রাসূলুল্লাহ্ (সা.) আমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। কুরআনের ভাষায় ‘উস্ওয়াতুন হাসানাহ্’। রাসূল সা: এর জীবনের প্রতিটি দিক ও পর্যায়ে আমাদের জন্য রয়েছে অমূল্য শিক্ষণীয়। তাঁর ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক তথা সামগ্রীক জীবন ধারা আমাদের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। তাঁর প্রাত্যহিক জীবনের দুঃখ-কষ্ট-নির্যাতন কিংবা আনন্দ-অনুভুতি সবই তাৎপর্যমন্ডিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, রাসূল সা. মিষ্টি খেতে পছন্দ করতেন এই কথাটি আমরা যেভাবে মনে রাখি, রাসূল সা: অনাহারে-অর্ধাহারে থেকেছেন সেই কথাটি আমরা তেমনি বেমালুম ভুলে যাই। রাসূল সা: এর জীবনধারা তথা ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামমুখর পথ আদৌ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, বরং ছিল কণ্টকাকীর্ণ। দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়েই তাঁর জীবনের শুরু, দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়েই চলতে থাকে তাঁর আদর্শিক লড়াই। এমনকি ইসলামী জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠার পরও তাঁকে সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট পোহাতে হয়। রাসূল সা: এর জীবনের সেই সব দিক নিয়েই এখানে আমরা যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা তুলে ধরতে প্রয়াসী হবো।
পৃথিবীতে তাঁর আগমণের পূর্বেই যেন তাঁর জন্য দুঃখের পাহাড় গড়ে উঠে। জন্মের ছয় মাস পূর্বেই তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। একটি শিশু পৃথিবীর মুখ দেখল অথচ তাঁর পিতাকে দেখতে পর্যন্ত পারল না দুঃখ-দুর্দশার জন্য এর চাইতে বড় কোন ঘটনার কি প্রয়োজন রয়েছে? উপরন্তু জন্মের ছয় বছর হতে না হতেই মায়ের সাথে বাবার কবর যিয়ারত করতে গিয়ে পৃথিবীর বুক থেকে সেই মমতাময়ী মাকেও হারান আমাদের প্রিয় রাসূল সা.। আমরা জানি, আরবের প্রথা অনুসারে দুধ মা হযরত হালিমার গৃহে লালিত-পালিত হয়েছিলেন শিশু মুহাম্মদ। অর্থাৎ আপন মায়ের স্নেহ-মমতা বেশী দিন তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। চাচা আবু তালিবের ছত্র-ছায়ায় শৈশব-কৈশোর অতিক্রম করে তিনি পূর্ণ যুবকে পরিণত হন। এমন সময় চিন্তার রেখা দেখা দেয় তাঁর কপালে। তিনি ভাবেন কিভাবে পথহারা মানুষদেরকে পথের দিশা দেয়া যায়। দুঃখী মানুষের জন্য তাঁর দরদ যেন উথলে উঠে। হিলফুল ফুযুল গঠন করেও তিনি অন্তরের প্রত্যাশা পুরণ করতে সক্ষম হন নি।
অবশেষে হেরা গুহায় গিয়ে কেমন জানি ধ্যান মগ্ন থাকতেন হযরত মুহম্মদ সা:। সীরাতে রাসূল সা: থেকে আমরা জানতে পারি, দিকভ্রান্ত মানবতার কথা চিন্তা করে মাঝে মাঝে রাসূল সা: এর অবস্থা এমন হতো যে, তিনি যেন পাহাড়ের উপর থেকে নীচে ঝাঁপ মারবেন। আর তখনই তিনি ‘ইন্নাকা রাসূলাল্লাহ (নিশ্চই আপনি আল্লাহর রাসূল)’ -এই আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়াতেন। এভাবে তিনি ৪০ বছর বয়সে নবুওত পেলেন। নবুওত প্রাপ্তির পর পর তিনি যখন ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন তখনই যেন বাধার এক-একটি প্রাচীর তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতে লাগল। গোপন দাওয়াত অতঃপর প্রকাশ্য দাওয়াত শুরু হওয়ার পর পরই নির্যাতন-নিপীড়নের স্টীম রোলার পরিচালিত হতে থাকল রাসূল সা. ও তাঁর সাহাবীগণের উপর। ঠাট্টা-বিদ্রুপ, গালি-গালাজ, নির্যাতন-নিপীড়ন কোন কিছুই বাদ দেয়নি কাফেররা। তাঁকে কখনো কবি বলেছে, কখনো যাদুকর বলেছে, এমনকি পাগল পর্যন্ত বলেছে। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনুল কারীমে ‘নিশ্চই তোমাদের সঙ্গী (মুহাম্মদ) পাগল নন’ বলে এর প্রতিবাদ করেছেন।
প্রসঙ্গত: বলে রাখি, আজকের যুগে রাসূল সা. এর আগমণ ঘটলে বিরোধী মতাবলম্বীরা তাঁকে মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক কিংবা জঙ্গী বলতে মোটেই দ্বিধাবোধ করত না। যা হোক, রাসূল সা. ভেবেছিলেন যেই তায়েফে তাঁর শৈশবকাল অতিবাহিত হয়েছে সেই তায়েফের অধিবাসীরা নিশ্চই তাঁর কথা শ্রবণ করবে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী তায়েফের কর্তাব্যক্তিরা কিভাবে তাদের যুবক ছেলেদেরকে রাসূল সা. এর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছিল। তারা পাথর মেরে মেরে রাসূল সা. এর গোটা শরীর রক্তাক্ত করে দিয়েছিল। তাঁর শরীর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে পা আর জুতো জমাট বেঁধে গিয়েছিল। এক পর্যায়ে রাসূল সা. বেহুশ হয়ে পড়লেন। একটু হুশ ফিরে এলে আবার তাঁকে পাথর দিয়ে আঘাত করতে থাকে। এভাবে তায়েফে রাসূল সা. কয়েক বার বেহুশ হয়ে যান। আল্লাহ পাকের ফেরেস্তা (হযরত জীবরাঈল আ.) এসে তায়েফবাসীকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার আদেশ কামনা করেছিলেন। পক্ষান্তরে রাহমাতুল আলম রাসূলে করীম সা. তাদের কল্যাণ কামনা করে দোয়া করেছিলেন-এদের জ্ঞান দাও প্রভু, এদের ক্ষমা করো। এপ্রেক্ষিতে এক দিনের ঘটনা। হযরত আয়শা রা. রাসূলের পিঠে তৈল মালিশ করছিলেন। তিনি দেখলেন রাসূলের পিঠে আবছা কালো কালো দাগ। এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে রাসূল সা: বলেন, আয়শা! এ ব্যাপারে আমাকে আর জিজ্ঞাসা করো না। তায়েফের প্রান্তরে যুবক ছেলেরা পাথর মেরে আমাকে কী হাল করেছিল এগুলো তারই চিহ্ন। রাসূল সা: আরো বলেন, তায়েফে আমাকে যে কষ্ট দেয়া হয়েছে পূর্বোক্ত নবীদের কাউকে এমন কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়নি।
রাসূল সা: এর সাথে তাঁর সাহাবীগণও সীমাহীন জুলুমের শিকার হয়েছিলেন। হযরত বিলাল রা. কে মরুভুমির উত্তপ্ত বালুকারাশিতে শুইয়ে রেখে কিভাবে নির্যাতন চালানো হয়েছে তা আমরা জানি। এছাড়া হযরত সুমাইয়া রা, হযরত খাব্বাব রা, হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসীর রা: প্রমুখ সাহাবীদের উপর যে অকথ্য নির্যাতন চালানো হয় তা বর্ণনা করার ভাষা আমাদের জানা নেই। নির্যাতনের মুখে শেষ পর্যন্ত তাঁরা শহীদ হন। এভাবে নির্যাতনের এক পর্যায়ে রাসূল সা. তাঁর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে ‘শিয়াবে আবু তালিব’ নামক উপত্যকায় নির্বাসিত হন। তাদের নিকট খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে সর্বাত্মক বয়কট আরোপ করে মক্কার নির্দয় কাফের-মুশরেকরা। অন্তত: তিন বৎসর তাঁদের এই নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁদেরকে গাছের পাতা ও ছাল খেয়ে জীবন ধারণ করতে হয়।
