থেলিস বলেছেন-”যে নিজেকে দমন করতে পারে না সে নিজের জন্যেও বিপদজনক এবং অন্য সবার জন্যেও। বাংলাদেশকে যারা কৌশলে শাসন করতে চায় সেই আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের প্রধান বাঁধা মনে করে সমাজের ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত জনগোষ্ঠিকে। যেহেতু যুব সমাজই পরিবর্তনের নিয়ামক শক্তি। এই শক্তিকে যদি মদ, জুয়া, নারী দিয়ে বুদ রাখা যায় তাহলে কোন প্রতিবাদী শক্তি জেগে ঊঠবেনা। কারণ পৃথিবীর পরিবর্তন হয়েছে যুব শক্তির উম্মাদনায়। এটি যদি ধ্বংস করা যায় তাহলে দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে কেউ রুখে দাঁড়াবেনা। মানবাধিকার,গণতন্ত্র,সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা আর কথার বলার অধিকার প্রতিষ্ঠার কোন আন্দোলন গজাবেনা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এখন পশ্চিমা সংস্কৃতির আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান। পশ্চিমারা যুব সমাজের চরিত্র ধ্বংস করার জন্য অশ্লীলতা, মদ, জুয়া ইত্যাদিকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। সেজন্য ক্যাসিনোর উত্থান। এটি শুধু দুর্নীতির নয় সমাজকে নিঃশেষ করার গভীর চক্রান্তেরও অংশ। আওয়ামী লীগ বিগত দিনে রাষ্ট্র যন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে যে ভয়ের সংস্কৃতি চালু করেছে তা দিয়ে আরো কয়েক যুগ শাসন করতে পারবে। সেই লক্ষ্যেই আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য তাহজীব-তমুদ্দুন, আইন, বিচার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সব ভেঙ্গে তছনছ করে দেয়া হচ্ছে। সুতরাং এক মহা ভয়ংঙ্কর দূর্যোগের ঘনঘটা হচ্ছে ক্যাসিনোর এই ভয়াল আক্রমণ।
ক্যাসিনো ইতালিয়ান শব্দ। ১৬৩৮ সালে ইতালির ভেনিসে সর্বপ্রথম জুয়ার মাধ্যমে ক্যাসিনো ব্যবসা শুরু হয়। ক্যাসিনোতে মদ, জুয়া, নাচ, গান ও যৌনতার সংমিশ্রণে বিভিন্ন খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকে। মূলত পশ্চিমা সংস্কৃতি; যা ইসলামী সংস্কৃতি এমনকি আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী। রাজধানী ঢাকার বুকে দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্র ক্যাসিনোর আড়ালে মদ, জুয়া ও যৌনতার মাধ্যমে যুবসমাজকে ধ্বংস করছে। মানবসমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য ইসলাম বহু আগেই মদ ও জুয়া হারাম করেছে।
ইসলামপূর্ব জাহেলি যুগেও জুয়া খেলার প্রচলন ছিল। তখন লোকেরা জুয়া-বাজি ইত্যাদিতে ভীষণ অভ্যস্ত ছিল। প্রায় সময় লোকেরা তাদের পরিবার ও সম্পদের ওপর বাজি ধরতো। হেরে গিয়ে চিন্তাক্লিষ্ট ও হতাশাগ্রস্ত হতো। সে দেখতো তার সম্পদ অন্যের হাতে। ফলে বিজয়ীর সঙ্গে বিরোধ, শত্রুতা ও ক্ষোভ-দ্বন্ধ শুরু হতো। (সুত্রঃ জাদুল মাসির)
আল্লাহ্ বলেন, হে ঈমানদারগণ ! এ মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শরসমূহ এ সমস্তই হচ্ছে ঘৃণ্য শয়তানী কার্যকালাপ ৷ এগুলো থেকে দূরে থাকো, আশা করা যায় তোমরা সফলতা লাভ করবে।
শয়তান তো চায় মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে এবং আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে তোমাদের বিরত রাখতে তাহলে তোমরা কি এসব থেকে বিরত থাকবে ? (সূরা মায়েদাহ, আয়াত ৯০-৯১)।
আরবি ভাষায় জুয়াকে বলে মাইসির। বাংলায় এর প্রতিশব্দ হচ্ছে জুয়া। ইসলামী পরিভাষায় জুয়া হচ্ছে, ‘উভয় পক্ষ থেকে সম্পদের মালিকানা ঝুঁকির মাঝে ঝুলন্ত রাখা।’ যে মালিক হবে সে পূর্ণ মালিক হবে, আর যে বঞ্চিত হবে সে পুরোপুরি বঞ্চিত হবে। জুয়ার নিত্যনতুন পদ্ধতি আবিষ্কার হচ্ছে।
জুয়া-অশ্লীলতা মহামারী রূপ নিয়েছে। জুয়া সামাজিক,পারিবারিক, আর্থিক ও নৈতিক সংকট তৈরি করছে। জুয়া খেলা মানুষের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। জুয়ার ব্যয় নির্বাহের জন্য নানা ধরনের অপকর্মের আশ্রয় নিয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। জুয়াড়িরা অনেক সময় নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের বাজি ধরে জুয়া খেলে।
তাই ইসলাম সব ধরনের জুয়া নিষিদ্ধ করেছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মদ, জুয়া ও বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন।’ বায়হাকি। জুয়ায় অংশগ্রহণকারীদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, জুয়াড়ি, খোঁটাদাতা ও মদ্যপায়ী জান্নাতে যাবে না।’ (দারেমি)
জনসমর্থনহীন আওয়ামী লীগ সরকার এদেশকে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, হত্যা, গুম খুনের অভয়ারণ্য নগরীর পর ঐতিহ্যবাহী মসজিদের শহর ঢাকাকে এবার ক্যাসিনো শহরে পরিণত করেছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে পুরানো ঢাকা মুঘল সাম্রাজ্যের সুবহে বাংলা (বাংলা প্রদেশ) এর প্রাদেশিক রাজধানী ছিলো। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে এই শহর জাহাঙ্গীর নগর নামে পরিচিত ছিলো। ঢাকা শহরটি “মসজিদের শহর” নামেও পরিচিত। এখানে প্রায় দশ হাজার মসজিদ আছে। সমগ্র বিশ্বের নবম বৃহত্তম শহর। জনঘনত্বের বিচারে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরী; ১৩৪ বর্গমাইল আয়তনের এই শহরে প্রতি বর্গমাইল এলাকায় ১ লক্ষ ১৫ হাজার লোকের বাস। এই জনবহুল জনপথ ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত। অর্থনীতির উদীয়মান এই দেশটি এখন সবার টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ভারতের চতুর্থ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় বাংলাদেশ থেকে। অথচ ভারত আমাদের ন্যায্য পাওনা পর্যন্ত দিচ্ছেনা। আওয়ামী লীগ বন্ধুদের একতরফা সুবিধা দিয়ে তাদের সহযোগীতায় ক্ষমতায় রয়েছে। বিনিময়ে তারা সকল সুযোগ সুবিধা নিচ্ছে তাদের ইচ্ছামত। চীনের বিরাট বিনিয়োগ এখানে। সমস্ত সুবিধার পাশাপাশি অন্যায় অপরাধ বেড়ে চলছে পাল্লা দিয়ে।
আওয়ামী লীগের দলের এক সভায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়িতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরক্তি প্রকাশের পরই দল ও প্রশাসন তৎপর হয়ে ওঠে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজে কমিশন চাওয়ায় ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতা রেজওয়ানুল হক শোভন ও গোলাম রাব্বানী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর কয়েক দিন পর আইনশৃঙ্খলাবাহিনী অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকটি অবৈধ ক্যাসিনো বন্ধ এবং যুবলীগ ও কৃষক লীগের নেতাসহ অনেককে গ্রেফতার করেছে।
কয়েকটি সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয় যুবলীগ নেতারা ৬০টি জুয়ার আখড়া বা ক্যাসিনো চালাচ্ছেন। এরপরই ক্যাসিনোতে অভিযান শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী র্যাব। প্রথমে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া গ্রেপ্তার হবার পর ক্যাসিনোই হয়ে গেছে ‘টক অব দ্য কান্ট্রি। ক্ষমতসীনদের ছত্রছায়ায় ক্যাসিনোয় মদ, জুয়া চলছে অনেক দিন ধরে। একের পর এক যুবলীগ নেতার গোপন আপরাধের ফিরিস্তি বের হয়ে পড়ছে। ঢাকার ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে অবৈধভাবে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে বুধবার যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে র্যাব গুলশান ২ নম্বরের ৫৯ নম্বর সড়কের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই দিনে ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবে অভিযান চালিয়ে দুই নারী কর্মীসহ ১৪২ জনকে আটক ও ২৪ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়।
