অধ্যাপক ম্যাকলোয়েন চার্লস বলেছেন, “আমার মতে ইতিহাসের কোনো যুগেই কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এত কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়নি, প্রশাসনের সামনে বিচার বিভাগ কখনো এতটা অসহায়ত্ব বোধ করেনি”। বেকন বলেছিলেন- “আইনের মাধ্যমে অত্যাচার করার চেয়ে বড় অত্যাচার আর নেই।” সেই অত্যাচারের শিকার হয়েছেন শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ ইসলামী আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। ২২ নভেম্বর ২০১৫ ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই দিন দু’জন দেশ প্রেমিক নাগরিককে আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে হত্যা করলো যা সৃষ্টি করলো এক কালো অধ্যায়ের। পৃথিবীর সব নীতি নৈতিকতা, মানবাধিকারকে উপেক্ষা করে যাকে হত্যা করা হয়েছে তিনি একজন রাজনীতিবিদ, প্রতিথযশা শিক্ষাবিদ, লেখক, ইসলামী ব্যক্তিত্ব, সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় নেতা। বিশ্বের কোটি-কোটি মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা আর চোখের অশ্রু সিক্ত হয়ে আমাদের প্রাণ-প্রিয় নেতা আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন প্রায় দু’বছর আগে। কিন্তু তিনি তাঁর সততা, দেশ ও কর্মের মাধ্যমে জাগরুক রয়েছেন লক্ষ-কোটি মানুষের হৃদয়ে।
বাংলার লক্ষ কোটি যুবক তাদের রেখে যাওয়া আদর্শের প্রেরণায় উজ্জীবিত। হত্যাকারীরা অনেকে আজ আমাদের চোখের সামনে অপমান অপদস্ত, জনগণের ঘৃণায় অভিশাপে হাবুডুবু খাচ্ছে। অনেকে উচ্চ আসন থেকে অপসারিত হতে শুরু করেছে। আল্লাহর ঘোষণা- “বলুন ইয়া আল্লাহ! আপনিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। আপনি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করেন এবং যার কাছ থেেক ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নেন এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পততি করেন। আপনার হাতেই রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই আপনি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।” (সূরা- আল ইমরানঃ ২৬ )
হত্যা করে ব্যক্তিকে দুনিয়া থেকে বিদায় করা যায় মানুষের ভালোবাসা থেকে আলাদা করা যায়না। শহীদ মুজাহিদ অমর হয়ে থাকবেন অনন্তকাল। অনেকে আপনজনের জন্য দোয়া করতে ভুলে যান কিন্তু তাঁদের প্রিয় নেতাদের জন্য চোখের পানি ফেলেন নিজের অজান্তে।
পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে তাদেরকে স্বরণ করেন গোটা মুসলিম উম্মাহ। শহীদেরা কালোত্তনী, অমর, শ্রেষ্ঠবীর ও জাতির সুযোগ্য সন্তান। তাদের রক্তের বিনিময়ে একদিন এ জমিনে কালেমার পতাকা উঠবেই, ইনশাআল্লাহ।
আওয়ামী লীগ আদর্শকে মোকাবেলায় ব্যার্থ হয়ে জামায়াতের আমীর, সেক্রেটারীসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যা করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক এই ক্ষত শেষ হয়ে যাবেনা। দার্শনিক সক্রেটিসকে হ্যামলক বিষ প্রয়োগে হত্যার রায় দিয়েছিল আদালতেই।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় আদালতের নির্দেশেই। হাজার বছর পর এসে প্রমাণিত হয়েছে আদালতের দুটি রায়ই ভুল ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে হয়ত একদিন এই হত্যাকা-ের ক্ষেত্রেও তাই প্রমাণিত হবে।
শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ একটি বিপ্লবী নাম, একটি আন্দোলন, একটি ইতিহাস, একটি আপোষহীন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি হিসেবে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এ জাতি শ্রদ্ধার সাথে ইসলামী আন্দোলনের এই সিপাহসালারকে হৃদয়ের আবেগ আর ভালোবাসায় সিক্ত করবে শতাব্দী থেকে শতাব্দী। এই ভূ-খন্ডে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম, প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে শহীদ মুজাহিদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। শহীদ মুজাহিদ ছিলেন আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী চেতনার বিপরীতে একটি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। ট্রাইব্যুনালের রায় শুনে তিনি বলেছিলেন, “সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে, যে শাস্তির ব্যবস্থা করেছে তার জন্য আমি মোটেই বিচলিত নই।
আমি আল্লাহর দ্বীনের উদ্দেশ্যে আমার জীবন কুরবান করার জন্য সব সময় প্রস্তুত আছি।” তাঁর এই সাহসী উচ্চারণ থেকে তরুন প্রজন্ম, এদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেতনা খুঁজে পাবে।
বাংলার জমিনে নাস্তিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীর রক্তচক্ষু মোকাবেলা করে তৃণমূল থেকে গড়ে উঠে আসা একজন সংগ্রামী প্রাণপুরুষ। নীতির প্রশ্নে সদা আপোষহীন এই মানুষটিকে কেবলমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধেই হত্যা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তাদের অপরাধ, তারা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর উপর ঈমান এনেছে।” আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো বলেন, “আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের মৃত মনে করো না, প্রকৃতপক্ষে তারা জীবিত, কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা অনুভব করতে পারো না” (২ঃ ১৫৪)। প্রিয় রাসূল (ﷺ) বলেছেন, ‘‘শাহাদাত লাভকারী ব্যক্তি নিহত হবার কষ্ট অনুভব করে না। তবে তোমাদের কেউ পিঁপড়ার কামড়ে যতটুকু কষ্ট অনুভব করে, কেবল ততটুকুই অনুভব করে মাত্র।” (তিরমিযী)
এই ক্ষণজন্মা, মহান ব্যক্তিত্বের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট। তাঁর পিতা প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আব্দুল আলীর কাছে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের মধ্য দিয়ে শিক্ষার হাতেখড়ি। জনাব মুজাহিদের পিতা মাওলানা আব্দুল আলী একজন ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে আজও ফরিদপুরসহ গোটা অঞ্চলের মানুষের নিকট শ্রদ্ধার পাত্র। ১৯৬২-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যও (এমপিএ) নির্বাচিত হয়েছিলেন। জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ফরিদপুর ময়জুদ্দিন স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সর্বশেষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন।
ছাত্র জীবনে এই মেধাবী চৌকস সচেতন মানুষটি ছাত্র-সমাজের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে শীর্ষে থেকে ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক সভাপতি নির্বাচিত হন। কর্মজীবনেও রেখেছেন গৌরবজ্জল ভূমিকা। জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠাসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তিনি কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন। শহীদ মুজাহিদ সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করাকালীন তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে জেল, জুলুম এবং নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। ১/১১ সরকার তথাকথিত দুর্নীতির মিথ্যা মামলা দিয়েও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতি আবিষ্কার করতে পারেনি। কারণ দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া যাদের মিশন আর আল্লাহর নিকট প্রতিটি কর্মের জবাবদিহির চেতনা লালন করেন তারা কি দুর্নীতি করতে পারেন? সাবেক মন্ত্রী শহীদ মাওঃ মতিউর রহমান নিজামী ও শহীদ আলী আহসান মুজাহিদ দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রতীক হয়ে থাকবেন।
শহীদ মুজাহিদ ছিলেন ক্ষুধা-দারিদ্র্য মুক্ত একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অনুপম কারিগর। মন্ত্রী হয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে কায়েম করেছেন সততা, ইনসাফ, সত্যবাদিতার উজ্জল উদাহরণ। আত্মত্যাগ, আন্তরিকতা, নিষ্ঠার মাধ্যমে দেশ প্রেমের সাক্ষর রেখেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে। জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছেন একটি সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন। তাঁদের ঐতিহাসিক ভূমিকা দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
জনাব মুজাহিদকে হত্যা করে আওয়ামী লীগ নতুন করে আবার হিংসা-বিদ্বেষের বীজ বপণ করল। যা দেশের ঐক্য ও সংহতির জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়। বি. সি. রায় বলেছেন- “ক্ষমতা সবচেয়ে বড় মদের নেশার মতো। যাকে একবার পেয়ে বসে তাকে জীবনে শেষ করে দেয়”। আওয়ামী লীগ আজ অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকা নেশায় মত্ত হয়ে শহীদ মুজাহিদকে হত্যা করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর যে ব্যক্তি জেনে বুঝে কোন মুমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি হচ্ছে জাহান্নাম। সেখানে সে চিরকাল থাকবে। তার ওপর আল্লাহর গজব ও তাঁর লানত এবং আল্লাহ তার জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন।” (৪ঃ ৯৩)
এক সময় শহীদ মুজাহিদ সাহেব আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র ছিলেন। রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামে ছিলেন একত্রে। একান্ত নিভৃতে রাজনৈতিক শলা-পরামর্শও হয়েছে জামায়াত নেতাদের সাথে। তাই ইবনে মুয়াইদ বলেছেন- “হিংসুক ব্যক্তি সর্বদা তিন প্রকার কষ্টে নিপতিত থাকে- আত্মদহন, মানুষের ঘৃণা এবং আল্লাহর গজব।” আর ডন জুয়ান বলেছেন- “হিংসা দিয়ে কখনো হিংসাকে হত্যা করা যায় না।” আওয়ামী লীগ ঘরে-ঘরে হিংসা বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে।
শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ভাইয়ের অসংখ্য কর্মই এখন স্মৃতি। অনেকের মতো আমিও অত্যন্ত কাছ থেকে এই প্রিয় মানুষটিকে দেখেছি। মুজাহিদ ভাই ছিলেন নীতির প্রশ্নে আপোষহীন। কিন্তু তিনি ছিলেন যেমন কঠোর উনার হৃদয়টা ছিলো অনেক নরম প্রকৃতির। বিশেষ করে দেশের সমস্ত ক্যাম্পাসে যখন ইসলামী ছাত্রশিবিরের উপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের শিকার, নেতা-কর্মীদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতনের বর্ণনা শোনার পর অনেক দিন তাঁর চোখে আমি পানি দেখেছি! তিনি ছাত্রশিবিরকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন। তারপরও তিনি সব সময় ছাত্রশিবিরকে সৎ জীবন যাপন ও ধৈর্যের পরামর্শ দিতেন এবং বলতেন তোমরা কোনো বাড়াবাড়ি করো না, তাহলে আল্লাহর সাহায্য পাবে।
মুজাহিদ ভাই আত্মপর্যালোচনার ব্যাপারে ছিলেন আপোষহীন।
ক্যাম্পাসের কোনো ঘটনা শুনলেই তিনি বলতেন তোমাদের কোনো ভুল, বাড়াবাড়ি ছিল কি না তা আগে খতিয়ে দেখ। সময়ানুবর্তিতায় তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। মুজাহিদ ভাইয়ের সাথে কোনো মিটিং থাকলে তিনিই আগে উপস্থিত হতেন।
ব্যক্তি জীবনে অল্পে তুষ্ট, নির্লোভ, পরোপোকারী, দৃঢ়চেতা, ছিলেন শহীদ মুজাহিদ। জীবন-যাপন করতেন অত্যন্ত সাদা-সিধেভাবে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিসে গিয়ে দেখতাম মেজেতে মাদুর ফেলে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। পোশাক আশাকেও তিনি অত্যন্ত সাদা-মাটা। অনেক সময় দেখেছি তার গায়ের ফতুয়া ছেড়া। আমরা তাকালে হাসতেন আর বলতেন অল্পে তুষ্ট জীবন লালন করতে শিখ। তাহলে জীবনে টেনশন ফ্রি থেকে হালাল পথে থাকতে সহজ হবে। কত মানুষ আছে যাদের একটা জামাও নেই। একবেলা খেতে পায় না। তাদের কথা আমাদের ভাবতে হবে।” দেশের মানুষের মুক্তির জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন তিনি।
শহীদ মুজাহিদ ব্যক্তি জীবনে তিলে তিলে নিজের জীবনকে গড়ে তুলেছেন। কৃচ্ছ্বতা সাধন করে রাষ্ট্রীয় খরচের ক্ষেত্রেও অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দু’মন্ত্রী দলীয় কাজে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতেন খুব কমই। সরকারি সফরে গিয়ে দলীয় লোক নিয়ে বিরাট খরচের বোঝা না বাড়িয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে খেতেন জামায়াত অফিসে। বাঁচিয়ে দিতেন সরকারি টাকা। তাদের সাথে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিরা আজও তাঁদের এ সততার সাক্ষী। আবার দলীয় কাজে সফরে গিয়ে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিতেন না তারা। তাঁর স্ত্রী বলেছেন, স্ত্রী হিসেবে আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমার স্বামী ঘরে বাইরে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে আল্লাহর রহমতে অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সৎ জীবন যাপন করেছেন।
আন্তর্জাতিক বার এসোসিয়েশন, মানবাধিকার সংগঠন, সংস্থা এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার রিপোর্টে যে আশঙ্কা করা হয়েছে যে, “সরকার তার পরিচিত প্রতিপক্ষ এবং রাজনৈতিক শত্রুদের দমন করতেই এ বিচারকে ব্যবহার করছে”। তাই ভলতেয়ার বলতেন- “অস্ত্রের জোরে তুমি সারা পৃথিবী জয় করতে পার, কিন্তু পারবে না একটা গ্রামের মানুষেরও মন বশীভূত করতে।” বিচারের ক্ষেত্রে আজ আওয়ামী লীগ সেই নীতিই অবলম্বন করছে। শহীদ মুজাহিদের মৃত্যুদ-ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ব্যক্তিত্ব তাদের উদ্বেগ অব্যাহত রেখেছে।
অথচ এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ট্রাইব্যুনালে জেরার সময় স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের কোথাও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত কোনো অপরাধের সাথে জনাব মুজাহিদ সম্পৃক্ত ছিলেন তার সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ তার হাতে নেই। সম্পূর্ণ ধারণার ও ঢালাও অভিযোগের ভিত্তিতে একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। যাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে তিনি জানতেই পারলেন না কি তার অপরাধ, কি অপরাধে তাঁকে হত্যা করা হলো।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যে অন্যায়ভাবে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করলো, সে যেন গোটা মানব জাতিকে হত্যা করলো।” রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “বিচারক তিন ধরনের দুই ধরনের জাহান্নামী এক ধরনের জান্নাতী, যে সত্য জেনেও অন্যায় বিচারকার্য করে সে জাহান্নামী, যার বিচারকার্যের জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও বিচারকার্য করল সে জাহান্নামী, আর যে সত্যকে জানলো এবং সে অনুযায়ী বিচারে রায় দিল সে জান্নাতি” (ইবনে মাজাহ)। বিচারের সাথে মিথ্যা সাক্ষ্যদানকে তিনি শিরকের সমতুল্য বড় গুনাহ বলে উল্লেখ করেছেন। যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, মিথ্যা সাক্ষ্যদানে উদ্বুদ্ধ করে এবং জেনে-বুঝে এর পক্ষাবলম্বন করে এরা সবাই মুশরিক ও জালেম জাহান্নামই তাদের ঠিকানা। আয়েশা (রা.) বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, “মুসলমানদের ওপর থেকে শাস্তি যতটা পারো রহিত করো। তাকে অব্যাহতি দেয়ার সুযোগ থাকলে অব্যাহতি দাও। কেননা শাসকের জন্য ভুলক্রমে শাস্তি দেয়ার চেয়ে ভুলক্রমে মাফ করা উত্তম।”
আওয়ামী লীগ হয়তো মনে করেছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে একের পর এক হত্যা করে ইসলামী আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করে দিবে। কিন্তু আল্লাহর ঘোষণা-“তারা মুখের ফুৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তাঁর আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।” (৬১ঃ৮)
রাষ্ট্র পরিচালনায় জামায়াতের অংশগ্রহণ, দু’মন্ত্রীর জনপ্রিয়তা, জনসমর্থন, সাংগঠনিক মজবুতি, আওয়ামী বাম শিবিরকে দিশেহারা করে ফেলেছে। মুমিনের জীবনে সবচেয়ে বড় সফলতা শাহাদাতের মৃত্যু। এটি কোনো মৃত্যু নয়, এ যেন নতুন জীবনের সূচনা। একেকজন শহীদের সাহসী উচ্চারণ আজ মুসলিম উম্মাহর পাথেয়।
শহীদ মুজাহিদ বলেছেন, “আমি আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে বলছি, আমার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা ও বানোয়াট। ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন কোনো ধরনের অপরাধের সাথে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম না। শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধে এত বছর পরে আমার বিরুদ্ধে এই মিথ্যা অভিযোগ সাজানো হয়েছে। তিনি আরো বলেন, প্রতিদিন বাংলাদেশে শত শত লোক স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। এসব মৃত্যুর সাথে ফাঁসির আদেশের কোনো সম্পর্ক নেই। কখন, কার, কিভাবে মৃত্যু হবে সেটা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করেন। আল্লাহর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো সাধ্য কারো নেই। সুতরাং ফাঁসির আদেশে কিছু যায় আসে না। আমি মৃত্যুদ- বহাল রাখার ঘোষণায় উদ্বিগ্ন নই।”
আদর্শের লড়াইয়ে যারা পরাজিত, তারা আজ হিংস্রতা, পৈশাচিকতা, জঘন্য, মিথ্যা, বানোয়াট, নোংরামি আর কূটকৌশল দিয়ে এই জাতির বীর সৈনিকদের অবদানকে কলূষিত করতে পারবে কি? দেশে-বিদেশে, খানায়ে কাবার আর মসজিদে নববীতে লক্ষ কোটি মানুষের কান্নার আওয়াজ আর জানাজায় উপস্থিতি আওয়ামী লীগ কি বার্তা পাচ্ছে! এত অপপ্রচার, নোংরামি, ভন্ডামী আর তামাশা করেও লাখো জনতার গগণবিদারি কান্না, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সমাহিত হওয়াও কি ঠেকাতে পেরেছে সরকার? রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “আল্লাহ যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন তখন তিনি ফেরেশতাদের বলেন, দুনিয়ার মানুষকে জানিয়ে দাও তারাও যেন এ বান্দাহকে ভালোবাসে।” জীবিত অধ্যাপক গোলাম আযম (রহ.), শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (রহ.), মাওলানা একেএম ইউসুফ (রহ.), শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ (রহ.), শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান (রহ.), শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা (রহ.) ও শহীদ মীর কাসেম আলী (রহ.) সহ শহীদেরা গোটা বিশ্বের ইসলামী আন্দোলনের জন্য শ্রেষ্ঠ সম্পদ। প্রতিদিন হাজার হাজার নেতা-কর্মী এ জমিনে তাদের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য শপথ গ্রহণ করছে।
তাঁরা বাংলার জমিনে ইসলামী আন্দোলনের যে বীজ বপন করেছেন, তা বিকশিত হয়ে গড়ে উঠেছে একটি তরুন প্রজন্ম। তাদের নিরলস কর্ম, বক্তর্ক, লেখনীর মাধ্যমে এই দেশের মানুষ তাদেরকে নিজ গরজেই সম্মান করতে থাকবে। জাতি তাদের ঐতিহাসিক অবদানকে মূল্যায়ন করবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এই বীর সেনানীদের ভালোবাসতে থাকবে আর ঝড়াতে থাকবে চোখের পানি।
পৃথিবীর প্রান্তে-প্রান্তে প্রতিনিয়ত তাদের জন্য দোয়া করবে বিশ্ব মানবতা। আর অভিশপ্ত খুনীদের ঘৃণা করবে অনন্তকাল।
এই প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে জাতি নতুন করে আবার জানলো সত্য ইতিহাস। প্রমানিত হয়েছে জামায়াত নেতৃবৃন্দ কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেননি। তাঁদের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন,“একজন আইনজীবী হিসেবে আমি বলতে চাই, মানবতাবিরোধী অপরাধে যে চারজনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন আইনের অধীনে বিচার হলে তাদের কারোরই ফাঁসি হতো না।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে বিচার করতে বলেছে, সেভাবে বিচার করা হলে কারোরই ফাঁসি হতো না বলে আমি মনে করি। সকলেই মুক্তি পেতেন।”
শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ শেষ দেখায় স্ত্রী তামান্না-ই জাহানকে ধৈর্য ধরতে এবং শান্ত থাকতে বলেছেন। তাঁর পুত্র আলী আহমাদ মাবরুর বলেন, “বিদায় বেলায় আব্বাকে একেবারেই শান্ত স্বাভাবিক দেখা গেছে। তবে প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে তিনি বেশ রিঅ্যাক্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, জীবনের শেষ দিনও সরকার আমাকে নিয়ে জঘন্য মিথ্যাচার করেছে। এর চেয়ে বড় জুলুম আর কি হতে পারে। জনাব মুজাহিদ স্বজনদের বলেছেন, আমি কোনো অপরাধ করিনি। সরকার আমার কোনো অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি। তবু বুদ্ধিজীবীদের হত্যার কোনো প্রমাণ দিতে পারেনি। হত্যা তো নয়ই, বরং বুদ্ধিজীবী হত্যায় কথিত ষড়যন্ত্র ও সহযোগিতা করার বায়বীয় অভিযোগে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। সাক্ষ্যপ্রমাণ বিহীন এমন ঢালাও অভিযোগ দিয়ে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। যে রকম অপরাধের কোনো প্রমাণ নেই সে অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইবো কেন। জনাব আরো মুজাহিদ বলেছেন, প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণ ভিক্ষার বিষয়টি প্রচার করে সরকার আমাকে কাপুরুষ হিসেবে দেশ জাতি এমনকি বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু যারা আমাকে চিনে, আমার নীতি আদর্শ সম্পর্কে অবগত তারা কখনো এসব বিশ্বাস করবেনা। ক্ষমা প্রার্থনার নাটক করে সরকার দেশবাসী বিশেষ করে আমার দলের লোকদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। হাশরের ময়দানে দেখা হবে স্ত্রীকে এমন সান্তনা দিয়ে বিদায়ের শেষ মুহূর্তে মুজাহিদ বলেছেন, সংসার জীবনে তোমার মত ভাল স্ত্রী পেয়ে স্রষ্টার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। প্রতি উত্তরে মুজাহিদের স্ত্রী তামান্না-ই জাহান স্বামীকে একজন ভালো এবং নির্দোষ মানুষ হিসেবে প্রশংসা করেন।”
দ্বীনের যে অকুতোভয় সৈনিক তার সার্বিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে পালন করেছেন আপসহীন ভূমিকা। কোনো শক্তির কাছেই তিনি মাথা নত করেননি। আজ আমাদের প্রিয় নেতা জনাব মুজাহিদ ভাই সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)! কবরে সকল মুমিনের পরীক্ষা হবে, কিন্তু শহীদের হবে না, এর কারণ কী? হুজুর (ﷺ) জবাবে বললেন, তার মাথার ওপর তলোয়ার চমকানোই তার পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট।’
আল্লাহর দ্বীনের দায়ী হিসেবে সারা বাংলাদেশে নয়, বরং ছুটে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর অনেক প্রান্তে। মিথ্যা কালিমা আর ষড়যন্ত্রের কালো কাপড় কি সেই আলোচ্ছটাকে আবৃত করতে পারে? যেই শির আজন্ম এক পরওয়ারদিগার ছাড়া কারো কাছে নত হয়নি, ফাঁসির আদেশে সেই শির দুনিয়ার কোনো শক্তির কাছে নতি শিকার করতে পারে?
যুগে যুগে নবী-রাসূল ও সত্যপন্থীদের ওপর জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন, নিপীড়ন হয়েছে নানাভাবে, নানা কৌশলে। কিন্তু কোন দলন নিপীড়নই ইসলামী আন্দোলনের পথচলা থামিয়ে দিতে পারেনি, এখনও পারবে না ইনশাআল্লাহ। ইতিহাস বলে শহীদের রক্ত বৃথা যায় না। শহীদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে বিজয় আসবেই।
তিবরানীতে হযরত মুয়াজ বনি জারুন (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস যাতে বলা হয়েছে যে, ইসলামের রাজনৈতিক অবস্থা যখন বিকৃত হয়ে যাবে, তখন বিপদগামী শাসকরা কর্তৃত্বশীল হবে এবং তারা সমাজকে ভ্রান্ত পথের দিকে নিয়ে যাবে। তাদের নির্দেশ মেনে চললে জনগণ গোমরাহ হয়ে যাবে। আর তাদের নির্দেশ অমান্য করলে তারা তাদের হত্যা করবে। এ কথা শোনার পর লোকেরা জিজ্ঞেস করলো তারপর তারা কি করবে, তিনি বললেন : সে সময়ে তোমাদেরকে হযরত ঈসার সহচরগণ যা করছিল তাই করতে হবে। তাদেরকে করাত দিয়ে চিরে ফেলা হয়েছে। শূলে চড়ানো হয়েছে, তবুও তারা বাতিলের কাছে আত্মসর্মপণ করেননি।
শহীদের রক্ত আর মজলুমের চোখের পানি কখনো বৃথা যায় না। রাসূল (ﷺ) মুয়ায (রা.) কে বললেন, হে মুয়ায! মাযলুমের দোয়া থেকে ভীত থাকবে, কারণ মাযলুম যখন আল্লাহর নিকট দোয়া করে তখন তার এবং আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা থাকেনা। সুতরাং জেল-জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, ফাঁসি আমাদের জীবনে নতুন হলেও ইসলামী আন্দোলনে তা একেবারেই পুরাতন। তাই আসুন, শোককে শক্তিতে পরিণত করে শহীদের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ বাস্তবায়ন করে গড়ে তুলি একটি সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। মহান পরওয়ারদিগার শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ সকলকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন। আমীন।।
লেখকঃ সহকারী সম্পাদক, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা।