কথাও আমি শুনেছি। তবে কনফার্ম করার সময় হয়নি। ঐসব দেশে শুধুমাত্র বয়স্কদের ক্ষেত্রেই নয়, ২৫ বছরের ঊর্ধ্বে যারা রয়েছেন তাদেরকে গণহারে চতুর্থ ডোজ দেয়া হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার কথা জানি। ফোন করলে সেখানকার প্যারামেডিক্সরা এসে টিকা দিয়ে যাচ্ছেন, অথবা আপনি নিজে গিয়ে টিকা দিয়ে আসতে পারছেন। এসব তথ্য আমার মত সাধারণ একজন সংবাদকর্মী যদি জানতে পারেন তাহলে সরকার তো দশানন এবং দশভূজা। তারা তো আমার চেয়ে হাজার গুন বেশি খবর রাখেন। তাই বলছি, দেড় কোটি টিকা অলস ফেলে রেখে লাভ কি? যারা চতুর্থ ডোজ নেয়ার উপযোগী হয়েছেন তাদেরকে দিয়ে দিন।
॥ তিন ॥
এখন আসছি বিদ্যুৎ সংকট তথা সামগ্রিক সংকট সম্পর্কে দুটো কথা বলতে। বিষয়টি আগেই বলেছি, টেকনিক্যাল এবং জটিল। কিন্তু গত ১ সপ্তাহে পলিটিশিয়ানরা এ ব্যাপারে কথা বলেছেন এবং বিশেষজ্ঞরা সংবাদ পত্রের কলামে অথবা সাক্ষাৎকারে তাদের মতামত দিয়েছেন। ব্যাপারটি খুব সহজভাবে বললে যা দাঁড়ায় তা হলো, দেশে বিদ্যুতের যে চাহিদা তার চেয়ে অনেক বেশি সক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। বলা হচ্ছে যে সংস্থাপিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হলো ২৫ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু আমাদের প্রয়োজন হলো ১৫ হাজার মেগাওয়াট। সাদা চোখে দেখতে গেলে এতে খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু ঘুষ, দুর্নীতি এবং টাকা পাচারের জন্য এখানে রাখা হয়েছে শুভঙ্করের ফাঁক। দেশে ২৪ টি রেন্টাল এবং কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। গত সপ্তাহেই বলেছি যে এসব রেন্টাল বিদ্যুৎ কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটিকে ইনডেমনিটি বা দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে। সোজা কথায়, আপনি বিনা টেন্ডারে কাদেরকে কত টাকায় এগুলো স্থাপন করতে দিলেন এবং তাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ আপনি কত টাকায় কিনছেন, সে সম্পর্কে আদালতেও কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। আরেকটি আতঙ্কের ব্যাপার হলো এই যে এদেরকে যদি বসিয়ে রাখা হয় তাহলে তাদেরকে জরিমানা দিতে হবে। অর্থাৎ তারা কোনো উৎপাদন করলো না, কেন তাদেরকে বসিয়ে রাখা হলো, সেজন্য তাদেরকে এই জরিমানা দিতে হবে। এটির নাম দেয়া হয়েছে ক্যাপাসিটি চার্জ। বর্তমান সরকার বিগত ১২ বছরে লক্ষাধিক কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে।
আজ লোড শেডিংয়ের কারণ দেখানো হচ্ছে এই যে দেশে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় তার ৫১ দশমিক ৯৭ শতাংশ উৎপাদন করা হয় গ্যাস থেকে এবং ২৭ দশমিক ২৫ শতাংশ উৎপাদন করা হয় ফার্নেস ওয়েল থেকে। অর্থাৎ শুধুমাত্র গ্যাস এবং তেল থেকে উৎপাদন করা হয় ৭৯ দশমিক ২২ শতাংশ বিদ্যুৎ। এখন গ্যাস বা তেলের দাম বিশ্ব বাজারে অনেক বেশি বেড়ে গেছে। ১০ ডলারের জ্বালানি এখন সিঙ্গাপুরের স্পট মার্কেট থেকে ৪০ ডলার দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এই রেটে কিনতে গেলে সরকারের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ বা বৈদেশিক মুদ্রা তহবিলের ওপর বিরাট চাপ পড়বে। ইতোমধ্যেই ৪৬ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নীচে নেমে গেছে। এসম্পর্কে আমাদের হাতে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। প্রয়োজন হলে বারান্তরে আলোচনা করা যাবে।
আরেকটি পয়েন্ট দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি। এই যে ৭৯ দশমিক ২২ শতাংশ, অর্থাৎ ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন নির্ভর করছে তেল এবং গ্যাসের ওপর। এজন্য এই ১২ বছরে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এই গ্যাস আমদানি করা হয়েছে এলএনজি বা লিকুইডিফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস হিসাবে। তারপর দেশে এনে টার্মিনাল থেকে গ্রিড লাইনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছেন যে, আমদানি খাতে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় না করে যদি দেশীয় কূপগুলো খনন করা হতো, অথবা সমুদ্রের তলদেশ থেকে গ্যাস আহরণ করা হতো তাহলে ঐ টাকার চেয়ে কম টাকা খরচ হতো। এর ফলে আমাদের গ্যাস আমদানি নির্ভরতা সম্পূর্ণ কমে যেত।
আমাদের চেয়ে বেশ কয়েক বছর পরে মিয়ানমার ভারতের সাথে সমুদ্র বিরোধ মিটিয়েছে। অতঃপর তারা সমুদ্র তলদেশ থেকে ইতোমধ্যেই গ্যাস আহরণ শুরু করেছে। আমরা তার কয়েক বছর আগেই সমুদ্র বিরোধ মিটিয়ে ফেলার পরেও কেন ঐ সমুদ্র সম্পদ আহরণ করার চেষ্টা করলাম না। কার স্বার্থে বসে থাকা হলো? কাদেরকে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্ট দেয়া হয়েছে? কাদেরকে গ্যাস ও তেল আমদানির সুযোগ দেয়া হয়েছে? এদের নাম জনগণের কাছে প্রকাশ করা হোক। যদি জনগণের কাছে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয় তাহলে দেখা যাবে, দেশের স্বার্থ কার্পেটের নীচে ঠেলে দিয়ে কাদেরকে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। সেটি করলে প্যান্ডোরার বাক্স উন্মোচিত হবে।
সোর্স: দৈনিক সংগ্রাম