ইমাম হোসাইন রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু সম্মন্ধে পয়লা কথা হলো যে, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দুই নাতিকে অত্যধিক ভালোবাসতেন। আপনারা জানেন যে, তাঁরা তাঁকে ঘোড়া বানিয়ে পিঠে চড়ে বসতো, তিনি তাদেরকে ঘাড়ে-গলায় চুমু দিতেন, তর্ক ও করেছেন দুষ্টু-মিষ্টি খুনসুটির মাধ্যমে। এই যে এতো ভালোবাসার সম্পর্ক। এতোটাই তীব্র যে আল্লাহর রাসূল(সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হাসান-হোসাইনকে ভালোবাসলো, সে আমাকে ভালোবাসলো।’ আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বি’আল্লাহু আনহু বলেছেন, “তারা হচ্ছে জান্নাতে বেহেশতী যুবকদের নেতা।”
আল্লাহর প্রিয় হাবীব মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৌহিত্র, আলী (রাঃ) এবং মা ফাতেমা(রাঃ) এর আদরের পুত্রসন্তান ইমাম হোসাইন (রাঃ)। তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে রাসূল (সাঃ) যেসব ইংগিত দিয়েছেন, তিনি যেভাবে জীবন দিলেন, এর মাঝে আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ রয়েছে। যদিও এর প্রকৃত ইতিহাস নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে, তবুও এ ঘটনা আমাদের জন্য শিক্ষাবহুল ও তাৎপর্যপূর্ণ।
একটি সমাজ, রাষ্ট্রের ব্যাপারে আল্লাহর রাসূলের(সাঃ) যে দিগদর্শন, কোরআন মাজীদে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা একটি ইসলামী সমাজ এবং রাষ্ট্রের যে দর্শন উল্লেখ করেছেন, রাসূল(সাঃ) এবং খোলাফায়ে রাশেদীন খেলাফতের যে সিস্টেম চালু করে করেছেন- ইয়াজীদের শাসনক্ষমতা গ্রহণ এবং বাইয়াত নিতে বাধ্য করবার নীতির মাধ্যমে, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রকৃত ধারণা থেকে বিচ্যুত হয়ে বিকৃত চিন্তাধারার জন্ম দেয়া হচ্ছিলো । এই বিকৃত ধ্যান ধারণা প্রতিরোধ করাটাকে ইমাম হোসাইন (রাঃ) নিজস্ব দায়িত্ব মনে করেছিলেন । কেননা আল্লাহ প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে ইসলামী রাষ্ট্রের খিলাফত নির্বাচিত হবে।
খোলাফায়ে রাশেদীনের জীবনী পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, তাদের কেউ নিজেকে নিজে খলীফা হিসেবে ঘোষণা করে খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেননি । কখনো কেবলমাত্র একজন ব্যক্তির কথায় খলীফা মনোনীত করা হয়নি । কোন খলীফা তার সন্তানকে পরবর্তী খলীফা নিযুক্ত করেননি । এমনকি রাসূল(সাঃ) স্বয়ং আবু বকর (রাঃ) কে খলীফা হিসেবে নির্বাচিত করে যাননি । একটি পরামর্শ সভা হলো, শূরা গঠন করা হলো এবং তারা আবু বকর রাদ্বি’আল্লাহু আনহুকে খলীফা হিসেবে নির্বাচিত করা হয়।
এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য নবীজি (সাঃ) এর দাফন পর্যন্ত বিলম্বিত করা হয় । অর্থাৎ নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে অথবা স্বীয় বংশের কাউকে খলীফা হিসেবে নিযুক্ত করার কোন বিধান ইসলামী ইতিহাস সমর্থন করে না । এটা রাসূল(সাঃ) এর আদর্শের অনুসৃত পথ নয়। ইমাম হোসাইন (রাঃ) বুঝতে পেরেছিলেন যে, ইয়াজিদ যেভাবে নিজেকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলো তা কোনোভাবেই রাসূল(সাঃ) এর দেখানো পন্থা নয় ।
রাষ্ট্র এবং সমাজ গঠনে ইসলামের যে কর্মপন্থা, সেই মূল চিন্তা থেকে বিকৃত পন্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে, যদি তার প্রতিরোধ না করা হয় । তাই তিনি জোর তাগিদ অনুভব করেছিলেন যে, এই ব্যাপারটি স্পষ্ট না করা হলে, এই বিকৃত পন্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে ইসলামী খিলাফতের নিয়ম হিসেবে। কেননা এটি যদি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় ইমাম হোসাইন রাঃ জীবিত থাকাকালীন এবং তিনি এর প্রতিবাদস্বরূপ কিছু না করেন, তাহলে পরবর্তীতে যুগ যুগ ধরে গোটা উম্মাহ এ ভুল ম্যাসেজ পেয়ে যাবে যে, ইমাম হোসাইন বেঁচে থাকতে ই তো এটি স্ট্যাবলিশ হয়ে গিয়েছিলো, ফলে হয়তো এটি জায়েজ ।
মুলুকিয়াত বা রাজতন্ত্র যে গ্রহণযোগ্য নয়, রাজার ছেলে রাজা হবে, পরামর্শ ছাড়া যাকে ইচ্ছা ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া হবে(যাকে ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচারী বলে), অত্যাচারী শাসকের ক্ষমতায় যাবার এই প্রক্রিয়া রুদ্ধ করা কে নিজের দায়িত্ব মনে করে ইমাম হোসাইন(রাঃ) জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রওয়ানা হয়েছিলেন ।
আমি অবাক হই! অনেক স্কলারেরা বলে থাকেন, তিনি মদীনা থেকে গভীর রাত্রে কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে চলে গিয়েছিলেন! কিন্তু এটি বিন্দুমাত্র ও সত্য নয়। অনেক আলোচনার পর তিনি মদীনায় থেকে বাইয়াত নিতে চান নি, পরবর্তীতে মক্কায় উমরাহ করেন এবং তারপর তিনি কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।
প্রথম শিক্ষা হচ্ছে,
তিনি নিজে নেতা হওয়ার জন্য এই শাহাদাতের মুখোমুখি হননি। তিনি ইসলামী সমাজ, সভ্যতা, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসৃত পন্থাকে বিকৃত হতে দিতে চাননি। ইতিহাসের কাছে যেন তিনি দায়ী না হয়ে যান, সেই দায় থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যই তিনি নিজে অন্যায়ের সামনে মাথা নত না করে শক্ত হয়ে দাঁড়াবার জন্যই তিনি রওনা হয়েছিলেন.
দ্বিতীয় শিক্ষা হচ্ছে যে. তিনি যখন গেলেন পথিমধ্যে তাকে আটকে দেওয়া হলো. ইমাম হোসাইন (রাঃ) ক্ষমতার জন্য কুফায় রওয়ানা হয়েছিলেন.। ইয়াজিদ খবর পেল এবং আব্দুল্লাহ বিন যিয়াদ কে পাঠালো তার কাছে বলা হলো একদিন সময় দেয়া হলো আপনি বাইয়াত গ্রহণ করবেন, না মৃত্যুর জন্য ফায়সালা গ্রহণ করবেন. তিনি তাঁর পরিবার-পরিজন কে সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন। উনি তার পরিবারকে এই মেসেজগুলো দিলেন।
এটা বলতে গেলে আমাদের শহীদ নেতৃবৃন্দের কথা মনে আসে। যারা আমাদের নেতৃবৃন্দ শহীদ হয়েছেন তারা ফাঁসির রাতে পরিবারের সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করে তারা যে সব কথা বলে গেছেন একদম চেতনার সঙ্গে যেন একই মিল। তাঁর স্ত্রী পরিবার-পরিজনকে হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলছেন যে, আমার প্রতি মেসেজ এসেছে, তোমাদের সকলের মতামত কি? ওই ছোট্ট শিশু, মহিলা সকলে মিলে কেউ দ্বিমত করেননি সবাই হযরত ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর সেই কনসেপশন কে মেনে নিয়ে বলেছেন। আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শের বাহিরে কোন কিছু মেনে নিতে পারিনা। আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত আছি।
