আমি ৮০ বছর বয়স পার করেছি। এই দীর্ঘ জীবনে নিজের অনেক অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি হয়েছে। সেসব উপলব্ধি থেকে কিছু এটা পাঠকদেরকে অবিহিত করছি, যাতে তারা চিন্তার খোরাক পেতে পারেন। সব সময় আমি সংযত চিন্তা করেছি। গভীরভাবে ভেবেছি। কারণ সেই হিসেবে আমার উপলব্ধি হয়েছে যা পাঠকদের জন্য উপকারী হতে পারে। একে একে আমার পনেরোটি উপলব্ধি নিম্নে উপস্থাপন করছি।
১. কাউকে যোগ্য লোক হতে হলে তার উচিত গুরুত্বপূর্ণ অনেক বই পড়া। এসব বই হতে পারে ইসলামের ওপর এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ের ওপর। গণ্যমান্য লেখকের বই বাছাই করা উচিত। কারণ সব লেখকের উপলব্ধি সমান হয় না। যারা সিনিয়র লেখক, তারা অনেক চিন্তা করে লিখে থাকেন।
২. ইসলামের জন্য কাজ করতে হলে পবিত্র কুরআনের অর্থ প্রতি বছর অন্তত একবার পড়া উচিত। কুরআনের সাথে গভীর সংযোগ ছাড়া ইসলামের মহৎ কর্মী হওয়া সম্ভব নয়। কুরআন শরিফ অসাধারণ গ্রন্থ। এতে রয়েছে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে বা তাওহিদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা; নৈতিকতা সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা; শিরকের বিরুদ্ধে যুক্তি এবং অনৈতিকতার বিরুদ্ধে বড় শাস্তির ঘোষণা।
৩. ইসলামের জন্য যোগ্য লোক তৈরি করা জরুরি। এ জন্য সিনিয়র লোকদের উচিত ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ক্লাস করা। একেকটি ক্লাসে ১৫-২০ জন থাকতে পারে। এই কোর্স এক বা দুই বছরের জন্য হতে পারে। নিজে এ রকম ১০টি কোর্স করেছি। এসব কোর্স কুরআনভিত্তিক ও উন্নত ইসলামী সাহিত্যভিত্তিক হতে হবে।
৪. নারীদের সব সময় খুব গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছাড়া ইসলামের বা দেশের সত্যিকার কল্যাণ হতে পারে না। তাদের মর্যাদা ও অধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে।
৫. বর্তমানে যেসব ইসলামী সংগঠন রয়েছে সেগুলোকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। সংগঠন ছাড়া বড় কাজ করা যায় না। প্রত্যেকেরই উচিত তার পছন্দের ইসলামী সংগঠনে যোগদান করা।
৬. অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী বইগুলো বেশি করে ছড়িয়ে দেয়া দরকার। ইসলামী দাওয়াতের অগ্রগতি নির্ভর করে মানুষকে ইসলামী বই দেয়ার ওপর। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী বই। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী বই ভালো করে ছড়ানো হয়নি। এসব গুরুত্বপূর্ণ বই ছড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
৭. সমাজসেবার মাধ্যমে প্রত্যেকের উচিত নিজের গ্রাম বা এলাকার দারিদ্র্য দূর করা। সব কিছুই সরকার করতে পারে না। সে জন্য ব্যক্তি উদ্যোগের প্রয়োজন অনেক।
৮. মধ্যপন্থাই উত্তম। আল্লাহতায়ালা কুরআনের মধ্যপন্থার কথা বলেছেন। মুসলিম জাতিকে তিনি ‘মধ্যপন্থী’ উম্মত বলেছেন।
৯. হঠকারিতা ও বাড়াবাড়ি ভালো নয়। কুরআনের বিভিন্ন জায়গাতে বাড়াবাড়ির নিন্দা করা হয়েছে। সূরা নাহলের ৯০ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন।
১০. শ্রমিকরা আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বঞ্চিত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা উপযুক্ত মজুরি পান না। বাধ্য হয়ে তাদেরকে অনেক আন্দোলন করতে হয়। অথচ শ্রমিকদের সমস্যা বোঝা আমাদের সবারই দায়িত্ব।
১১. গৃহকর্মীদের/গৃহে যারা কাজ করে, তাদেরই খুবই কম মজুরি দেয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বর্তমানে তাদেরকে দুই থেকে তিন হাজার করে টাকা দেয়া হচ্ছে। অথচ এই মজুরি যা দেয়া উচিত তার অর্ধেকও নয়।
১২. যারা অফিসে কাজ করেন তাদের উচিত সব সাক্ষাৎপ্রার্থীকে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া। এর ফল খুব ভালো হয়। এমনকি সুবিচার করতেও এটা সহায়ক হয়ে থাকে।
১৩. অফিসের কাজ ফেলে রাখা উচিত নয়। কাজ ফেলে রাখলে পরে তা জটিলতা সৃষ্টি করে।
১৪. বিদেশ সফরে গেলে কিছু ইসলামী বই সাথে নিয়ে গেলে ভালো হয়। এতে বিদেশে ইসলামের দাওয়াত দিতে অনেক সুবিধা।
১৫. বিদেশ সফরে গেলে সেই দেশের স্থানীয় মসজিদ ও স্থানীয় ইসলামী সংগঠনের অফিস পরিদর্শন করে আসা উচিত। এতে উম্মাহর মধ্যে পারস্পরিক সর্ম্পক বৃদ্ধি পায়।
১৬. বিশ্বের বড় শক্তিগুলো আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুবিচারের নীতি অনুসরণ করে না। তারা নিজেদের রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী স্বার্থে কাজ করে। অনেকসময় শোষণ করে।
১৭. সবর (ধৈর্য) মহা ওষুধ। সবর সব সময় সব অবস্থায় মানুষকে সাহায্য করে।
১৮. যে রাগারাগি করে, তার ভুল করার সম্ভাবনা বেশি।
১৯. সাধ্যমতো দান করা উচিত। দান করলে কেবল অন্যের নয়, নিজেরও কল্যাণ হয়।
২০. মানবজাতির সংশোধনের জন্য সাধ্যমতো ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ করা উচিত।
আমি নিজের উপলব্ধিগুলো বললাম। যদি এগুলো আপনাদের ভালো লেগে থাকে, তবে আপনারাও এগুলোকে আপনাদের কাজের ভিত্তি বানাতে পারেন।
লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ ও সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার।