আসুন আমরা কিছু সময়ের জন্য ফিরে যাই আল্লাহর রাসূল (সা) এর যুগে উহুদ যুদ্ধের সময়কালে। দিনটি ছিলো ৬২৫ সালের ১১ মার্চ। আবু সুফিয়ান মক্কা থেকে ৩০০০ সৈন্যের এক সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে রওনা হলেন মদিনা আক্রমণে। এই বাহিনীর সাথে ৩,০০০ উট ও ২০০টি ঘোড়া ছিল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবাসহ মক্কার ১৫জন নারীও যুদ্ধক্ষেত্রে আগমন করে। কুরাইশ নেতাদের ধারণা ছিল যে নারীরা সাথে থাকলে তাদের সম্মান রক্ষার জন্য বেশি আমরণ লড়াইয়ের উদ্দীপনা তৈরী হবে। তারা সরাসরি মদিনা আক্রমণ না করে শহরের নিকটে আকিক উপত্যকা অতিক্রম করে কিছুটা ডানে উহুদের নিকটবর্তী আয়নাইনে শিবির স্থাপন করে।
যুদ্ধযাত্রার খবর মুহাম্মাদ (সা) এর কাছে পৌছায়। এরপর মদিনার বিভিন্ন স্থানে আকস্মিক আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য অনেকে নিয়োজিত হয়। যুদ্ধের জন্য গ্রহণীয় পদক্ষেপ নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় রাসূল (সা) নিজের দেখা একটি স্বপ্নের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর শপথ আমি একটি ভালো জিনিস দেখেছি। আমি দেখি যে কতগুলি গাভী জবাই করা হচ্ছে। আরো দেখি যে আমার তলোয়ারের মাথায় কিছু ভঙ্গুরতা রয়েছে। আর এও দেখি যে, আমি আমার হাত একটি সুরক্ষিত বর্মের মধ্যে ঢুকিয়েছি’। এর ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি বলেন যে কিছু সাহাবি নিহত হবে, তলোয়ারের ভঙ্গুরতার অর্থ তার পরিবারের কেউ শহীদ হবে এবং সুরক্ষিত বর্মের অর্থ মদিনা শহর।
যুদ্ধ কীভাবে হবে? কী পদক্ষেপ নেয়া হবে এই নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে দুই ধরনের মতামত আসে। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও মুহাম্মাদ (সা) সহ কারো কারো মত ছিল শহরের ভেতর থেকেই প্রতিরোধ করা। কারণ মদিনা সুরক্ষিত শহর ছিল এবং প্রতিপক্ষ নিকটবর্তী হলে সহজে তাদের আক্রমণ করা যেত এবং নারীরা ছাদের উপর থেকে ইট পাটকেল ও তীর ছুড়তে পারতো। অন্যদিকে হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবসহ কিছু বিজ্ঞ সাহাবি ভিন্নমত দেন। তাদের দাবি ছিল এভাবে শহরের ভেতর থেকে প্রতিরক্ষা করলে শত্রুর মনোবল বৃদ্ধি পাবে এবং অগ্রসর হয়ে খোলা ময়দানে লড়াই করলে ভবিষ্যতে তারা সহজে আক্রমণ করতে সাহস করবে না।
বহু আলোচনার পর মদিনার বাইরে গিয়ে শত্রুর মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মুসলিম বাহিনীর মোট সেনাসংখ্যা ছিল ১,০০০। এর মধ্যে ১০০ জন বর্ম পরিহিত ছিল এবং ৫০ জন ছিল অশ্বারোহী। মুহাম্মাদ (সা) মুসলিম বাহিনীকে তিনভাবে বিভক্ত করেন। এগুলি হল, মুহাজির বাহিনী, আউস বাহিনী ও খাজরাজ বাহিনী। এই তিন বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন যথাক্রমে মুসআব ইবনে উমায়ের, উসাইদ ইবনে হুজাইর ও হুবাব ইবনে মুনজির।
প্রায় ১,০০০ মুসলিমের বাহিনী মদিনা থেকে যুদ্ধের জন্য বের হয়। তারা শাওত নামক স্থানে পৌছানোর পর ইতিপূর্বে শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধে অস্বীকৃতি জানানো আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার ৩০০ অনুসারী নিয়ে দলত্যাগ করে। এর ফলে ৭০০ সৈনিক নিয়ে মুসলিমরা উহুদের দিকে যাত্রা করে। এতে মুসলিম সেনাদলের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকের মনোবল ভেঙে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আল্লাহ তাঁর তিন হাজার ফেরেশতা নামিয়ে দিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন, এটা কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয়?
শুরুর দিকে মুসলিমরা এগিয়ে থাকলেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়োজিত তীরন্দাজদের ভুলে মুসলিম সেনাবাহিনী উহুদ যুদ্ধে পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছিলো। রাসূল (সা) মৃত্যুবরণ করেছেন, এমন সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো। এই খবর উহুদ ময়দান থেকে মদিনায়ও ছড়িয়ে গেলো।
এমন খবরে উহুদ ময়দান ও মদিনায় মানুষের মধ্যে তিনটি শ্রেণি তৈরি হলো।
১- মুনাফিক : এরা আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে নিয়ে হাসি ঠাট্টা শুরু করলো। আল্লাহ ও ফেরেশতা নিয়ে ব্যঙ্গ করতে লাগলো। মুমিনদের তিরস্কার করতে লাগলো।
২- ব্যাধিগ্রস্থ মুমিন : এরা হতাশা প্রকাশ করতে থাকলো। বলতে লাগলো, আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ঠিক ছিলো। রাসূলের সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো। তারা এও বলেছিলো মুহাম্মদ (সা) আমাদের সাথে প্রতারণা করেছে। আমাদের বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অথচ আল্লাহ চাইলে ফেরেশতা পাঠিয়ে আমাদের বিজয় দিতে পারতো। তারা আল্লাহর রাসূলের নবুয়্যত নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
৩- মুমিন : এই শ্রেণি আল্লাহর রাসূলের নিরাপত্তা নিয়ে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছিলো। এদের মধ্যে যারা আল্লাহর রাসূলের কাছাকাছি ছিলো তারা মানববর্ম তৈরি করে রাসূল (সা)কে তীরের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলো। যারা দূরে ছিলো তারা চিৎকার করে বললো আমি কেন মারা গেলাম না? আজ আমি আল্লাহর কাছে কী জবাব দেব? তারা আল্লাহর রাসূলের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আবারো ঘুরে দাঁড়ালেন।
অবশেষে জানা গেলো আল্লাহর রাসূল (সা) শাহদাতবরণ করেননি। তিনি একটু সুস্থ হওয়ার পর মক্কার বাহিনীর পিছু ধাওয়া করার জন্য সেনাবাহিনীকে আবার একত্রিত করেন এবং প্রায় ৬০০ সৈন্যের সেনাবাহিনীকে পাঠান মক্কার বাহিনীকে ধাওয়া করার জন্য।
যাই হোক, উহুদ যুদ্ধে বিপর্যয়ের কারণে আরবের মুশরিক সম্প্রদায়, ইহুদি ও মুনাফিকদের স্পর্ধা ও দুঃসাহস বেড়ে গিয়েছিল। তাদের মনে আশা জেগেছিল, তারা ইসলাম ও মুসলমানদেরকে নির্মূল করতে সক্ষম হবে। উহুদের পরে প্রথম বছরে যেসব ঘটনা ঘটে তা থেকেই তাদের এ ক্রমবর্ধমান স্পর্ধা ও ঔদ্ধত্য আন্দাজ করা যেতে পারে।
উহুদ যুদ্ধের পরে দু’মাসও অতিক্রান্ত হয়নি এমন সময় দেখা গেল যে, নজদের বনী আসাদ গোত্র মদীনার ওপর আক্রমন করার প্রস্তুতি চালাচ্ছে। তাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আবু সালামার নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠান। সেখানেও মুসলিমদের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। তবে বনী আসাদ পালিয়ে যায়।
তারপর ৪ হিজরীর সফর মাসে আদাল ও কারাহ গোত্রদ্বয় তাদের এলাকায় গিয়ে লোকদেরকে দীন ইসলামের শিক্ষা দেবার জন্য নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কয়েকজন লোক চায়। নবী (সা) ছ’জন সাহাবীকে তাদের সংগে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু রাজী’ (জেদ্দা ও রাবেগের মাঝখানে) নামক স্থানে পৌঁছে তারা হুযাইল গোত্রের কাফেরদেরকে এ নিরস্ত্র ইসলাম প্রচারকদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। তাঁদের মধ্য থেকে চারজনকে তারা হত্যা করে এবং দু’জনকে (হজরত খুবাইব ইবনে আদী ও হযরত যায়েদ ইবনে দাসিন্নাহ) নিয়ে মক্কায় শত্রুদের হাতে বিক্রি করে দেয়। পরে মক্কার কুরাইশরা তাদের হত্যা করে।
তারপর সেই সফর মাসেই আমের গোত্রের এক সরদারের আবেদনক্রমে রাসূলুল্লাহ (সা) আরো একটি প্রচার দল পাঠান। এ দলে ছিলেন চল্লিশ জন (অথবা অন্য উক্তি মতে ৭০ জন) আনসারি যুবক। তাঁরা নজদের দিকে রওনা হন। কিন্তু তাদের সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়। বনী সুলাইমের ‘উসাইয়া, বি’ল ও যাক্ওয়ান গোত্রত্রয় বি’রে মা’ঊনাহ নামক স্থানে অকস্মাত তাদেরকে ঘেরাও করে সবাইকে হত্যা করে ফেলে।
এ সময় মদীনার বনী নাযীর ইহুদি গোত্রটি সাহসী হয়ে ওঠে এবং একের পর এক প্রতিশ্রুতি ভংগ করতে থাকে। এমনকি চার হিজরীর রবিউল আউয়াল মাসে তারা স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শহীদ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে। তারপর ৪ হিজরীর জমাদিউল আউয়াল মাসে বনী গাত্ফানের দু’টি গোত্র বনু সা’লাবাহ ও বনু মাহারিব মদিনা আক্রমণের প্রস্তুতি চালায়। তাদের গতিরোধ করার জন্য স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেই তাদের বিরুদ্ধে এগিয়ে যেতে হয়। এভাবে উহুদ যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে মুসলমানদের ভাবমর্যাদা ও প্রতাপে যে ধ্বস নামে, ক্রমাগত সাত আট মাস ধরে তার আত্মপ্রকাশ হতে থাকে।
এই সময়েও সেই তিন শ্রেণি সক্রিয় থাকে মদিনায়
১- মুনাফিক : এরা মদিনা ধ্বংস করার ব্যাপারে একের পর এক ষড়যন্ত্র করতে থাকে। বিভিন্ন ইহুদী গোত্রকে মুহাম্মদ (সা) এর সাথে চুক্তি ভঙ্গ করার জন্য মন্ত্রনা দেয়। মক্কার কুরাইশদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে ও তাদের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করে। মুমিনদের তিরস্কার ও আল্লাহর রাসূল সম্পর্কে কটূক্তি করতে থাকে।
২- ব্যাধিগ্রস্থ মুমিন : এরা হতাশা প্রকাশ করতে থাকে। আল্লাহর রাসূলের প্রতিটি কথাকে অবিশ্বাস করতে থাকে। নিজেদের সম্পদ পরিবার রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা মুহাম্মদকে প্রতারক পর্যন্ত বলেছে। আল্লাহর রাসূলের প্রতিটি সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করতে থাকে। ৬ জন ও ৭০ জন দায়ি শাহদাতবরণের ঘটনায় তাঁকে অবিবেচক আখ্যা দেয়। তারা এও বলেছে, “আমাদের সাথে অংগীকার করা হয়েছিল পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য জয় করা হবে কিন্তু এখন অবস্থা এমন যে আমরা পেসাব পায়খানা করার জন্যও বের হতে পারছি না।”
৩- মুমিন : এরা সর্বাবস্থায় ইসলামের জন্য নিজেদের উতসর্গ করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো। আল্লাহর রাসূল (সা)-কে অনুসরণ করেছিলো। তাঁর প্রতিটি নির্দেশ নিষ্ঠার সাথে পালন করেছিলো। বিপদে, মুশরিকদের আক্রমণে অবিচল থেকেছে ও সাহসের সাথে মোকাবিলা করেছে। মুনাফিকদের তিরস্কার এবং ব্যাধিগ্রস্থ মুমিনদের আচরণে ধৈর্যধারণ করেছে।
উহুদের পরিস্থিতি আমাদের মধ্যে অর্থাৎ উম্মাহর মধ্যে বার বার আসবে। আল্লাহ তায়ালা দেখতে চান কে সত্যিকারের ঈমানদার। আজ আমাদের বিবেচনার বিষয় আমি কোন শ্রেণিতে পড়েছি। আমার অবস্থান কোথায়? আমি কি ঈমানদারদের কাতারে আছি? এখন আত্মসমালোচনা করার সময়। ঈমানদার হিসেবে আমাদের উচিত ধৈর্যধারণ করা এবং হকের উপদেশ দেয়া। তাগুতের মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ থাকা ও নেতৃত্বের প্রতি অনুগত থাকা। আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা আমাদের সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে রাখুন। আমাদের হিদায়াতের পথে রাখুন।