খালিদ, নিজামী ভাইয়ের ছেলে; তার পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসে লেখার মাধ্যমে যে বর্ণনাটি প্রকাশ করেছেন সেটি ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।
“আমি ডাক্তার হিসেবে অনেক বড় মানুষের মৃত্যুর সময় কাছে থেকেছি। কাছে থেকেও মৃত্যুর দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়েছে। মৃত্যুর মুহূর্তে এসে কত অস্থির হয়ে যায় বাঁচার জন্য কত আকুতি মিনতি করে বাঁচার চেষ্টা সেটা আমি আমার পিতার মধ্যে কখনো দেখি নাই। আমার পিতা ফাঁসির মঞ্চে যাবেন তার চেহারার মধ্যে এই ধরনের কোন আলামত লক্ষ্য করি নাই। তিনি বলছেন যে আমি কোন লেবাস পড়ে ফাঁসির মঞ্চে যাব তোমরা বলে দাও। প্রশান্ত হৃদয়ে তিনি আমাদেরকে বলতে বলছেন যে ‘কোন লেবাস পড়ে আমি ফাঁসির মঞ্চে যাব। লুঙ্গি পরা থাকবে না পায়জামা পরা থাকবে। জানাজা কে যাবে তোমার মা যেন না যায় আমার কথাই আমার কবর কোথায় হবে।
মনে হচ্ছে বিষয়টা ব্যাপার না; একটি নরমাল জিনিস । নরমাল জীবনে যেমন মানুষ সাধারণত কনভারসেশন করে সেভাবেই যেন তিনি কনভারসেশন করছেন। মুজাহিদ ভাই কথা বলেছেন তাঁর পরিবারের সাথে, কামরুজ্জামান ভাই বলেছেন। আমাদের নেতৃবৃন্দ এভাবে কথা বলেছেন তার পরিবারের সঙ্গে, বিদায়ী সাক্ষাৎকারে।
ফাঁসির মঞ্চে মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু আমাদের শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই ছুটছেন ফাঁসির মঞ্চের দিকে। কারারক্ষীরা বলছেন যে, কাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কথা, ধরে নিয়ে যাওয়া লাগে ফাঁসির মঞ্চে। কিন্তু আব্দুল কাদের মোল্লা ভাই ছুটছেন সবার আগে, উনাকে কারারক্ষীরা তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিল না। যেন আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করার তর সইছে না…
ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এবং তার গোটা পরিবার ঐক্যমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন সিদ্ধান্ত নিলেন যে আমরা ইসলামের মৌলিক নীতিমালা থেকে বিচ্যুত হতে পারি না। উম্মত চিরজীবনের জন্য বিভ্রান্ত হবে। তাই আমরা মাথা নত করব না। হয় আমাদের কথা মানতে হবে না হয় আমরা শাহাদতের ফয়সালা করলাম। আলহামদুলিল্লাহ! এটি হচ্ছে দ্বিতীয় ম্যাসেজ। ইসলামের মৌলিক নীতিমালা একটি আদর্শিক বিষয় সেটার রক্ষা করা জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান; ইমাম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু কারবালার প্রান্তরে জীবন দিয়ে সেটি প্রমাণ করে গেছেন।
আমরাও ফ্যাসিবাদী শাসকের অধীনে আজ অত্যাচারিত মজলুম , জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে যারা ক্ষমতায় আসে তারাও তো সেই ইয়াজিদের আদর্শের অনুসারী। যারা জনগণের কথার তোয়াক্কা না করে ভোটাধিকারের তোয়াক্কা না করে আমার ছেলের উপরেই খেলাফত হবে। এটার নামই হচ্ছে কিন্তু মুলুকিয়াত ফ্যাসিবাদ জবরদস্তি করে ক্ষমতায় যাওয়া।
