নাছির উদ্দিন শোয়েব: মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনা এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রী নিহত হয়েছেন। শুক্রবার দুপুরের মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন পাঁচজন। এ ঘটনার চারদিন আগে গাজীপুরের শ্রীপুরে ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া শ্রমিক বহনকারী একটি বাসের পাঁচজন নিহত হয়। দু’টি ঘটনায়ই ঘটেছে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে। সারাদেশে এভাবে লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত থাকায় অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। গেটম্যান না থাকায় বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার এবং অটোি রিকশা উঠে যাচ্ছে লেভেল ক্রসিংয়ে। ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা। অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংগুলো যেনো মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন পরপরই এভাবে রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় ঝরছে প্রাণ।
রেলপথে গত সাত মাসে ছোট-বড় এক হাজার ৫২টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৭৮ জন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে এক হাজার ১৭০ জন। গতকাল শনিবার সেভ দ্য রোড এক প্রতিবেদন এ তথ্য জানিয়েছে। রেলপথে বেশির ভাগ দুর্ঘটনাই ঘটেছে গেটকিপারদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে বলে দাবি করেছেন সেভ দ্য রোড-এর মহাসচিব শান্তা ফারজানা।
সেভ দ্য রোড-এর চেয়ারম্যান জেড এম কামরুল আনাম, প্রতিষ্ঠাতা মোমিন মেহেদী, ভাইস চেয়ারম্যান বিকাশ রায়, জিয়াউর রহমান জিয়া, শওকত হোসেন এবং ঢাকা সাব এডিটরস কাউন্সিলের সহ-সভাপতি আনজুমান আরা শিল্পী স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে-রেলের দুই হাজার ৮৫৬টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে অবৈধ এক হাজার ৩৬১টি। সে হিসাবে প্রায় ৪৮ শতাংশ অবৈধ। এবং ৩৩টি ক্রসিং কে বা কারা ব্যবহার করছে, তা কেউ জানে না। এ ছাড়া বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোর মধ্যে ৬৩২টিতে গেটকিপার নেই। অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোয় যেমন গেটকিপার নেই, নেই কোনো সুরক্ষা সরঞ্জামও। এ ছাড়া বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়-১ থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত রেলপথ দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৬টি, আহত হয়েছে ৫২, নিহত হয়েছে ১৪ জন, ১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রেলপথ দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪১টি, আহত হয়েছে ১১১ জন, নিহত হয়েছে ২৭ জন, ১ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত রেলপথ দুর্ঘটনা ঘটেছে ২২২টি, আহত হয়েছে ১৮৬ জন, নিহত হয়েছে ৩১ জন, ১ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত রেলপথ দুর্ঘটনা ঘটেছে ১১২টি, আহত হয়েছে ১৬৬ জন, নিহত হয়েছে ৪২ জন; মে মাসে আহত ২২১ জন, নিহত হয়েছে ২৩ জন; দুর্ঘটনা ঘটেছে ২১২টি; জুন মাসে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৯৭টি; আহত হয়েছে ১৭২ জন, নিহত হয়েছে ১৭ জন এবং জুলাই মাসে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৪২টি, ঈদুল আযহার ঈদযাত্রাসহ বিভিন্ন ঘটনায় আহত হয়েছে ২৩২ জন, নিহত হয়েছে ২৪ জন।
জানা গেছে, দেশে এসব অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, কিন্তু তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বাস্তবায়নে নেওয়া হয় না কার্যকর পদক্ষেপ। অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন যাতে বাস্তবায়ন করা না হয় সেজন্যও চলে মোটা অঙ্কের লেনদেন। বিশ্লেষকদের মতে-কাজেই যোগ্য বক্তিদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের পাশাপাশি তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
রেলওয়ের তথ্যমতে, ২০২০ সালে ৯ জন, ২০১৯ সালে ২০ জন, ২০১৮ সালে ২৩ জন, ২০১৭ সালে ১৭ জন, ২০১৬ সালে ২২ জন, ২০১৫ সালে ১৭ জন ও ২০১৪ সালে ৩১ জন রেল ক্রসিংয়ে নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে গত বছর রেলক্রসিংয়ে ৩৩টি দুর্ঘটনায় ৭৪ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ২০২১ সালে ১২৩টি রেল দুর্ঘটনায় ১৪৭ জন নিহত ও ৩৯ জন আহত হয়েছে। ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশের রেলক্রসিংসমূহে ১১৬টি দুর্ঘটনায় ২১৯ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে চলতি বছরই রেলক্রসিংয়ে ৩৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৭৪ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গতকাল শনিবার রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে। বিবৃতিতে রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার কিছু কারণও তুলে ধরেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে রয়েছে- অননুমোদিত ও অবৈধ বিবেচনা করে বহু রেলক্রসিংয়ে গেটম্যান ও গেটবারের ব্যবস্থা না করা। বৈধ রেলক্রসিংসমূহে গেটম্যানদের দায়িত্বে অবহেলা এবং গেটম্যানের সংকট। যানবাহনের চালক ও সড়কে চলাচলকারীদের মধ্যে অসচেতনতা ও ধৈর্যের অভাব। দুর্ঘটনায় দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়া এবং রেলপথ ব্যবস্থাপনায় আইনের শাসনের অভাব। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন আরও জানিয়েছে, এই প্রতিবেদনে শুধুমাত্র রেলক্রসিংয়ে সংঘটিত দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে রেলট্র্যাকে বহু দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে, সেগুলো এই হিসাবে যুক্ত করা হয়নি।
প্রতিনিধিদের খবরে জানা যায়, নীলফামারি জেলায় প্রতিমাসেই মৃত্যু ঘটছে রেলক্রসিংয়ে। গত ১২মাসে ১৩জন মারা গেছে এই মরনফাঁদে। এ জেলায় ১২টি অরক্ষিত রেলক্রসিং থাকায় প্রতিনিয়ত ঘটছে দূর্ঘটনা। রেল আর সড়কের সংযোগস্থলকে বলা হয় লেভেল ক্রসিং। রেলওয়ের তথ্য বলছে, সারাদেশে এমন ৮২ শতাংশ ক্রসিংয়ে নেই গেটম্যান। নেই কোনো গেট কিংবা লোহার প্রতিবন্ধক। রেল পুলিশের কাছে ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল দুর্ঘটনার তথ্য পাওয়া যায়। এ ছয় বছরে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ১৭৫ জন। এর মধ্যে ১৪৫ জনই প্রাণ হারিয়েছেন রেলক্রসিংয়ে। সারাদেশের রেলক্রসিংয়ের অর্ধেকেরই অনুমোদন নেই। বৈধ দেড় হাজার রেল ক্রসিংয়ের অর্ধেকেরই নেই গেটম্যান। অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। ছয় মাসে শুধু গাজীপুরেই প্রাণ গেছে ৫০ জনের। যদিও সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়ে দায় এড়াচ্ছে রেল কৃর্তপক্ষ।
গাজীপুরের টঙ্গী থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু রেললাইনে কালিয়াকৈর, জয়দেবপুর থেকে শ্রীপুর এবং টঙ্গী থেকে কালিগঞ্জ পর্যন্ত অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ৩৫টি। সর্বশেষ গত ২৪ জুলাই গাজীপুরের শ্রীপুরে মাইজপাড়া ক্রসিংয়ে ট্রেনের সাথে শ্রমিকবাহী বাসের সংঘর্ষে মারা গেছেন চার জন। রেল লাইনের অরক্ষিত অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে ‘নিজ দায়িত্বে রাস্তা পার হোন’ এমন সাবধান বাণী দিয়ে দায় সেরেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এদিকে রাজশাহী-ভাটিয়াপাড়া-গোপালগঞ্জ রুটে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং ৩০টি। নেই গেট বা গেটম্যান, এমনকি নেই সতর্কতা সাইনবোর্ডও। ২০১৮ সালে চালু হওয়ার পর এ রুটে অন্তত ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২১ জুলাই কাশিয়ানীর কাগদী রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় নছিমনের যাত্রী ছয় নির্মাণ শ্রমিক নিহত হন।
সোর্স : দৈনিক সংগ্রাম