পঞ্চদশ শতকে আরব ব্যবসায়ীরা ভারতের সামুদ্রিক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিলেন আর দেদারসে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই সময় ভারতসহ পৃথিবীর যত জল ও স্থলপথ আছে, সবই ছিল আরবদের হাতে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে তারা খুবই লাভবান হতেন।
কিন্তু ষোড়শ শতকে এসে চিত্র পালটে যায়। ভাস্কো দা গামা (১৪৬০ – ১৫২৪) ইউরোপ ও ভারতের মাঝখানে জলপথ আবিষ্কার করেন। এরপর পর্তুগিজরা দলে দলে ভারতীয় অঞ্চলে ছুটে এলো। ধীরে ধীরে তারা ভারতের বেশিরভাগ সমুদ্র বন্দর দখল করে ফেলল, এবং মুসলমানদের ওইসব অঞ্চলে বাণিজ্য করা নিষিদ্ধ করল।
ওই সময় ভারতীয় অঞ্চলের মশলাপাতি বহির্বিশ্বে চড়ামূল্যে বিক্রি হতো। পর্তুগিজরা জাহাজ ভরে ভরে গোলমরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গ ইত্যাদির মতো দামি মশলা নিয়ে যেতে লাগল। আর মুসলমানদের জন্য স্রেফ সুপারি আর নারকেলের মতো কমদামি জিনিস রেখে যেত।
মুসলমানরা কেবল সেসব জিনিসেরই ব্যবসা করতে পারত, পর্তুগিজদের যেসবের প্রয়োজন ছিল না। সবধরনের লাভজনক জিনিসপত্র পর্তুগিজরা তাদের দখলে নিয়ে গিয়েছিল।
এরকমভাবে মালাকা, দানাসিরি ইত্যাদি স্থলপথও আরবদের জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল। এমনকি নিরাপত্তা ও অনুমতিপত্র ছাড়া কেউ এসব এলাকায় সমুদ্র সফরও করতে পারত না। মুসলমানদের ছোটখাটো ব্যবসাও পর্তুগিজদের জাহাজ ব্যবহার করে করতে হতো, স্বাধীনভাবে নিজের জাহাজ ব্যবহারেরও অনুমোদন ছিল না।
মুসলমান ব্যবসায়ীদের যখন স্বর্ণযুগ ছিল, তখন এইসব অঞ্চলে ইসলামের প্রচার-প্রসারও অনেক বেশি হয়েছিল। বিশেষত বন্দর এলাকাগুলো ছিল দাওয়াতি কাজের কেন্দ্রভূমি।
পর্তুগিজরা যখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্ত ক্ষেত্র দখল করে নেয়, তখন সব কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। ইসলাম প্রচারের কাজও থেমে যায়। ইতিহাস হতে হতেও শেষতক গতিপথ পালটে যায়।
মুসলমানদের ওপর পর্তুগিজদের জয়ী হওয়ার রহস্য কী ছিল? তার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল মুসলমানদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, কোনো ধরনের একতা ছিল না,। অন্যদিকে পর্তুগিজরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সব কাজ করত। বিখ্যাত পর্যটক জায়নুদ্দিন বলেন : পর্তুগিজরা বড় হুঁশিয়ার ছিল। নিজেদের স্বার্থরক্ষায় তারা দক্ষ ছিল।
প্রয়োজনে তারা শত্রুকেও খোশামুদ করতে পিছপা হতো না। তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ ছিল, সর্দার যা বলত বিনা বাক্য ব্যয়ে সবাই মেনে নিত। নিজেদের দেশ থেকে দূরে থাকায় তারা কখনো নিজেদের মধ্য ঝামেলায় জড়াত না, আজ পর্যন্ত শুনিনি পর্তুগিজরা ক্ষমতার লোভে নিজেদের কোনো বড় ব্যক্তিত্বকে হত্যা করেছে।
একারণেই তারা সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় রাজাদের নিজেদের বশীভূত করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে মুসলমানদের মধ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই থাকত। তাদের মধ্যে ক্ষমতার লোভ খুব ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে গেছিল, প্রায় নিজেদের সর্দারদের হত্যা করত, কোনো স্থিতিশীলতা ও ঐক্য ছিল না।
ইতিহাস সাক্ষ্য, অমুসলিমদের আগ্রাসনের কারণে মুসলমানরা যতটা না ক্ষতির মুখে পড়েছে, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে নিজেদের দ্বন্দ্বের কারণে তারচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই; সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন করো আর আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।’ (সুরা হুজরাত, আয়াত ১০)।
হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: মুসলমান মুসলমানের ভাই। তাই তোমরা পরস্পরকে হিংসা কোরো না, ঈর্ষান্বিত হয়ো না, কারও পেছনে লাগবে না; এবং তোমরা এক আল্লাহর দাস হয়ে যাও এবং হয়ে যাও একে অপরের ভাই।’ (বুখারি, হাদিস নং ৫৬৩৮)।