রাসূল ইমাম হাসান হোসাইনকে ভালোবেসেছেন, তাদেরকে জান্নাতী বলেছেন। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) রাসূলের বর্ণনা থেকে রেওয়ায়েত করেছেন, সাইয়্যিদুস শাবাব ইয়া আহলিল জান্নাহ। জান্নাতে যুবকদের সর্দার হবেন। ফলে আল্লাহর নবীর এই সাহাবী ও দৌহিত্র যে জান্নাতী তা নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। ফলে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন সেটি অবশ্যই সঠিক।
যেটা মানুষের মধ্যে ধারণা বা আজকে আমাদের মধ্যে যে ধারণা একটা স্যেকুলার ধারণা, নামাজ রোজা হজ জাকাত করো, সদক্বা, ফিতরা দাও, ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম পালন করো- এটা ইসলাম। কিন্তু হযরত ইমাম হুসাইন সেটাও রক্ত দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, না ওটা ইসলাম নয়। তাহলে আল্লাহর নবীর এই প্রিয় সাহাবী দৌহিত্র মদিনায় পৌঁছে তসবি তাহলীল করে আদর্শ এবং উন্নত মানের জীবন যাপন করতে পারতেন। দুনিয়ার এত আরামের জায়গা ছেড়ে দিয়ে তিনি কেন শাহাদাতের পথ বেছে নিলেন। তিনি বুঝিয়ে দিলেন এটি ই শুধু ইসলাম নয়, রাষ্ট্রে আল্লাহর দ্বীন কায়েম করতে হবে। রাষ্ট্রের মাঝে কোরআনের বিধান, খেলাফতে রাশেদার বিধান এবং খেলাফতের সর্বোচ্চ অর্জনকে তুলে ধরে জাতির নিরাপত্তা এবং মুক্তির জন্য আদর্শ সমাজ গড়তে হবে। এটাও ইসলাম, এটাই হচ্ছে আসল ইসলাম।
যে ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-আকিমুদ্দিন ওয়ালা তাফাররাকু “দ্বীন কায়েম করো এবং তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ো না।”
দ্বীন কায়েমের যে ফরজিয়াত, ইকামতে দ্বীন এর যে গুরুত্ব তা ইমাম হোসাইন উপলব্ধি করেছিলেন বলেই তিনি কিন্তু এই পথকে বেছে নিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মপালন যদি ইসলাম হত তাহলে ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এই ঝুঁকি নিতে যেতেন না। উনার কথা না হয় বাদই দিলাম। আল্লাহর প্রিয় নবী ই তো এ পথে যেতে না। এবং মসজিদে হারামে আল্লাহ- জিকির -আজকার -তাহাজ্জুদে রত থাকলে কেউ বাধা দিতো না। কাফেররা তো বলেই ছিলো যে তোমরা এসব করো। রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে তুমি এসো না । কিন্তু তাতো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শের সঙ্গে কন্ট্রাডিকশন করেছিল।
এটার মাঝে তৃতীয় শিক্ষা আছে যে, যারা মুসলিম সমাজের মধ্যে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করেন রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই আশুরা আমাদেরকে এই শিক্ষা দিচ্ছে। কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস আমাদের এই শিক্ষা দিচ্ছে যে, ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মপালন-ই ইসলাম নয়। ইসলাম হচ্ছে পরিপূর্ণ এবং ভারসাম্যপূর্ণ একটি জীবন ব্যবস্থা।
আল কোরআনে বলেছেন, আকমালতু লাকুম দিনুকুম এটা একটা পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। ‘নেজামে মোকাম্মেলে হায়াত’। এটা পরিপূর্ণ সমাজ রাষ্ট্র অর্থনীতি-ব্যবসা, বিচার, শিক্ষাব্যবস্থা, পারিবারিক ব্যাবস্থা সব বিষয়ে জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে। সকল বিষয়ে হচ্ছে পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা করে আল্লাহতা’লা দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে ইসলাম পালন করেই যদি মনে করেন যে, জান্নাতে চলে যাবেন এর থেকে বড় বিভ্রান্ত আর কিছু হতে পারে না, এটি ভাবারও কোনো সুযোগ নেই।আল্লাহ তাআলা তো কুরআনে বলেছেন,
اَفَتُؤْمِنُوْنَ بِبَعْضِ الْكِتٰبِ وَ تَكْفُرُوْنَ بِبَعْضٍۚ
“তোমরা কি আমার কিতাবের কিছু অংশ পড়বে আর কিছু অংশ ছেড়ে দিবে। তোমরা কি কিছু অংশ কে অস্বীকার করবে।” (২ঃ৮৫)
পক্ষান্তরে কোরআনকে না মানার-ই নামান্তর ঘরের মধ্যে ইসলাম থাকবে, আর রাষ্ট্রব্যবস্থায় শয়তান দুষ্কৃতী বাতিল শক্তি আধিপত্য করবে, রব বানিয়ে আমরা আনুগত্য করব। ইমাম হুসাইন রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর শাহাদাত আমাদের কি শিক্ষা দিচ্ছে? তিনি এটা মোটেও বরদাস্ত করেন নি, তা তাঁর জীবন দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন। ইসলাম ব্যক্তিগত পর্যায়ে রেখে দিতে হবে, এটা ইসলাম নয়। ইসলাম সমাজজীবন এবং ব্যক্তি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্যই এসেছে।
لِیُظْهِرَهٗعَلَى الدِّیْنِ كُلِّهٖ
কথার মানে কি? আর যত দ্বীন, আর যত মতবাদ, আর যত আইডোলজি আছে তার উপরই এই দ্বীনকে প্রচার করো, জাহির করো। ইমাম সেটা প্রচার প্রচার করার জন্যই জীবন দিয়েছিলেন।
আরেকটা কথা বলি। সেটা হচ্ছে শাহাদাতের তামান্না। এটা সবথেকে বড় শিক্ষা যে জীবনের মায়া তিনি করেননি। পরিবার, সন্তান দিয়ে কি হবে আমার বেঁচে থাকলে এই দুনিয়ার লোভ-লালসা, মায়া-মমতা স্ত্রী-সন্তান, পিতা-মাতা, ভাই-বোন নিয়ে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনের জীবন কার না ভালো লাগে। কিন্তু সবকিছু তাঁর কাছে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। ইসলামী আন্দোলন: জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবির আমাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে শাহাদাতের তামান্না, শাহাদাতের তামান্না এবং থেকে শিক্ষা পাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ইমাম হোসাইন কারবালার ময়দানে রক্ত দিয়ে শাহাদতের যে আকাঙ্ক্ষা উম্মতের জন্য হাদিয়া করে গেছেন। আমরা তাঁরই সার্থক,তাঁরই উত্তরসূরী।
আমি বিশ্বাস করি আমরা যে জমিনে জন্মগ্রহণ করেছি আমার বিশ্বাস হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের বাংলাদেশ আল্লাহর দ্বীন বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হোক এটাই আমরা কামনা করি । ফ্যাসিবাদী অত্যাচারী শাসক, রাষ্ট্রক্ষমতা, পুলিশ, রাজনীতি, মিডিয়া প্রশাসনকে ব্যবহার করে মুসলমানদের এই চিন্তা চেতনা এবং ইনসাফ ভিত্তিক দেশ প্রতিষ্ঠায় বাধা দিতে চায় তারা। আমাদের জয় হবেই। তাদের শাস্তি দুনিয়াতেও হবে এবং আখেরাতেও হবে।
ইয়াজিদ নাম কেউ রাখেনা মীরজাফর নামও কেউ রাখেনা, শাস্তি দুনিয়াতে হয়ে গেছে। যে গালে যে ঠোঁটে, যে গলায় আল্লাহর প্রিয় নবি চুমু খেয়েছেন; ইবন যিয়াদ সেই মস্তিষ্ক খন্ডিত করে ইয়াযীদের সামনে রাখলো আর লাঠি দিয়ে সেই খন্ডিত মস্তিষ্কে আঘাত করে যে নিষ্ঠুরতার ইতিহাস তৈরি করা হয়েছে। আমি মনে করি যারা আল্লাহর দ্বীনের পথে কাজ করা মানুষদেরকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করে, শহীদ করে, হাত খন্ড করে দ্বীন কায়েমের পথে বাধাগ্রস্ত করতে চাচ্ছে, তাদের এই অত্যাচারের হাত বন্ধ না হলে তাদের এই করুণ পরিণতি অপমান লাঞ্ছনা ভোগ করতে হবে আখেরাতেও তারা ভোগ করবে।
ফলে আমরা মনে করি আমাদের এই স্বপ্ন, আমাদের এই মিশন, আমাদের কাফেলা, আমাদের এই অভিযাত্রা কেউ রুখতে পারবে না। এটা একটা অপ্রতিরোধ্য কাফেলা। আমাদের এই চেতনাকে কখনো রুখে দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের এই চেতনার মতে মৃত্যুর কোন ভয় নাই। কারণ যারা পূর্বসূরী আমাদের, তারা মৃত্যুকে ভয় পায় নি। তাদের উত্তরসূরী হিসেবে আমরা কখনো মৃত্যুকে ভয় পাবো না। তারা আদর্শের জন্য জীবন দিয়েছে আমরাও আমাদের আদর্শের জন্য জীবন দেব। এই আশুরার শিক্ষা, মহররমের শিক্ষার অর্থই হলো অত্যাচারী ফ্যাসিবাদী জালিম এর সামনে মাথা নত না করা এবং খেলাফতে রাশেদার জন্য যে শাসন সেটার ভিত্তিতে সমাজ এবং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য জীবন দেওয়া, ইসলামকে ব্যক্তিগত জীবনে চাপিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্যেকুলার বা অন্য কোনো ধারণা কে প্রতিষ্ঠা করে ডেমোক্রেসি সমাজতন্ত্র পুঁজিবাদীর দিকে ঝুঁকে যাবে তারাও যে তাদের উত্তরসূরি এটাও মহরমের একটি শিক্ষা।
আজকে জামায়াতে ইসলামী আলহামদুলিল্লাহ শাহাদাতের সিঁড়ি বেয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।আমাদেরকে রক্ত আরো দিতে হবে আল্লামা ইকবাল তো এটাই বলেছেন,“ইসলাম জিন্দা হোতা হে হার কারবালা কি বাদ” ‘ প্রতিটি কারবালার পরেই ইসলাম আবার জিন্দা হয় । ’
আমরা সেই কারণের জন্যই কারবালার হোসাইন হতে রাজি আছি। রক্তাক্ত একটি জমিনের মধ্য দিয়ে যদি ইসলাম জিন্দা হয় তাহলে আমরা সেই রক্ত দিতে রাজি আছি। আমরা সেই দিনের জন্য প্রস্তুত আছি। ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’র এই অন্ধকার দূরীভূত হবে। আমাদের সফলতা এবং সম্ভাবনার সেই সকাল আমাদের সামনে আবার উদিত হবে। কারবালার এই শিক্ষা থেকে আমাদের সুসংগঠিত হয়ে আদর্শের সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। বাতিলের সাথে আপোষ করা কখনো কারবালার শিক্ষা নয়। আদর্শের জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।
আমার জীবনকে তুচ্ছ মনে করে ঈমানকে বড় মনে করা- এটাই আমাদের শিক্ষা। আমাদের কদম যেন দূর্বল না হয়ে যায়। আমরা যেন বিচলিত না হই। আমাদের ঈমান, সবর এবং তাওয়াককুল এর উপর থেকে, আল্লাহ তা’আলার দ্বীনের উপর থেকে আল্লাহর কাছে ফিরে যাওয়ার তাওফিক এবং নসীব যেনো দান করেন। আমীন।
লেখক : সেক্রেটারি জেনারেল, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী