ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে পরিপূর্ণ বুঝ ও ধারণা না থাকার কারণে আস্থা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে সঠিক পন্থায় এ আন্দোলন করা এবং এই পথে টিকে থাকা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। এই কাজের প্রতি প্রেরণা ও একাগ্রতা পেতে চাইলে ইসলামী আন্দোলনের সঠিক ধারণা, কর্মপন্থা ও সফলতার প্রশ্নে ভুল বোঝাবুঝি দূর হওয়া দরকার। এ লেখায় কুরআন-হাদীসের আলোকে সে চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের উচিত বেশি বেশি কুরআন-হাদীস অধ্যয়নের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের পথে এগিয়ে যাওয়া।
মহান আল্লাহ তায়ালার মনোনীত একমাত্র সত্য দীন হচ্ছে ইসলাম
‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে ইসলামই একমাত্র দীন। যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিল, তারা ঐ দীনকে বাদ দিয়ে যেসব পথ বের করেছে, তার কারণ এছাড়া আর কিছুই ছিল না যে, তাদের কাছে ইলম আসার পরও একে-অপরের সাথে বাড়াবাড়ি করার উদ্দেশ্যেই এরূপ করেছে। আর কোনো ব্যক্তি আল্লাহর আদেশ ও হিদায়াত মেনে চলতে অস্বীকার করলে তার কাছ থেকে হিসাব নিতে আল্লাহ অত্যন্ত তৎপর।’ (সূরা ইমরান : ১৯)। ‘এখন কি এরা আল্লাহর আনুগত্যের পথ (আল্লাহর দীন) ত্যাগ করে অন্য কোনো পথের সন্ধান করছে? অথচ আকাশ ও পৃথিবীর সবকিছুই স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আল্লাহর হুকুমের অনুগত এবং তাঁরই দিকে সবাইকে ফিরে যেতে হবে। হে নবী! বল, আমরা আল্লাহকে মানি, আমাদের ওপর অবতীর্ণ শিক্ষাকে মানি, ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও ইয়াকুবের সন্তানদের ওপর অবতীর্ণ শিক্ষাকেও মানি এবং মূসা, ঈসা ও অন্য নবীদের তাদের রবের পক্ষ থেকে যে হিদায়াত দান করা হয়, তার ওপরও ঈমান রাখি। আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি না এবং আল্লাহর হুকুমের অনুগত।’ (সূরা ইমরান : ৮৩-৮৪)। ‘এ আনুগত্য (ইসলাম) ছাড়া যে ব্যক্তি অন্য কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করতে চায়, তার সে পদ্ধতি কখনোই গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ব্যর্থ, লাঞ্ছিত, আশাহত ও বঞ্চিত।’ (সূরা বাকারা : ৮৫)। ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পুরোপুরি ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের অনুসারী হয়ো না। কেননা সে মুমিনদের সুস্পষ্ট দুশমন।’ (সূরা বাকারা : ২০৮)। ‘তাদেরকে তো এছাড়া আর কোনো হুকুম দেয়া হয়নি যে তারা নিজেদের দীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য বিশুদ্ধচিত্তে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করবে, সালাত কায়েম করবে ও জাকাত দেবে, ইহাই সত্য ও সঠিক দীন।’ (সূরা বাইয়্যেনা : ৫)।
ইসলাম কায়েম ও বিজয়ী হওয়ার জন্য এসেছে
‘তিনি তোমাদের জন্য দীনের ক্ষেত্রে সে পথই বিধিবদ্ধ করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি আপনার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি কর না। আপনি মুশরিকদের যে বিষয়ের প্রতি আমন্ত্রণ করছেন, তা তাদের কাছে অসহনীয় বলে মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা দীনের প্রতি আকৃষ্ট করেন এবং যে তাঁর অভিমুখী হয়, তাকে দীনের পথে পরিচালিত করেন।’ (সূরা আশ শুরা : ১৩)। “তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত এবং ‘দীনে হক’ দিয়ে পাঠিয়েছেন; যাতে তিনি এ দীনকে অন্য সকল দীনের ওপর বিজয়ী করেন, যদিও মুশরিকরা উহা অপছন্দ করে।” (সূরা সফ : ৯)। ‘আল্লাহই তো সে মহান সত্তা, যিনি তাঁর রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দীন দিয়ে পাঠিয়েছেন; যেন তাকে সব দীনের ওপর বিজয়ী করে দেন। আর এ বাস্তবতা সম্পর্কে আল্লাহর সাক্ষই যথেষ্ট।’ (সূরা ফাতহ : ২৮)। ‘আল্লাহই তার রাসূলকে পথনির্দেশ ও সত্য দীন সহকারে পাঠিয়েছেন; যাতে তিনি একে সকল প্রকার দীনের ওপর বিজয়ী করেন, মুশরিকরা একে যতই অপছন্দ করুক না কেন।’ (সূরা তাওবা : ৩৩)।
দীন কায়েমের জন্য সংগ্রাম করতে হয়
‘তোমাদের কী হলো, তোমরা আল্লাহর পথে অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য লড়বে না, যারা দুর্বলতার কারণে নির্যাতিত হচ্ছে? তারা ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের রব! এই জনপদ থেকে আমাদের বের করে নিয়ে যাও, যার অধিবাসীরা জালিম এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের কোনো বন্ধু, অভিভাবক ও সাহায্যকারী তৈরি করে দাও। যারা মুমিনের পথ অবলম্বন করেছে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। আর যারা কুফরির পথ অবলম্বন করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। কাজেই শয়তানের সহযোগীদের সাথে লড় এবং নিশ্চিত জেনে রাখ, শয়তানের কৌশল আসলে নিতান্তই দুর্বল।’ (সূরা নিসা : ৭৫-৭৬)। ‘হে ঈমান আনয়নকারীগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি ব্যবসার সন্ধান দেব, যা তোমাদেরকে কঠিন আজাব থেকে মুক্তি দেবে? তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ও জান-প্রাণ দিয়ে জিহাদ করবে- এটাই তোমাদের জন্য অতীব কল্যাণকর যদি তোমরা তা জান।’ (সূরা সফ : ১০-১১)। হক আদায় করে আল্লাহর পথে লড়তে হবে। আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে আমাদের বাছাই করেছেন। ‘আল্লাহর পথে জিহাদ কর যেমন জিহাদ করলে তার হক আদায় হয়। তিনি নিজের কাজের জন্য তোমাদেরকে বাছাই করেছেন এবং দীনের ব্যাপারে তোমাদের ওপর কোনো সংকীর্ণতা আরোপ করেননি।’ (সূরা হজ : ৭৮)।
দীন কায়েমকে অগ্রাধিকার দেয়া
‘হে নবী! বলে দাও, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন, তোমাদের উপার্জিত সম্পদ, তোমাদের যে ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দেয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাক এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে তোমরা খুবই পছন্দ কর- এসব যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং তাঁর পথে জিহাদ করার চাইতে তোমাদের কাছে বেশি প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফয়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আল্লাহ ফাসেকদের কখনো সত্য পথ প্রদর্শন করেন না।’ (সূরা তাওবা : ২৪)। ইসলামে দীনদারী ও দুনিয়াদারী আলাদা নয়। আল্লাহ ও রাসূলের সা. দেখানো পন্থায় দুনিয়ার কাজ আঞ্জাম দিলে সেটাই দীনদারীতে পরিণত হয়। তাই সকল দুনিয়াবী কাজকে দীন কায়েমের কাজের সাথে সম্পৃক্ত ও সামঞ্জস্য করতে হবে। দুনিয়াবী কাজ যদি দীন কায়েমের কাজের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তাহলে সেটা ছেড়ে দেয়ার নামই কুরবানি।
কিছু নেক কাজ জিহাদের সমতুল্য হতে পারে না
‘তোমরা কি হাজীদের পানি পান করানো ও মসজিদুল হারামের খেদমত করাকে ঐ লোকের কাজের সমান মনে করে নিয়েছ, যে ঈমান এনেছে আল্লাহ ও আখিরাতের ওপর এবং যে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করেছে? আল্লাহর কাছে তো এরা দুইজন সমান নয়, আর আল্লাহ জালিম কাওমকে হিদায়াত করেন না।’ (তাওবা : ১৯)। ‘তোমাদের মুখ পূর্ব দিকে বা পশ্চিম দিকে ফিরাবার মধ্যে কোনো পুণ্য নেই। বরং সৎকাজ হচ্ছে এই যে, আল্লাহ, কিয়ামতের দিন, ফেরেশতা, আল্লাহর অবতীর্ণ কিতাব ও নবীদের মানুষ মনে-প্রাণে মেনে নেবে এবং আল্লাহর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের প্রাণপ্রিয় ধন-সম্পদ, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকিন, মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থী ও ক্রীতদাসদের মুক্ত করার জন্য ব্যয় করবে। আর নামাজ কায়েম করবে এবং জাকাত দান করবে। যারা অঙ্গীকার করে তা পূর্ণ করবে এবং বিপদে-অনটনে ও হক-বাতিলের সংগ্রামে সবর করবে তারাই সৎ ও সত্যাশ্রয়ী এবং তারাই মুত্তাকি।’ (সূরা বাকারা : ১৭৭)।
আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মর্যাদার কাজ হচ্ছে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ
‘আল্লাহর কাছে তো তারাই উচ্চমর্যাদার অধিকারী, যারা ঈমান এনেছে এবং তার পথে ঘরবাড়ি ছেড়ে হিজরত করেছে ও ধন-প্রাণ সমর্পণ করে জিহাদ করেছে। তারাই সফলকাম। তাদের রব তাদেরকে নিজের রহমত, সন্তোষ ও এমন জান্নাতের সুখবর দেন, যেখানে তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী সুখের সামগ্রী।’ (সূরা তাওবা : ২০-২১)। জান ও মাল আল্লাহর মর্জিমতো কাজে লাগানো মুমিনের অঙ্গীকার। আর এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য। ‘প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের প্রাণ ও ধন-সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে এবং মারে ও মরে। তাদের প্রতি তাওরাত, ইনজিল ও কুরআনে (জান্নাতের ওয়াদা) আল্লাহর জিম্মায় একটি পাকাপোক্ত ওয়াদা বিশেষ। আর আল্লাহর চাইতে বেশি ওয়াদা পূরণকারী আর কে আছে? কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে যে কেনাবেচা করছ, সেজন্য আনন্দ কর। এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।’ (সূরা তাওবা : ১১১)।
আল্লাহর পথে লড়াই করার যোগ্যতা শুধু তাদের আছে, যারা আখিরাতকে প্রাধান্য দেয়
‘আল্লাহর পথে তাদের লড়াই করা উচিত যারা আখিরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন বিকিয়ে দেয়। তারপর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে লড়বে এবং মারা যাবে অথবা বিজয়ী হবে তাকে নিশ্চয়ই আমি মহাপুরস্কার দান করবই।’ (সূরা নিসা : ৭৪)। দীনের কাজ একা করা যায় না। জামায়াতবদ্ধ হয়ে লড়তে হয়। ‘আল্লাহ সেই সব লোকদের ভালোবাসেন যারা তাঁর পথে এমনভাবে কাতারবন্দী হয়ে লড়াই করে যেন তারা সিসা গলিয়ে ঢালাই করা এক মজবুত দেয়াল।’ (সূরা সফ : ৪)। ‘তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রুজ্জু মজবুতভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না। আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন সে কথা স্মরণ রেখ। তোমরা ছিলে পরস্পরের শত্রু। তিনি তোমাদের হৃদয়গুলো জুড়ে দিয়েছেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহ ও মেহেরবানীতে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেলে। তোমরা একটি অগ্নিকুণ্ডের কিনারে দাঁড়িয়ে ছিলে। আল্লাহ সেখান থেকে তোমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন। এভাবেই আল্লাহ তাঁর নিদর্শনসমূহ তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট করে তোলেন। হয়তো এ নিদর্শনগুলোর মাধ্যমে তোমরা নিজেদের কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে। তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক অবশ্যই থাকতে হবে, যারা সৎকর্মশীলতার নির্দেশ দেবে ও খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে। যারা এ দায়িত্ব পালন করবে তারাই সফলকাম হবে। তোমরা যেন তাদের মতো হয়ে যেয়ো না, যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য হিদায়াত পাওয়ার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে। যারা এ নীতি অবলম্বন করেছে তারা সেদিন কঠিন শাস্তি পাবে।’ (সূরা ইমরান : ১০৩-১০৫)।
জামায়াতবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল সা.-এর নির্দেশ
হযরত হারিসুল আশয়ারী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সা. বলেছেন, আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি, যেগুলোর ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন- ১. জামায়াতবদ্ধ হবে, ২. নেতার আদেশ মন দিয়ে শুনবে, ৩. তার আদেশ মেনে চলবে, ৪. আল্লাহর পথে হিজরত করবে ও ৫. আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে। আর তোমাদের মধ্য হতে যে সংগঠন হতে বিঘত পরিমাণ দূরে সরে গেল, সে তার গর্দান থেকে ইসলামের রশি খুলে ফেলল তবে যদি ফিরে আসে তা ভিন্ন কথা। আর যে ব্যক্তি জাহেলিয়াতের দিকে আহ্বান জানায়, সে জাহান্নামি। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! সে যদি রোজা রাখে, নামাজ পড়ে এরপরও? রাসূল সা. বললেন, যদি রোজা রাখে, নামাজ পড়ে এবং নিজেকে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করে এরপরও জাহান্নামি হবে। (মুসনাদে আহমদ : হাদিসুল হারিসিল আশয়ারী আনিন নাবিয়্যি : ১৬৫৪২)। আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.) পরিচালিত ইসলামী আন্দোলনের গতিধারা অনুসরণ করেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এ কাফেলার মূল জনশক্তি হলো সদস্যগণ। দীন কায়েমের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন সাফল্য অর্জনই যাদের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
বাইয়াত হলো জামায়াতী বন্ধনের সূত্র
দীন কায়েমের এই ঐতিহাসিক জিম্মাদারী পালন করতে গিয়ে শেষ নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. একটি সত্যপন্থী জামায়াত গঠন করেন। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সাহাবীদের তিনি এমনভাবে তৈরি করেছিলেন, যাদের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছিল। সাহাবায়ে কেরাম দীন কায়েমের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে নবী সা.-এর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেছিলেন। এ বাইয়াতের কথা কুরআন ও হাদীসে উল্লেখ রয়েছে। দীন কায়েমের জামায়াতের অধীনে বাইয়াতই হচ্ছে সহীহ বাইয়াত। ‘হে নবী! যারা তোমার হাতে বাইয়াত করছিল প্রকৃতপক্ষে তারা আল্লাহর কাছেই বাইয়াত করছিল। তাদের হাতের ওপর ছিল আল্লাহর হাত। যে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করবে তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করার অশুভ পরিণাম তার নিজের ওপরেই বর্তাবে। আর যে আল্লাহর সাথে কৃত এ প্রতিশ্রুতি পালন করবে, আল্লাহ অচিরেই তাকে বড় পুরস্কার দান করবেন।’ (সূরা ফাতহ : ১০)।‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন যখন তারা গাছের নিচে তোমার কাছে বাইয়াত করছিল। তিনি তাদের মনের অবস্থা জানতেন। তাই তিনি তাদের ওপর প্রশান্তি নাজিল করেছেন, পুরস্কারস্বরূপ তাদেরকে আশু বিজয় দান করেছেন।’ (সূরা ফাতহ : ১৮)। ‘বল, আমার নামাজ, আমার ইবাদতের সমস্ত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহরই।’ (সূরা আন’আম : ১৬২)। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইসলামী সংগঠনের নেতৃত্বের অধীনে জান-মালের সর্বাত্মক কুরবানির প্রতিজ্ঞাই বাইয়াত।
ইসলামী আন্দোলনের সঠিক কর্মপন্থা
দাওয়াত ইলাল্লাহ ও সুহাদা আলান্নাছ
মানুষ হবে একমাত্র আল্লাহর দাস। সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পৃথিবীর বুক থেকে অশান্তি, বিপর্যয়, পাপ ও অন্যায়ের মূলোৎপাটন করা দীন ইসলামের মূল লক্ষ্য। এক আল্লাহর গোলামির মধ্যেই রয়েছে মানব সমাজের যাবতীয় সমস্যার সমাধান। আল্লাহর রাসূল সা.-এর সময়ে গোটা দেশ ও জাতি ছিল অজ্ঞতা, নৈতিক অধঃপতন, দারিদ্র্য, দীনতা, ব্যভিচার ও পারস্পরিক কলহ-বিবাদে চরমভাবে নিমজ্জিত। অর্থনৈতিক জুলুম ছিল মারাত্মক। রোম ও পারস্যের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র বিপর্যস্ত করে রেখেছিল আরব বিশ্বকে। এতদ হাজারো সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর রাসূল সা. শুরুতে অন্য সমস্যার প্রতি মনোনিবেশ না করে শুধু মহান আল্লাহর দাসত্ব মেনে নেয়ার প্রতি আহ্বান করেন। পরবর্তীতে অন্যান্য সমস্যার সমাধানও আল্লাহর রাসূল পর্যায়ক্রমে করেছিলেন। ‘সেই ব্যক্তির কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হবে যে আল্লাহর দিকে ডাকল, সৎকাজ করল এবং ঘোষণা করল আমি মুসলমান। সৎকাজ ও অসৎকাজ সমান নয়। তুমি অসৎকাজকে সেই নেকী দ্বারা প্রতিহত কর, যা সবচেয়ে ভালো। তাহলে দেখবে যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল সে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গেছে। ধৈর্যশীল ছাড়া এ গুণ আর কারো ভাগ্যে জোটে না এবং অতি ভাগ্যবান ছাড়া এ মর্যাদা আর কেউ লাভ করতে পারে না।’ (সূরা হা-মীম আস সাজদা : ৩৩-৩৫)। ‘আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী উম্মতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা দুনিয়াবাসীদের ওপর সাক্ষী হতে পার এবং রাসূল হতে পারেন তোমাদের ওপর সাক্ষী।’ (সূরা বাকারা : ১৪৩)।
নেতা ছিলেন আদর্শের মডেল
‘আসলে তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে ছিল একটি উত্তম আদর্শ এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহ ও শেষ দিনকে ভয় করে এবং বেশি করে আল্লাহকে স্মরণ করে।’ (আহযাব : ২১) । ‘হে নবী! বলুন, যদি তোমরা যথার্থই আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়। তাদেরকে বল, আল্লাহ ও রাসূলের অনুগত হও।’ (সূরা ইমরান : ৩১-৩২)। আল্লাহর রাসূল সা. তার নিজের আগমন সম্পর্কে বলেন, ‘আমাকে সচ্চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের নিমিত্তেই প্রেরণ করা হয়েছে।’ (জামেউল আহাদিস : ৬৭২৯)। আল্লাহর রাসূল সা.-এর মাধ্যমে উন্নত নৈতিকতার বিকাশ সাহাবাদের জিন্দেগীতে ঘটেছে। যার বর্ণনা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা দিয়েছেন সূরা মুমিনের প্রথম দশ আয়াত এবং সূরা ফুরকানের শেষ রুকুতে। আল্লাহর রাসূলের হাতে গড়া সাহাবীরা ছিলেন ‘রাতের দরবেশ আর দিনে অশ্বারোহী বীরযোদ্ধা, কর্মচঞ্চল সৈনিক। তারা কাউকে ধোঁকা দেয় না, তাদেরও কেউ ধোঁকা দিতে পারে না।’
ঈমানের অগ্নিপরীক্ষায় নিখাদ প্রমাণিত হওয়া
‘লোকেরা কি মনে করে রেখেছে, আমরা ঈমান এনেছি কেবলমাত্র এ কথাটুকু বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে, আর পরীক্ষা করা হবে না? অথচ আমি তাদের পূর্ববর্তীদের সবাইকে পরীক্ষা করে নিয়েছি, আল্লাহ অবশ্যই দেখবেন কে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যুক।’ (সূরা আনকাবুত : ১-৩)। স্বয়ং নবী করীম সা. বলেছেন, ‘কসম সেই সত্তার যার হাতে মুষ্টিবদ্ধ আমার প্রাণ। আমার বড় সাধ আল্লাহর পথে নিহত হই, আবার জীবন লাভ করি। আবার নিহত হই, আবার জীবিত হই। আবার নিহত হই, আবার জীবিত হই, আবার শহীদ হই।’ (বুখারী)।
জুলুম-নির্যাতনকে তোয়াক্কা না করে আল্লাহর রাসূল সা.-এর নেতৃত্বে সাহাবীরা মার খেয়ে সংগ্রাম করে গেছেন। জিহাদের ডাক পেলে সাহাবায়ে কেরাম বাসর রাতকেও উপেক্ষা করে জিহাদের ময়দানে ছুটেছেন। হযরত হানজালা রা. ওহুদের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তার ফরজ গোসলের প্রয়োজন ছিল। ওই অবস্থাতেই যুদ্ধের ডাক শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে যান এবং শাহাদাত বরণ করেন। শাহাদাতের পর ফেরেশতারা তাকে গোসল দেন। বীরযোদ্ধা খালিদ বিন ওয়ালিদ কোনো যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেননি। শাহাদাত নসিব হয়নি বলে তিনি মৃত্যুর সময় কেঁদেছিলেন। এমনই ছিল সাহাবীদের ত্যাগ-কুরবানি। কিছু ব্যক্তিকে মহান আল্লাহ শহীদ হিসেবে কবুল করেন। মুমিন জীবনে পরীক্ষা অতি স্বাভাবিক বিষয়। মুমিনের মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়ার জন্য মহান আল্লাহ পরীক্ষা নেন, মুসিবতে ফেলানোর জন্য নয়।
আদর্শের স্বাভাবিক ও কার্যকর বিপ্লব
মদীনায় প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র ছিল সাহাবীদের নিয়ে আল্লাহর রাসূলের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার স্বাভাবিক ফল। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি এমনই। হঠাৎ করে আচমকা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না। আল্লাহর রাসূলের ইসলামী বিপ্লবে কেবল রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি। বরং মানুষের মন-মানসিকতা এবং চিন্তাভাবনাও পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। এতে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। চিন্তা পদ্ধতি বদলে যায়। জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তন হয়ে যায়। নৈতিক চরিত্রের জগতে আসে আমূল পরিবর্তন। স্বভাব ও অভ্যাস বদলে যায়। এ থেকে বোঝা যায়, ইসলামী বিপ্লবের ব্যাপকতা অনেক প্রসারিত। তড়িঘড়ি অসম্পূর্ণ অর্জন ইসলামী বিপ্লবের জন্য যথেষ্ট নয়। (ইসলামী বিপ্লবের পথ)। আল্লাহর রাসূলের ইসলামী বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ইসলামের চরমতম দুশমনরা ইসলামের পতাকাতলে শামিল হয়েছিল। খালিদ বিন ওয়ালিদ, আবু সুফিয়ান, হিন্দার মতো ব্যক্তিরা ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে যান। সামাজিক অনাচারে যারা নেতৃত্ব দিতেন, তারা ব্যক্তি ও সমাজের নিরাপত্তা রক্ষাকারী হয়ে যান। পারস্য সাম্রাজ্যের পতন হলে এর রাজমুকুট যার হস্তগত হয় তিনি অত্যন্ত গোপনে সেনাপতির নিকট জমা দেন যাতে তার আমানতদারীর খ্যাতি ছড়িয়ে না পড়ে। ন্যায়পরায়ণতা ও সততার অজস্র দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। সেই সময়ে শাসকদের জীবনাচরণ ও শাসন ছিল ইতিহাসের একমাত্র স্বর্ণযুগ।