নির্বাসিত জীবন শেষ হলেও রাসূল সা: এর জীবনে শুরু হয় আরেক দুঃখজনক অধ্যায়। একই বৎসর মারা যান রাসূল সা. এর সাহায্যকারী চাচা আবু তালিব, ইন্তেকাল করেন জীবন সঙ্গীনী হযরত খাদীজা রা:। এভাবে রাসূল হয়ে যান সহায়হীন ও শোকাহত। ঐতিহাসিকগণ এ সময়টিকে রাসূল সা: এর জন্য ‘ইয়াওমুল হুযন্’ (দুঃখের বছর) বলে অভিহিত করেন। এহেন পরিস্থিতিতে রাসূল সা: এর প্রতি মুশরেকদের শত্রুতামূলক কার্যক্রম আরো তুঙ্গে উঠতে লাগল। তারা কখনো উটের নাড়ী-ভুড়ি চাপিয়ে শ্বাসরোধ করে রাসূল সা.কে হত্যা করতে উদ্যত হয় আবার কখনো প্রকাশ্যেই রাসূল সা.কে হত্যার ঘোষণা প্রদান করে। এভাবে হত্যা করতে এসে ইসলাম কবুল করেছিলেন পরবর্তীতে ইসলামের ২য় খলীফা হযরত উমর রা.। অত্যাচারের সীমা যখন চরমে পৌঁছল রাসূল সা: তাঁর নির্যাতিত সাহাবীদের অনেককেই পাঠিয়ে দিলেন আবিসিনিয়ায় (বর্তমানে আফ্রিকার ইথিওপিয়া)। তার কিছু দিন পর তিনি নিজেও আল্লাহ্র পক্ষ থেকে আদিষ্ট হন মদীনায় (তৎকালীন ইয়াসরিবে) হিজরতের জন্য। মদীনায় হিজরতকালে রাসূল সা: জন্মভুমি মক্কার দিকে বারবার ফিরে তাকান আর বলেন, হে জন্মভূমি মক্কা! তোমার বুক থেকে চলে যাওয়ার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না। কাফের-মুশরেকরা তোমার কোলে আমাকে থাকতে দিল না বলেই আমি চলে যাচ্ছি। এভাবে রাসূলের হৃদয়টা ব্যথায় উঠে ভরে, চোখ থেকে কেবলই তাঁর অশ্রু ঝরে পড়ে।
দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মদীনায় গমন করেন রাসূল সা:। তারপরও তাঁর জীবনের কষ্টকর অধ্যায়ের কোন পরিসমাপ্তি ঘটেনি। দুঃখতো পিছু ছাড়েইনি, বরং জীবনের ঝুঁকি আরো প্রবল হয়। মদীনার জীবনে তাঁকে মোকাবেলা করতে হয় বহুসংখ্যক যুদ্ধ-বিগ্রহের। বদর, ওহুদ, খন্দক- এমন বহুসংখ্যক যুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন স্বয়ং রাসূল সা:। বদর যুদ্ধে তিনি কিভাবে মুসলিম বাহিনীকে সংগঠিত করেছিলেন তা বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় দেদীপ্যমান হয়ে থাকবে চিরকাল। তুলনামূলক ক্ষুদ্র অথচ সুসংগঠিত মুসলিম বাহিনী সহকারে ময়দানে উপস্থিত হয়ে তিনি আল্লাহ্র কাছে বিজয় কামনা করে দোয়া করেছিলেন। ওহুদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর একাংশের গাফিলতির ফলে পুরো মুসলিম বাহিনীর উপর বিপর্যয় নেমে আসে। এমতাবস্থায় কাফের-মুশরেকদের আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হন স্বয়ং ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা.। কিছু সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম মানব প্রাচীর রচনা করে রাসূল সা.কে হেফাজতের প্রাণপণ চেষ্টায় নিয়োজিত থাকেন। তবুুও রাসূল সা. এর দাঁত মুবারক শহীদ হয়। তাঁর পরিহিত লোহার শিরস্ত্রাণ আঘাত পেয়ে কপালে ঢুকে যায়। তা টেনে উঠালে কপাল থেকে ফিনকী দিয়ে রক্ত নির্গত হয়ে আসে। এদিকে খন্দকের যুদ্ধে রাসূল সা: নিজ হাতে পরিখা খনন কাজে ব্যাপৃত হয়েছিলেন। পরিখা খননে রাসূল সা: ও তাঁর সাহাবাগণ সবাই অমানুষিক পরিশ্রম করেছিলেন। সীরাতে রাসূলের ইতিহাস থেকে আমরা দেখি মক্কা বিজয়ের পরও রাসূল সা: কে অনেক যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়েছে। হুনাইন, মুতা ও তাবুকের যুদ্ধ ছিল সেরকমই যুদ্ধ। মুতার যুদ্ধে তিনজন বিখ্যাত মুসলিম সেনাপতিকে শহীদ হতে হয়েছিল। তাবুকের যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য এক দুঃসাহসিক পদক্ষেপ। তদানীন্তন রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের সরাসরি নেতৃত্বে লাখ লাখ রোমান সৈন্যের মোকাবিলায় মাত্র ৩০ হাজার মুসলিম সৈন্য নিয়ে রাসূল সা: যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। অবশেষে বিজয় হয়েছিল মুসলিম বাহিনীর।
কেবল যুদ্ধ বিগ্রহই রাসূল সা:কে ভারাক্রান্ত করে রেখেছে ব্যাপার তা নয়। বরং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনেও তাঁকে দুঃখের অথৈ সাগর পাড়ি দিতে হয়েছে। তাঁর গোটা জীবনে তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে দু’বেলা পেট পুরে খেয়েছেন এমন দিন খুব কমই রয়েছে। এমনকি ক্ষুধার জ্বালায় তাঁকে পেটে পাথর পর্যন্ত বাঁধতে হয়েছে। তাঁর ছিল না আমাদের মতো এত জামা-কাপড়। জামা ছিঁড়ে গেলে নিজ হাতেই তালি দিতেন। অথচ আমরা তালিযুক্ত জামা পরিহিত লোক দেখলে তাকে কেমন আড়চোখে দেখে থাকি। প্রশ্ন জাগে, আমাদের মন-মানসিকতা এরূপ হলে রাসূল সা: এর সত্যিকার অনুসরণ কি করে সম্ভব? তিনি শুইতেন খেজুরের চাটাইয়ে। তাতে রাসূল সা. এর পিঠে চাটাইয়ের দাগ পড়ে যেত। তার ব্যবহৃত ঘরটি ছিল খুবই ছোট। আমাদের দেশের বস্তির লোকেরা যে ধরণের ছোট আকৃতির ঘরে থাকে রাসূল সা: এর ঘরটি ছিল সে রকমই। আমার জানামতে, হাজী সাহেবগণ এখনও সেই ঘর দেখার সৌভাগ্য লাভ করে থাকেন। আমাদের প্রিয় রাসূল সা.কে যাদু-টোনা পর্যন্ত করা হয়েছে। যদ্দরুন দিন দিন তাঁর শরীর খারাপ হচ্ছিল। এরূপ অবস্থায় তাঁর উপর সূরা ফালাক ও সূরা নাস নাযিল হয়। উপরোক্ত বিষয়গুলোকে গৌণ মনে না করে আমরা যারা রাসূল সা: এর অনুসারী হিসেবে দাবী করি তাদেরকে বিশ্বনবী সা: এর জীবনের এই দিকগুলো সম্পর্কে অবশ্যই অবগত হওয়া উচিত।
রাসূল সা: এর জীবনের একটি ঘটনা স্মরণ করাতে চাই। মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল সা: কয়েক জনকে ক্ষমা করা হবে না মর্মে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাদেরকে কতল করার নির্দেশও ছিল। তন্মধ্যে একজন ছিলেন হযরত হামযা রা: এর পৈশাচিক হত্যাকারী ওয়াহ্শী। কিন্তু কৌশলে ওয়াহ্শী রাসূল সা. এর দরবার পর্যন্ত পৌঁছে যান এবং ক্ষমা প্রত্যাশা করে ইসলাম কবুল করতে ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। অতঃপর রাসূল সা: তাকে ক্ষমা করেন এবং ইসলাম কবুল করাতে রাজী হন। রাসূল সা: তার কাছে হযরত হামযা রা:কে হত্যার ঘটনাটি একটু শুনতে চান। ওয়াহ্শী হযরত হামযা রা: এর কলিজা এফোঁড়-ওফোঁড় করার লোমহর্ষক ঘটনা বর্ণনা করছিলেন। রাসূল সা: তখন কাঁদছিলেন। তাঁর চোখের পানিতে দাড়ি মুবারক ভিজে ভিজে যাচ্ছিল। অতঃপর রাসূল সা: ওয়াহ্শী রা:কে শর্ত দিলেন বাকী জীবন যেন রাসূল সা: এর সাথে সাক্ষাৎ করতে না আসেন। কেননা, তাকে দেখলেই রাসূলের অন্তরে মনে হবে হযরত হামযা রা: এর সেই মর্মান্তিক ঘটনা যা বরদাস্ত করা তাঁর জন্য অত্যন্ত কঠিন।
এ পর্যায়ে পুণরোল্লেখ হলেও একটি ফেইসবুক স্ট্যাটাস থেকে রাসূল সা. এর জীবনধারার কিছু বাস্তবিক জ্ঞাতব্য বিষয় সুধী বৃন্দের খেদমতে তুলে ধরতে চাই। স্ট্যাটাসটিতে ‘আমাদের রাসূল সা: কেমন ছিলেন?’ শিরোনাম দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে- যিনি তাঁর সন্তানের মৃত্যুতে কেঁদেছেন। যিনি নিজের ছেঁড়া জামা নিজের হাতে সেলাই করেছেন। যিনি তাঁর স্ত্রীদের সাথে অভিমান করেছেন। যিনি যুদ্ধ করেছেন। যিনি যুদ্ধের ময়দানে নিহত সঙ্গীদের মাথা কোলে নিয়ে অঝোরে কেঁদেছেন। নিজে কবরে নেমে তাঁদের কবরস্থ করেছেন। প্রিয়তমা স্ত্রী খাদীজার মৃত্যুতে যার পর নাই ব্যথিত হয়েছেন। মাঝরাতে তাঁর কবরের পাশে গিয়ে অঝোরে কেঁদেছেন। তিনি আমাদেরই মতো একজন মানুষ। তিনিই আমাদের রাসূল সা:। দিনের পর দিন যার বাড়িতে চুলায় আগুন জ্বলতো না। পানি আর খেজুর খেয়ে মাসের পর মাস চলে যেত। একদা তিনি বসেছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে উমারের সাথে। তাদের সামনে পড়েছিল একটা খেজুর। রাসূল সা. সেটা তুলে নিলেন, পঁচা অংশটা পরিষ্কার করলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উমারকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি খাবেন কি না। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার নারাজি হলেন। রাসূল সা. বললেন, ইয়া আব্দুল্লাহ! তোমার কাছে এটা খাওয়া না খাওয়ার অপশান, কিন্তু আজ চার দিন হলো তোমার রাসূলের পেটে কিছু পড়েনি। (সুবহানাল্লাহ!) তিনিই আমাদের রাসূল সা.। হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর বাড়ীতে দাওয়াত খেতে বসে একটা রুটির উপর এক টুকরো গোস্ত দিয়ে আবু আইয়ুবকে বললেন, যাও এটা আমার কন্য ফাতিমাকে একটু দিয়ে এসো, সে এমন খাবার অনেক দিন খায়নি। তিনিই আমাদের রাসূল সা.।
ক্ষুধার্ত সাহাবী ক্ষুধার জ্বালায় পেটে পাথর দেখালে তিনি নিজের জামা তুলে দেখালেন তাঁর পেটে এর চাইতেও বেশী পাথর বাঁধা। যিনি কোন দিন এক তরকারীর বেশী দিয়ে আহার করেননি। যার একটার বেশী জামা ছিল না। যার ঘর ছিল মাটির, বালিশ ছিল খেজুরের ছোবলা। তিনিই আমাদের রাসূল সা. পরিশেষে বলব, রাসূল সা: কে তাঁর জীবনে যে দুঃখ-কষ্ট ও নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে এটা মূলতঃ ইসলামেরই বৈশিষ্ট্য। এটা নতুন কোন তথ্য নয়। ইসলামের পথে অবিচল থাকার দরুণ পূর্বোক্ত পয়গম্বরদের উপর যেমন নির্যাতনের স্টীম রোলার চালানো হয়েছে, রাসূল সা: এর পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরাম, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন এবং বর্তমানেও ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের উপর নির্যাতনের সেই চিরাচরিত ধারা অব্যাহত রয়েছে। অতএব, ইসলামের দাওয়াতী কাজে আত্মনিয়োগ করার পরেও কিংবা ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার নানাবিধ কর্মকান্ডে জড়িত হওয়ার পরেও যদি কেউ নির্বিঘ্ন জীবন যাপন করেন তাহলে তিনি বা তারা প্রকৃত অর্থে সুন্নাতে রাসূল সা: এর অনুসরণ থেকে বহু ক্রোশ দূরে অবস্থান করছেন। আমাদেরকে বুঝতে হবে তারা মূলতঃ পূর্ণাঙ্গ ইসলাম থেকে দূরে থেকে কোন সামান্য অংশের উপর আমল করছেন নতুবা তাঁদের কার্যক্রমে রয়েছে রাসূল সা. এর তরীকার স্পষ্ট খেলাফ।