যুবলীগের নেতা ঠিকাদারি চালিয়ে আসা গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা, অস্ত্র ও মদ উদ্ধার করে র্যাব। গ্রেফতারের দিন ভোর থেকেই নিকেতনের অফিস ঘিরে রাখে র্যা ব। এক পর্যায়ে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম নিকেতনে এলে শুরু হয় অভিযান আর কার্যালয়ে তল্লাশির প্রস্তুতি। র্যাব কর্মকর্তাদের অভিযান ও তল্লাশি করতে বারণ করেন জি কে শামীম। এর বদলে এক কর্মকর্তাকে ১০ কোটি টাকা ঘুষ প্রস্তাব করেন তিনি। তবে সেই প্রস্তাবে রাজি না হয়ে অভিযান চালায় র্যাব। জব্দ করা হয় নগদ টাকা, এফডিআরসহ মাদক। এ নিয়ে স্যোসাল মিডিয়ার র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমকে রীতিমত সাহসী বীর হিসেবে আখ্যায়িত করছে সাধারণ মানুষ।
ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের পাশাপাশি ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, বঙ্গবন্ধু এভিনিউর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র এবং বনানীর আহমেদ টাওয়ারের একটি ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় র্যাব। এ পর্যন্ত ১৮২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ঢাকার মতিঝিলে চারটি ক্লাবে অভিযান চালায় পুলিশ। বিভিন্ন জুয়ার সরঞ্জাম পেয়েছে পুলিশ। এর আগে চট্টগ্রামে ক্লাবগুলোতে অভিযান চালিয়েছে র্যাব। ক্যাসিনো প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ও অন্য দলের নেতাদের নামও উঠে এসেছে। ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাবের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা এবং ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন আর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী সাব্বির সাধারণ সম্পাদক। রাশেদ খান মেননের দাবি, ক্লাবে যে ক্যাসিনো চলছে তা তিনি জানতেন না। রাশেদ খান মেননের এ দাবির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মিডিয়ায় এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা।
ক্যাসিনো থেকে মাসোহারা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা আরামবাগ-ফকিরাপুলের ক্যাসিনো পাড়া থেকে যার প্রতি মাসে উপার্জন ছিল দুই কোটি টাকার ওপরে!। মহানগর পুলিশে এটি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। খোদ পুলিশের মধ্যেই এ নিয়ে এখন কানাঘুষা চলছে।
এ অভিযানের জনমনে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাহলে কি আইন শৃংখলা বাহিনী এসব জানার পরও আওয়ামী লীগের দলীয় লোক হওয়ার কারণে এতদিন গ্রেফতার করেনি? যে বিরোধীদল দমনে আইন শৃংঙলা বাহিনী বিগত দিনে ব্যাপক পারংগমতার পরিচয় দিয়ে আসছে। কিন্তু এখন কেন পারছেনা। নাকি আভ্যন্তরীন ক্ষমতার দ্বন্ধ সমাল দিতে এই অভিযান?। আর যদি সত্যিকারার্থে দেশের কল্যাণে এই অভিযান তাহলে বাকি দুর্নীতিবাজ, শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ব্যাংক লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান নয় কেন? পত্রিকায় যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সিরিজ নিউজ প্রকাশিত হয়েছে সেই এমপি, মন্ত্রীদের গ্রেফতার করা হচ্ছেনা কেন? নাকি আই, ওয়াশ, বিনা ভোটে নির্বাচিত সরকার নিজেদের ইমেজ বিল্ডাবের জন্য লোক দেখানো এই অভিযান পরিচালনা করছে!! যদি এখন পর্যন্ত ক্ষমতার নাটাই যাদের তারই সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। কিন্তু কথায় বলে গনেশ উল্টাতে নাকি সময় লাগেনা!