জিম্মাদারীর অনুভূতি, সার্বক্ষণিক ধ্যান ও পেরেশানি ছিল রাসূলের জীবন
‘তার এ বাণীর প্রতি ঈমান না আনলে সম্ভবত তুমি তাদের পেছনে নিজের প্রাণটি খোয়াবে। আসলে পৃথিবীতে এ যা কিছু সাজ-সরঞ্জামই আছে, সেগুলো দিয়ে আমি পৃথিবীর সৌন্দর্য বিধান করেছি তাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মধ্য থেকে কে ভালো কাজ করে।’ (সূরা কাহফ : ৬-৭)। ইসলামী আন্দোলন থেকে নিষ্ক্রিয়তার কারণ ২টি। দুনিয়াকে প্রাধান্য দেয়া আর পরীক্ষাকে ভয় করা। কখনো যুদ্ধবিগ্রহ থেকে হাত গুটিয়ে রেখে নামাজ কায়েম ও জাকাত আদায় করতে বলা হয়েছে, কখনো আবার যুদ্ধের হুকুম দেয়া হয়েছে। নিষ্ক্রিয়রা আল্লাহর হুকুম মেনে চলতে সব অবস্থাতেই গড়িমসি করেছে। ‘তোমরা কি তাদের দেখেছ, যাদের বলা হয়েছিল, তোমাদের হাত গুটিয়ে রাখ এবং নামাজ কায়েম কর ও জাকাত দাও? এখন তাদেরকে যুদ্ধের হুকুম দেয়ায় তাদের একটি দলের অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে, তাদের একদল মানুষকে এমন ভয় করেছে যেমন আল্লাহকে ভয় করা উচিত অথবা তার চেয়েও বেশি। তারা বলছে, হে আমাদের রব! আমাদের জন্য এই যুদ্ধের হুকুমনামা কেন লিখে দিলে? আমাদের আরো কিছু সময় অবকাশ দিলে না কেন? তাদেরকে বল, দুনিয়ার জীবন ও সম্পদ অতি সামান্য এবং যে আল্লাহর ভয়ে ভীত তার জন্য আখিরাতই উত্তম। আর তোমাদের ওপর এক চুল পরিমাণও জুলুম করা হবে না।’ (সূরা নিসা : ৭৭)।
মুমিন হলে আল্লাহকেই ভয় করা উচিত
‘তোমরা কি লড়াই করবে না এমন লোকদের সাথে যারা নিজেদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এসেছে এবং যারা রাসূলকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার দুরভিসন্ধি করেছিল আর প্রথম বিরুদ্ধাচরণ তারাই করেছিল? তোমরা কি তাদেরকে ভয় কর? যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক, তাহলে আল্লাহকে ভয় করাই তোমাদের জন্য অধিক সমীচীন।’ (সূরা তাওবা : ১৩)। ‘তখন যে ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন করেছিল এবং দুনিয়ার জীবনকে বেশি ভালো মনে করে বেছে নিয়েছিল, জাহান্নামই হবে তার আবাস। আর যে ব্যক্তি নিজের রবের সামনে এসে দাঁড়াবার ব্যাপারে ভীত ছিল এবং নফসকে খারাপ কামনা থেকে বিরত রেখেছিল তার আবাস হবে জান্নাত।’ (সূরা নাযিয়াত ৩৭-৪১)।
ইসলামী নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য
মুহাম্মদ সা. ছিলেন আদর্শ নেতা ও শিক্ষক। ‘আমি তোমাদের মধ্যে স্বয়ং তোমাদের থেকেই একজন রাসূল পাঠিয়েছি, যে তোমাদের আমার আয়াত পড়ে শোনায়, তোমাদের জীবন পরিশুদ্ধ করে সুসজ্জিত করে, তোমাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয় এবং এমন সব কথা তোমাদের শেখায়, যা তোমরা জানতে না।’ (সূরা বাকারা : ১৫১)।
সকল নবীর কাজ ছিল দাওয়াত পৌঁছানো
‘আর হে মুহাম্মদ! তোমার পূর্বেও আমি মানুষদেরই রাসূল বানিয়ে পাঠিয়েছিলাম, যাদের কাছে আমি অহি পাঠাতাম। তোমরা যদি না জেনে থাকো তাহলে জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস কর।’ (সূরা আম্বিয়া : ৭)। ‘তোমাদের কাছে আমার রবের বাণী পৌঁছে দিচ্ছি। আমি (নূহ) তোমাদের কল্যাণকামী এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে আমি এমন সবকিছু জানি, যা তোমার জান না।’ (সূরা আরাফ : ৬২)। সে (হুদ) বলল, ‘হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! আমি নির্বোধ নই। বরং আমি রাব্বুল আলামিনের রাসূল। আমার রবের বাণী তোমাদের কাছে পৌঁছাই এবং আমি তোমাদের এমন হিতাকাক্সক্ষী, যার যাকে বিশ্বাস করা যেতে পারে।’ (সূরা আরাফ : ৬৭-৬৮)। আর সালেহ এ কথা বলতে বলতে তাদের জনপদ থেকে বের হয়ে গেল, ‘হে আমার সম্প্রদায়! আমার রবের বাণী আমি তোমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলাম এবং আমি তোমাদের জন্য যথেষ্ট কল্যাণ কামনা করেছি। কিন্তু তোমরা তো নিজেদের হিতাকাক্সক্ষীকে পছন্দই কর না।’ (সূরা আরাফ : ৭৯)।
নবীগণ ছিলেন মানবতার মহান বন্ধু ও কল্যাণকামী
‘তাদের আমি ইমাম বানিয়েছি, যারা আমার হুকুমে মানুষকে হিদায়াত করতেন। আর আমি তাদের প্রতি নেক কাজ করা, নামাজ কায়েম করা ও জাকাত দেয়ার জন্য অহি পাঠিয়েছি। তারা আমারই ইবাদতকারী ছিল।’ (সূরা আম্বিয়া : ৭৩)। ‘হে নবী! আমি তো আপনাকে দুনিয়াবাসীর জন্য রহমত হিসেবে পাঠিয়েছি।’ (সূরা আম্বিয়া ১০৭)।
সহকর্মীদের সাথে নেতৃত্বের আচরণ
চরিত্র ও কর্মের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। যোগ্য উত্তরসূরি তৈরি করতে মর্যাদার অনুভূতি সহকারে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন জরুরি। পর্যবেক্ষণ ও ইহতেসাবের মাধ্যমে যোগ্যতার বিকাশ সাধন করতে হবে। যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী দায়িত্ব বণ্টন এবং পরামর্শভিত্তিক কাজ করতে হবে। কোমলতা, সহজতা, ক্ষমা ও বিনয়ের গুণে গুণান্বিত হতে হবে।
সাফল্যের জন্য নেতাকর্মীদের মধ্যে যে অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা আবশ্যক
কথা ও কাজের মিল থাকা। ‘হে মুমিনগণ! তোমরা এমন কথা কেন বল, যা নিজেরা কর না? আল্লাহর কাছে এটা অত্যন্ত অসন্তোষজনক কাজ যে, তোমরা এমন কথা বল, যা কর না।’ (সূরা সফ : ২-৩)।
চরিত্র ও মাধুর্য
আল্লাহর পথে যারা কাজ করে, তাদের উদার হৃদয় ও বিপুল হিম্মতের অধিকারী হতে হবে, সৃষ্টির প্রতি সহানুভূতিশীল ও মানবতার দরদী হতে হবে। তাদের হতে হবে ভদ্র ও কোমল স্বভাবসম্পন্ন, আত্মনির্ভরশীল ও কষ্টসহিষ্ণু, মিষ্টভাষী ও সদালাপী। তাদের দ্বারা কোনো ক্ষতি হবে এমন কোনো ধারণাও যেন কেউ পোষণ করতে না পারে এবং তাদের কাছ থেকে কল্যাণ ও উপকার সবাই কামনা করবে। তারা নিজেদের প্রাপ্যের চাইতে কর্মের ওপর সন্তুষ্ট থাকবে এবং অন্যকে তার প্রাপ্যের চাইতে বেশি দিতে প্রস্তুত থাকবে। তারা মন্দের জবাব ভালো দিয়ে দেবে অথবা কমপক্ষে মন্দ দিয়ে দেবে না। তারা নিজেদের দোষ-ত্রুটি স্বীকার করবে এবং অন্যের গুণাবলীর কদর করবে। তারা অন্যের দুর্বলতার প্রতি নজর না দেয়ার মতো বিরাট হৃদয়পটের অধিকারী হবে, অন্যের দোষ-ত্রুটি ও বাড়াবাড়ি মাফ করে দেবে এবং নিজের জন্যে কারোর ওপর প্রতিশোধ নেবে না। কোনো দল পূর্ণাঙ্গরূপে এ গুণাবলীর অধিকারী হয়ে কোনো মহান উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্যে সুসংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা চালালে দেশের পর দেশ তার করতলগত হতে থাকে এবং দুনিয়ার কোনো শক্তিই তাকে পরাজিত করতে সক্ষম হয় না।
ধৈর্য
# তাড়াহুড়া না করা, নিজের প্রচেষ্টার ত্বরিত ফল লাভের জন্য অস্থির না হওয়া এবং বিলম্ব দেখে হিম্মত হারিয়ে না বসা।
# তিক্ত স্বভাব, দুর্বল মত ও সংকল্পহীনতার রোগে আক্রান্ত না হওয়া।
# বাধা-বিপত্তির বিরোচিত মোকাবিলা করা এবং শান্তচিত্তে লক্ষ্য অর্জনের পথে সব দুঃখকষ্ট বরদাশত করা।
# দুঃখ-বেদনা, ভারাক্রান্ত ও ক্রোধান্বিত না হওয়া এবং সহিষ্ণু হওয়া।
# সকল প্রকার ভয়ভীতি ও লোভ-লালসার মোকাবিলায় সঠিক পথে অবিচল থাকা।
প্রজ্ঞা
# মানবিক মনস্তত্ত্ব অনুধাবন করে সেই অনুযায়ী মানুষের সাথে ব্যবহার করা এবং মানুষের মনের ওপর নিজের দাওয়াতের প্রভাব বিস্তার করে তাকে লক্ষ্য অর্জনে নিয়োজিত করার পদ্ধতি অবগত হওয়া।
# নিজের কাজ ও তা সম্পাদন করার পদ্ধতি জানা এবং তার পথে আগত সব বাধা-বিপত্তি, প্রতিবন্ধকতা-বিরোধিতার মোকাবিলা করা।
# পরিস্থিতির প্রতি নজর রাখা, সময়-সুযোগ অনুধাবন করা এবং কোন সময়ে কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে, এসব জানাও প্রজ্ঞারই পরিচয়।
# দীনের ব্যাপারে সূক্ষ্ম তত্ত্বজ্ঞান ও দুনিয়ার কাজ-কারবারের ক্ষেত্রে তীক্ষè দূরদৃষ্টি রাখা।
(ইসলামী আন্দোলন সাফল্যের শর্তাবলী)
ভ্রান্তির অপনোদন
ইসলামী আন্দোলনের সফলতার ব্যাপারে ভ্রান্তি লক্ষ করা যায়। সফলতার বিশ্লেষণ এবং আকাক্সক্ষার ক্ষেত্রে আল কুরআনের বক্তব্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন সাফল্য অর্জনই ইসলামী আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। ‘আল্লাহ তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন এবং তোমাদের এমন সব বাগানে প্রবেশ করাবেন যার নিচ দিয়ে ঝর্ণাধারা বয়ে চলবে। আর চিরস্থায়ী বসবাসের জায়গা জান্নাতের মধ্যে তোমাদেরকে সর্বোত্তম ঘর দান করবেন। এটাই বড় সফলতা।’ (সূরা সফ : ১২)।
দুনিয়াবী পরাজয়কে পাত্তা দেয়া হয়নি
বহু নবী (আ.) দীন কায়েম করতে পারেননি। তারা কি ব্যর্থ? যেনতেন বা সাময়িক সাফল্যকে দীনের বিজয় বোঝায় না। এটা একটা আমূল পরিবর্তনকে বোঝায়। দুনিয়াতেও সাফল্যের প্রতিশ্রুতি আল্লাহ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎকাজ করবে, তাদের তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদের দান করেছিলেন। তাদের জন্য তাদের দীনকে মজবুত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করবেন, যা আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের (বর্তমান) ভয়ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা শুধু আমার ইবাদত করুক এবং আমার সাথে কাউকে যেন শরিক করবে না। আর যারা এরপর কুফরি করবে, তারাই সত্যত্যাগী।’ (সূরা নূর : ৫৫)। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি হচ্ছে, তিনি খিলাফত দিবেন। কিন্তু কখন দিবেন এটা একান্ত তাঁর এখতিয়ার। এমনকি এই এখতিয়ার নবীকেও দেয়া হয়নি। এটা জোর করে আদায় করার বিষয় নয়। এটা সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছাধীন। প্রকৃত মুমিন হওয়া এবং সৎকাজ অব্যাহত রাখা আমাদের দায়িত্বের অংশ।
বল, ‘আল্লাহর অনুগত হও এবং রাসূলের আনুগত্য মেনে চল। কিন্তু যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে ভালোভাবে জেনে রাখ, রাসূলের ওপর যে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, সেজন্য রাসূল দায়ী এবং তোমাদের ওপর যে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, সেজন্য তোমরাই দায়ী। তাঁর আনুগত্য করলে তোমরা নিজেরাই সৎ পথ পেয়ে যাবে, অন্যথায় পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীন হুকুম শুনিয়ে দেয়া ছাড়া রাসূলের আর কোনো দায়িত্ব নেই।’ (সূরা নূর : ৫৪)। সুতরাং আমাদের দায়িত্ব চূড়ান্ত চেষ্টা করা।
জামায়াতে ইসলামীর অনন্য ভূমিকা
প্রতিষ্ঠার পর থেকে জামায়াতে ইসলামী আল্লাহ তায়ালার দাসত্ব এবং রাসূলের আনুগত্যের ভিত্তিতে সংগঠন পরিচালনা করে আসছে। মানুষের কাছে ইসলামের সুমহান আহ্বান পৌঁছিয়ে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশে দীন প্রতিষ্ঠার জন্য জনমত তৈরির কাজ করছে। আলহামদুলিল্লাহ, এ কাজে জামায়াতে ইসলামীর উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন রয়েছে।
# সম্মানিত আলেম সমাজের মধ্যে সাংগঠনিক জীবনের প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি তৈরি হয়েছে।
# তাফসির, সাহিত্য ও ব্যক্তিগত দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসারসহ ইসলামী আন্দোলন প্রসঙ্গে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে।# সারা দুনিয়ায় এ কাফেলার লোকেরা ছড়িয়ে পড়েছে।
# শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে অজ্ঞতা, কুসংস্কার দূর ও দারিদ্র্যবিমোচনে আর্থসামাজিক উন্নতি সাধিত হয়েছে।
# বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নবী-রাসূলদের অনুসরণে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
# আল্লাহর হিদায়াতের ওপর দৃঢ়ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত সংগঠন হিসেবে শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন ও সমর্থন তৈরি হয়েছে।
# আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আখিরাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে জান-মালের কুরবানির এক নবদৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। তবে প্রকৃত সফলতা হচ্ছে দুনিয়ায় দীনের কাজ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আখিরাতে নিজেদের মুক্তি। দুনিয়ায় রাজনৈতিক অর্জন মহান আল্লাহর উপহারস্বরূপ। আমাদের কাজ হচ্ছে দীন ইসলামের পথে নিরন্তর সংগ্রাম করে যাওয়া। সর্বশক্তি দিয়ে সবকিছুর ওপরে দীন কায়েমকে গুরুত্ব দিয়ে অবিরাম প্রচেষ্টা চালানো, আল্লাহর সাহায্য লাভের উপযোগী হওয়ার চেষ্টা করা এবং সবর ও তাওয়াক্কুল করা। কবে হবে? দেরি হয়ে যাচ্ছে, বিভিন্ন মানসিক দুর্বলতায় ভোগা এবং অস্থিরতা প্রদর্শন করা কাম্য নয়। ( চলবে)