যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্স ২০১৮ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর ‘ওয়ার্ল্ড আলট্রা ওয়েলথ রিপোর্ট-২০১৮’ নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্য বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের তাবৎ বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলোর মানুষকেও অবাক করে দেয়। কেননা, অতি ধনী বা ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান সহ বিশ্বের ৭৫টি বড় বড় অর্থনীতির দেশকে পেছনে ফেলে দেয় বাংলাদেশ! এমনকি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ-এক্স নিজেরাও বিস্ময় প্রকাশ করে লিখে ‘অতি ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বিশ্বে চীনের অবস্থান এক নম্বরে নেই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবার চেয়ে এগিয়ে।’
ওয়েলথ-এক্স এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৭.৩ শতাংশ হারে অতি ধনীর সংখ্যা বাড়ছে। এমনকি দ্বিতীয় স্থানে থাকা চীনেও অতি ধনীর সংখ্যা বাড়ার হার বাংলাদেশ থেকে অনেক কম (১৩.৭ শতাংশ)!
তখন দেশ-বিদেশের সচেতন মহল বলতে থাকে যে, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট একটি ধনী শ্রেণি আরও ধনী হচ্ছে, আর গরিব আরও গরিব হচ্ছে। ফলে ধনী-দরিদ্র্যের মধ্যে বৈষম্যও দিন দিন বাড়ছে।
তাদের এমন দাবির যৌক্তিকতাও রয়েছে। কেননা ওয়েলথ-এক্স এর ওই রিপোর্টের কিছুদিন আগেই করা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানা আয়-ব্যয় জরিপ-২০১৬ অনুযায়ী, দেশে মোট আয়ের ৩৮ শতাংশই করেন উপরের দিকে থাকা ১০ শতাংশ ধনী। ২০১৬ সালের তথ্য নিয়ে করা ওই জরিপ থেকে জানা যায়, বিগত বছরগুলোতে সামগ্রিকভাবে দেশের দারিদ্র্য কমলেও দেশে মোট আয়ের মাত্র ১ শতাংশ করেন সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষ!
ওই জরিপ থেকে আরও জানা যায়, ২০১০ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে এসে দেশে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের আয় প্রায় ৫৭ শতাংশ বেড়ে মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৯৪১ টাকা।
অন্যদিকে, উক্ত সময়ে সবচেয়ে দরিদ্র ৫ শতাংশ পরিবারের আয় ৫৯ শতাংশ কমে মাসিক আয় দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭৩৩ টাকা!
২০১৮ সালে জানা গিয়েছিল, অতি ধনী তথা ধনকুবের বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। পরের বছরের শুরুতেই অর্থাৎ ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ওয়েলথ-এক্স প্রকাশিত ‘গ্লোবাল এইচএনডব্লিউ অ্যানালাইসিস : দ্য হাই নেট ওর্থ হ্যান্ডবুক’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘ধনী’ ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক থেকেও শীর্ষ তিন দেশের একটি হলো বাংলাদেশ।
১০ থেকে ৩০ লাখ মার্কিন ডলারের সম্পদের মালিককে ‘ধনী’র তালিকায় রেখে এবং ২০১৮ সালে সম্পদশালী বৃদ্ধির হার ও ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রক্ষেপণ ধরে হিসাব করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়- আগামী পাঁচ বছর বাংলাদেশে ধনী মানুষের সংখ্যা ১১.৪ শতাংশ হারে বাড়বে। যার ফলে, ধনী বৃদ্ধির হারে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে নাইজেরিয়া এবং মিশরের পরেই হবে বাংলাদেশের অবস্থান।
২০১৯ সালের শুরুতে এমন ‘সুখবর’টি জানা গেলেও এর কিছুদিন পর (২০১৯ সালের মে মাসে) জানা যায়, দেশে ২১.৮ শতাংশ মানুষ (৩ কোটি ৪৯ লাখ) অর্থাৎ এক পঞ্চমাংশেরও বেশি মানুষ দরিদ্র। অন্যদিকে, অতিদরিদ্র্য মানুষের হার ১. ৩ শতাংশ বা ১ কোটি ৮০ লাখ। ২০১৮ সালের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ওই তথ্য প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, দেশের মোট আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের মালিক উপরের দিকে থাকা ৩০ শতাংশ মানুষ। জরিপে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায়, দেশে বৈষম্য বেড়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই তখন প্রশ্ন উঠে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়লেও দারিদ্র্য সে হারে কেন কমছে না? এর জবাবে সে সময় এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছিলেন, ‘প্রবৃদ্ধি বাড়লেও মানুষের শ্রম আয় না বাড়লে দারিদ্র্যের হার সে হারে কমবে না। শ্রম আয় বাড়লে সাধারণত দারিদ্র্য কমে আসে। গত কয়েক বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি যে হারে বেড়েছে, শ্রম আয় সে হারে বাড়েনি। ফলে দারিদ্র্য কমার হার প্রত্যাশার চেয়ে কম।’
২০২০ সালের শুরুতেই করোনাভাইরাস হানা দেয় সারা বিশ্বে। বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও দফায় দফায় দেয়া হয় লকডাউন। ফলে অনেক কর্মজীবী মানুষ বেকার হয়ে পড়ে, গরিব হয়ে পড়ে আরও বেশি গরিব। গেল বছরের নভেম্বরে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি)
‘জীবিকা, খাপ খাইয়ে নেয়া ও উত্তরণে কোভিড-১৯-এর প্রভাব’ শীর্ষক যৌথ জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়- করোনাকালে বাংলাদেশে ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন।
২০২১ সালের শুরুতে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)- এর এক জরিপের বরাতে ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিবেদনে বলা হয়- দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ছিল ২০.৫ শতাংশ। সানেম-এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান সে সময় দেশে দরিদ্রের হার দ্বিগুণ হওয়ার বিষয়টি ‘উদ্বেগের’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
সমপ্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন সূত্রে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় যে, গত এক বছরে কোটিপতি আমানতকারী ৮ হাজারের বেশি বেড়ে ১ লাখ ১ হাজার ৯৭৬ জনে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ, দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে।
সুতরাং, একথা বলা যায় যে, করোনাকালে দেশে দরিদ্র্যের হার বাড়লেও ধনীরা আরও ধনী হয়েছেন। ধনীরা তাদের সব অর্থ যে, দেশেই রাখেন তা নয়। দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার খবর বিভিন্ন সময় প্রকাশিত হয়েছে।পাচারকৃত অর্থের সংখ্যাটি এত বড় যে, এসব অর্থের উৎস যে মূলত দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত তা নিয়ে কারও মনেই তেমন কোনো সন্দেহ নেই।
গেল বছর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনের বরাতে মানবজমিন জানায়, কেবল ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ মাত্র ৬ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। সে হিসাবে গড়ে প্রতিবছর দেশ থেকে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘পাচারের অর্থের সংখ্যাটি বড়। এসব অর্থের উৎস মূলত দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত হয়।’ তবে, ‘পাচারের ক্ষেত্রে দেশের সার্বিক অবস্থা বিশেষ করে নিজের নিরাপত্তা, পরবর্তী প্রজন্মের নিরাপত্তা, সম্পদের নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ’ এবং ‘বাংলাদেশ থেকে টাকা সরানো এখন কঠিন কিছু নয়’ বলেও তিনি মন্তব্য করেছিলেন।
অন্যদিকে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছিলেন, ‘পাচার হওয়া অর্থের একটি আংশিক চিত্র দিয়েছে জিএফআই। প্রতিবছরই নানা কায়দায় অর্থ পাচার বাড়ছে। যারা অর্থ পাচার করছেন, তারা আর্থিক, রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিকভাবে অনেক প্রভাবশালী। তাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। সদিচ্ছার ঘাটতি, স্বচ্ছতা ও দৃঢ়তার ঘাটতি অর্থ পাচার প্রতিরোধে ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।’