বাংলাদেশে ক্যাসিনো-বাণিজ্য বৈধ নয়। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কিভাবে এত দিন এই বেআইনি ব্যবসা চলতে পারল? সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকলে এসব অবৈধ কাজ কোনোভাবেই সংঘটিত হতে পারত না। ক্যাসিনো পরিচালনা ও দুর্নীতির অভিযোগে যেসব ব্যক্তিকে ধরা হয়েছে, তাদের সাথে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেকের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের বিষয়টি সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। এ ব্যাপারেও খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।
দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে সরকারের এই ‘অভিযান’ সবার মুখে মুখে। সরকারের নীতিনির্ধারক অনেকে একে ‘শুদ্ধি অভিযান’ বলেছেন। তাহলে কি পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নেয়া হলো যে, উন্নয়নের নামে দেশে ভয়াবহ দুর্নীতি ও সামাজিক অনাচার সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। অথচ দেশী-বিদেশী গণমাধ্যম ও একাধিক জরিপে অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কথা বলা হচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে। সরকার এত দিন তা আমলে নেয়নি। ফলে অকুণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে দেশ-রাষ্ট্র-সমাজ।
দেশবাসীর প্রত্যাশা, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান মাঝপথে থেমে যাবে না। সেই আশা কি এই জনবান্ধবহীন সরকারের নিকট করা যায়?
এই হচ্ছে আওয়ামী লীগের একালের ইতিহাস। সম্মানীত পাঠকদের সমীপে আওয়ামী লীগের দু:শাসনের ৭২-৭৪ এমন একটি খন্ডিত অংশ এন্থনি মানকারেনহাস এর ঐতিহাসিক গ্রন্থ বাংলাদেশ –লিগ্যাসি অফ ব্লাড থেকে তুলে ধরছি। তিনি লিখেছেন-” ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২ সাল। লন্ডনে ‘গল ব্লাডারে অপারেশন’ এর পর মুজিব আবার দেশে ফিরে এসেছেন। শারীরিক অবসাদ এখনও পুরোপুরি কাটেনি। সবমিলে তাঁর সত্তায় এক বিরাট ঝাঁকুনির সৃষ্টি করলো। কিন্তু মুজিবের মাঝে অনুশোচনার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। নিজের উপর থেকে সকল দোষ তাঁর সহচরদের উপর ঠেলে দিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমি জনগণের সঙ্গে আছি’। প্রথমবারের মতো পার্টির লোকদের উপরে তিনি চড়াও হলেন। চোরাইকারবার, স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতির অভিযোগে ডিসমিস করলেন সংসদের ১৯ জন সদস্যকে।
শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে এ ধরনের পরিশোধন প্রক্রিয়া জনগণের মনে আশার সঞ্চার করলো। মুজিব ঘোষণা দিলেন, আমি কাউকে ছাড়বো না। যে কোন অপরাধীর বিরুদ্ধে আমি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। মুজিবের মাঝে এ পুরনো গতিশীলতা দেখে সকলেই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করলো যে, এই সুযোগে মুজিব জনগণের বিশ্বাস আবারও ফিরে পাবে। একজন বাঙ্গালী সাংবাদিক আমাকে বললো, নেতা সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলবেন। এবার তাহলে তামাশাটা দেখো। এটা হবে তাঁর আর একটা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। পরবর্তী ঘটনাবলীই মুজিব পতনের নব অধ্যায়ের সূচনা করলো। শুরু হলো রাজনৈতিক চমৎকারিত্ব প্রদর্শনের পালা। তিনি একের পর এক জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহ খর্ব করতে শুরু করলেন। সাংবিধানিক নিয়ম-কানুন, আইনের শাসন, বাক —স্বাধীনতা, মতামতের অধিকার, সুযোগের সমতা, ইত্যাদি সবই বিলুপ্ত হয়ে গেলো। কায়েম হলো দুঃশাসনের চরম পরাকাষ্ঠা।
সশস্ত্র সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী দলের হিংসাত্মক কর্মকান্ড, হত্যা, লুটতরাজ ইত্যাদিতে চতুর্দিক থমথমে হয়ে উঠলো। মন্ত্রী পরিষদ আর সরকারী আমলাদের পরামর্শক্রমে প্রধানমন্ত্রী দশ দিনের জন্য বেআইনী অস্ত্রশস্ত্র সারেন্ডার করার নির্দেশ দিলেন। মানব দেবতার বৃষ্টি হবার নির্দেশ দানের মতো এবারের বেআইনী অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশও দারুণভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। সময়সীমা বাড়ানো হলো। টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী ও তাঁর বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সমর্পন ও মুজিবের আনুগত্য স্বীকার করলো। শেষ পর্যন্ত মাত্র তিরিশ হাজার বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র জমা পড়লো। যদিও ধারণা করা হয়েছিল লক্ষাধিক অস্ত্রের। শেখ মুজিব এবং তাঁর পরবর্তী খন্দকার মোশতাক আর জেনারেল জিয়াউর রহমান কেউই বাকী অস্ত্রের সন্ধান করতে পারেননি।
এবার এলো মজুতদার আর চোরাচালানীদের বিরুদ্ধে অভিযান। ব্যবস্থা নেয়া হলো। বিভিন্ন ধরনের লোক-দেখানো গোছের। কাজ হলো না কিছুই। রুই-কাতলারা দিব্যি রয়ে গেলেন। কিছু চুনোপুটি কেবল আটকা পড়লো অভিযানের জালে। অবশ্য ঐ রুই-কাতলারাও শাসকচক্র, আওয়ামী লীগেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলো। দুর্নীতির কেবল বাংলাদেশেই বিরাজমান কথাটি ঠিক নয় তবে যে হারে এবং গতিতে দেশের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছিল, তা সত্যিই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিল। দেশটির সবকিছুই নতুনভাবে শুরু হচ্ছিল বলে দুর্নীতির সুযোগও অপরিসীম।
ঐ সকল দুর্নীতির উদাহরণ দিতে গেলে প্রচুর বইয়ের সৃষ্টি হয়ে যাবে। ছোটখাট দোকানী থেকে “বিজনেস ম্যাগনেট” আর ছোট কর্মচারী থেকে সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি পর্যন্ত কেউ বাদ গেলো না। যে যেভাবে পারলো, লুটেপুটে রাতারাতি মহাসম্পদশালী হবার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে গেলো। দুর্নীতি কেবল আওয়ামী লীগার, সরকারী আমলা আর কূটনীতিকদের মধ্যেই সীমিত রইল না, তারা সে জন্যে যার যার সুবিধেমতো নেটওয়ার্কও সৃষ্টি করে নিলো। কেউ তাঁর আত্মীয়-স্বজনের নামে কার্যসিদ্ধি করেছিলেন। কেউ বা আবার পরিষ্কার নিজের নামেই।
দেশটাকে শেখ মুজিব নিজের ব্যক্তিগত সম্পদ বলে মনে করতেন। সুতরাং টাকা বানানো তাঁর দরকার ছিল না। তাঁর লোভ ছিল ক্ষমতার প্রতি। তাঁর ছেলে শেখ কামাল আর তাঁর ছোট ভাই টাকার ব্যাপারে পিছিয়ে ছিলো না। বিনিয়োগবিহীন ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বে শেখ কামাল বেশ এগিয়ে ছিলো। মুজিবের ছোট ভাই বহু সংখ্যক বার্জ ও অন্যান্য নৌযান-এর মাধ্যমে প্রভূত অর্থের অধিকারী হয়ে গেলো।
সরকারী দুর্নীতির মধ্যে দেশের খাদ্যদ্রব্য আর পাট ভারতে পাচারকরণ ভয়ানকাকার ধারণ করেছিলো। এ ব্যবস্থাটি দেশ স্বাধীন হবার পূর্ব থেকেই চলে আসছিলো। মুজিব হত্যার পরে সরকার নিজেই বলেছিলো যে, স্বাধীনতার গত সাড়ে তিন বছরে দেশের সীমান্ত দিয়ে কমপক্ষে ছয় হাজার কোটি টাকা মূল্যের দ্রব্যসামগ্রী ভারতে পাচার হয়ে গেছে”।
শেখ মুজিবের নির্বোধ, ব্যক্তিত্বহীন চাটুকারের অভাব ছিল না। মুজিবের পরামর্শদাতা ও মন্ত্রীদের মধ্যেই জঘন্যতম চাটুকাররাও ছিলো। পরামর্শদাতাদের মধ্যে তোফায়েল আর শেখ ফজলুল হক মনি ছিল অগ্রগ্রামী। মন্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতনামা ছিলো তাহের উদ্দীন ঠাকুর। ঠাকুর ‘ইনফরমেশন’ মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো।
ঠাকুর কর্তৃক ঢাকা বিমান বন্দরে শেখ মুজিবের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ গ্রহণের দৃশ্য বাংলাদেশ টিভি দর্শকদের উপহার দেয়। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সেদিন অবাক বিস্ময়ে জাতি মন্ত্রীদের ব্যক্তিত্ব আর গদি-লিপ্সার কান্ডকারখানা অবলোকন করছিলো। অবশ্য মুজিব তা খুব পছন্দ করতেন, গর্বিতও হতেন বৈকি!
মুজিব তাঁর পার্টি, আওয়ামী লীগের দ্বারাই কোণঠাসা হতে বাধ্য হলেন। ১৯৭২ সালে জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তিনি সব জায়গায় তাঁর দলীয় লোকদেরকে বসিয়ে দিলেন। উদ্দেশ্য ছিল – তাদের মধ্যে দু’দিকের যোগাযোগই রক্ষা করা। কিন্তু তাদের অতিমাত্রায় মোসাহেবীতে যোগাযোগের একটি পন্থা অচল হয়ে গেলো। মুজিব চতুর্দিক থেকে কেবল জনগণের দুর্দশার কথাই শুনছিলেন। জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁর চাটুকারেরা বেমালুম অস্বীকার করে বলতো, ‘এ সবই দুষ্ট লোক আর রাষ্ট্র বিরোধী কার্যকলাপের অংশবিশেষ। এভাবে পুরাকালের গ্রিক দেবতাদের মতো ওরা তাকে পাগল বানিয়ে ধ্বংস করে দিলো”।
দেশের সবচেয়ে প্রাচীন দল আওয়ামী লীগ আবারো সেই একই পথে হাটছে? দেশের জনগণ আদৌ কি কোন পরিবর্তন দেখতে পাবে? না, সবই ক্ষমতার খেলা, আর আই ওয়াশ! আসলে জনগণকে বোকা বানিয়ে বেশীদিন শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়না। আইনস্টাইন বলেছেন- এই পৃথিবী কখনো খারাপ মানুষের খারাপ কর্মের জন্য ধ্বংস হবে না। যারা খারাপ মানুষের খারাপ কর্ম দেখেও কিছু করেনা তাদের জন্যই পৃথিবী ধ্বংস হবে। সুতরাং অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। আসুন সে দায়িত্ব পালনে সকলে ঐক্যবদ্ধ হই।