পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পল্টনে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন পৈশাচিক ও জঘন্য হত্যার ঘটনা খুবই বিরল। রাজপথে পূর্বঘোষিত সেই ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনিই মূলত হুকুমের আসামি। বিচারিক আইনে এর সাজা মৃত্যুদণ্ড। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যুদ্ধ-বিগ্রহ, খুন-খারাবির মূলে রয়েছে ক্ষমতার লিপ্সা, সম্পদের মোহ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন ইত্যাদি। আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোর করে ক্ষমতা দখল, পাহাড় সমান দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে ফাঁসি, জেল-জুলুম-নির্যাতন, হামলা, মামলা দিয়ে ১১ বছরে প্রমাণ করেছে ২৮ অক্টোবরের মানুষ হত্যার আসল কারণ কী। কেন এমন জঘন্য পথ তারা বেছে নিয়েছে সেদিন। প্রতিপক্ষ দমনে আদর্শ নয়, খুনই একমাত্র তাদের হাতিয়ার। ২৮ ফেব্রুয়ারি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে সাজার প্রতিবাদ মিছিলে সারা দেশে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। ৫ মে লংমার্চ করে ঢাকায় শাপলা চত্বরে আলেম-ওলামা ও ইসলামপ্রিয় তৌহিদি জনতার ওপর ইতিহাসের বর্বর নির্যাতন চালানো হয়েছে। সরকারের নির্দেশে গভীর রাতে বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য অভিযান চালায়। এ অভিযানে এক লাখ ৫৫ হাজার গুলি ব্যয় হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ গণহত্যার প্রতিবাদ করেছে। এতে কত লোক প্রাণ হারিয়েছে তা এখনও অজানাই রয়ে গেলো। বিভিন্ন সংগঠন এ হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে এলেও সরকার তা নিয়ে কোনো বক্তব্য দেয়নি। তবে এ গণহত্যাকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পাকিস্তান আর্মির চালানো গণহত্যার সঙ্গেই তুলনা করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। হেফাজতে ইসলাম দাবি করেছে, সরকারি বাহিনী তাদের আড়াই হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। নির্বিচারে আলেম-ওলামাদের হত্যার ঘটনায় সরকারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সরকারদলীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরাও অংশ নেয়। (সূত্র : দৈনিক পত্রিকা)
২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ’০৯ বিডিআর হত্যাযজ্ঞ ও হত্যা, নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরের হত্যাকাণ্ড, গুম, খুনের হাজার ঘটনা প্রমাণ করেছে আওয়ামী লীগের বাকশালী চরিত্র পাল্টায়নি। ২৮ অক্টোবরের এই পৈশাচিক বর্বরোচিত ঘটনা স্থান করে নিয়েছে লেনিন বিপ্লব, স্ট্যালিন বিপ্লব, হিরোশিমা নাগাসাকি, এপ্রিল ফুল দিবসের ট্র্যাজেডি সাথে। বিশ্বযুদ্ধ, ক্রুসেড চায়না বিপ্লব, বোসনিয়া/চেচনিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, মিয়ানমার, কাশ্মিরসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলিম গণহত্যা ও নির্যাতনের ধারাবাহিক অংশ। হিটলার, মুসোলিনি, চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, তৈমুর লং, কুবলাই খানের হত্যা মিশন এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যা, কাশ্মিরের রক্তাক্ত ঘটনা দুনিয়াবাসীর স্মৃতিতে বীভৎস চিত্রের মত ২৮ অক্টোবরও ভেসে ওঠে আজো।
সরকার এই দশকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে ভুয়া মামলা, শ্যোন অ্যারেস্ট, রিমান্ড, গুম, খুন, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে মহা উৎসবে। স্বৈরাচারী মহাজোট সরকারের এসব মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে আজ দেশে মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত এবং বিপন্ন। বিগত এক দশকে দেশে এমন বহু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যার ভয়াবহতা বর্ণনা করলে শিউরে উঠতে হয়। সরকারের শুরু থেকেই পুরো মেয়াদজুড়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের দমন-পীড়নে মিছিল-সমাবেশে নির্বিচারে চালানো হয় গুলি। গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী মত দমনে স্বৈরতান্ত্রিক স্টাইলে ব্যবহার করা হয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে। বিরোধী দল ও মতের নাগরিকদের দমনে রিমান্ডের যথেচ্ছ ব্যবহার করছে সরকার। কোনো ধরনের অভিযোগ বা সুনির্দিষ্ট মামলা ছাড়া কিংবা মামলা থাকলেও তদন্ত ও অনুসন্ধানের আগেই মাসের পর মাস রিমান্ডে রেখে নির্যাতন চালানো হচ্ছে বিরোধী মতের লোকদের ওপর। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন, সংস্থা ও দেশবরেণ্য আইনজীবীরা। দেশবরেণ্য আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেছেন, আসামি গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়ার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘন করা হচ্ছে। একইসঙ্গে দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনও মানা হয়নি। এগুলো অন্যায় হচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মেনে চলা সরকার ও অধস্তন আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক। সরকার একজনকে গ্রেফতার করে নিম্ন আদালতে হাজির করে রিমান্ড চাইছে আর আদালতও রিমান্ড মঞ্জুর করছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। এটা উচ্চ আদালতের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন। এতে আইনের শাসন ও মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।
২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে পল্টনে আওয়ামী লীগ লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ হত্যার দৃশ্য স্মরণ করলে এখনো শিউরে ওঠে মানুষের শরীর, বাকরুদ্ধ হয় বিবেক। পৈশাচিক ও অমানবিকভাবে মানুষ হত্যার দৃশ্য এখনো কাঁদায় সকলকে। বিশ্বমানবতা শতাব্দীর পর শতাব্দী খুনিদের প্রতি ঘৃণা ও অভিশাপ দিতে থাকবে। ২৮ অক্টোবর আওয়ামী জঙ্গিপনার এক রক্তাক্ত দলিল হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। Terrorism এর সংজ্ঞায় Britannica R.R.ENCYCLOPEDIA-তে বলা হয়েছে, Terrorism Systematic use of violence to create a general climate of fear in a population and thereby to bring about a particular political objective.
আজ থেকে প্রায় ১৩ বছর আগে কথা। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র পল্টন ময়দানে আওয়ামী-বামরা প্রকাশ্য দিবালোকে লগি-বৈঠা দিয়ে যে পৈশাচিক কায়দায় জীবন্ত মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করার পর লাশের ওপর নৃত্য করেছে তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল! ২৮ অক্টোবর এটি একটি কালো অধ্যায়ের দিন। একটি কলঙ্কের সংযোজনের দিন। এ দিন মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত দিবস, লগি-বৈঠার তাণ্ডব দিবস, আওয়ামী বর্বরতার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ ২৮ অক্টোবরের মত অনেক ঘটনা দেশে ঘটিয়েছে তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।২৮ অক্টোবরের হামলা চালানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। দেশের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় এ জমিন থেকে ইসলামী আন্দোলন নিশ্চিহ্ন করে ও নেতৃত্বকে হত্যা করাই ছিল উদ্দেশ্য। সে ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম, সাবেক আমির ও মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ পাঁচজনকে ফাঁসি দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় করেছে। দুইজন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জুলুমের শিকার হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। ২৮ অক্টোবর মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘন্য ইতিহাস দিয়ে আওয়ামী লীগ-বামরা যাত্রা শুরু করেছে, অপরাধের মাত্রা দিন দিন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে আজ আইয়্যামে জাহিলিয়াতকেও হার মানাতে বসছে। ২৮ অক্টোবর ঘটনার শুরু যেভাবে-
২৮ অক্টোরর ২০০৬ ছিল চারদলীয় জোট সরকারের ক্ষমতার পাঁচ বছর বর্ষপূর্তির দিন। ক্ষমতা হস্তান্তরের এই দিনে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে আয়োজন করা হয়েছে জনসভার। মূলত ২৭ অক্টোরর থেকেই সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে ১৮ জনকে হত্যা করে। ২৮ অক্টেবর সকাল ১০টায় আমরা ইসলামী ছাত্রশিবিরের পল্টনস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে উপস্থিত। হঠাৎ গেটের সামনে চিৎকার। বেরিয়ে দেখি একজন ভাইকে রিকশায় করে রক্তাক্ত অবস্থায় নিয়ে আসা হচ্ছে, তার মাথায় এমনভাবে আঘাত করা হয়েছে মাথার এক পাশ ঝুলছে! দেখে শরীর শিউরে উঠছে!
অফিস থেকে বেরিয়ে আহত-রক্তাক্তদের দেখতে দেখতে আমরা পল্টন মসজিদের গলিতে এসে দেখি একদিকে ৪০-৫০ জন নিরীহ নিরস্ত্র, অপরদিকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত চার থেকে পাঁচ হাজার সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে অস্ত্র, লাঠি, বোতল, বোমা ইত্যাদি নিয়ে। এমন কোনো অস্ত্র নেই যা তারা ব্যবহার করেনি। এভাবে সাত ঘণ্টা মরণপণ লড়াই। তাদের উদ্দেশ্য জনসভা ভণ্ডুল করা, নেতাকর্মী ও আমাদের দলীয় অফিসের ওপর আক্রমণ। কিন্তু ওরা এক ইঞ্চি জায়গা থেকেও সরাতে পারেনি আল্লাহর দ্বীনের গোলামদের। ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ছিলো শাহাদাতের প্রতিযোগিতা। আগামীর পথে এক দুরন্ত সাহস। ২৮ অক্টোবরের আল্লাহর প্রত্যক্ষ মদদের বাস্তব সাক্ষী হয়ে আছে আজো। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে। কেউ কেউ আহত হয়ে বিদায় নিচ্ছে আমাদের কাতার থেকে। নতুন করে, দু-একজন করে আমাদের সাথে যোগ দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের সংখ্যা এর থেকে বাড়ছে না। তবুও আন্দোলনের কর্মীরা আল্লাহর উপর তায়াক্কুল করে এগিয়ে চলছে। আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা মুমিনদের বিজয় সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল নয়।
আওয়ামী সন্ত্রাসীরা প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করে সামনের দিক থেকে। আমরা ২০-২৫ জন নারায়ে তাকবির ধ্বনি দিয়ে সামনের দিকে এগোতে লাগলাম। তখন দেখি আওয়ামী লীগের ৪-৫ হাজার অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী পেছনের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করলে তাঁর সাহায্য অনিবার্য, এটাই তার প্রমাণ। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “কোনো মু’মিন মুজাহিদ জিহাদের ময়দানে নারায়ে তাকবির উচ্চারণ করলে বাতিলের মনে চার হাজার লোক তাকবির উচ্চারণ করলে যে আওয়াজ হয় তার সমপরিমাণ ভীতি সৃষ্টি হয়।” ২৮ অক্টোবর হাতেনাতে তার প্রমাণ পেয়েছি।আমরা একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখি গলির একটু ভেতরে পড়ে আছে আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ মুজাহিদের লাশ। তার দেহ এখন নিথর নিস্তব্ধ। তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে পাড়ি জমিয়েছেন তার কাক্সিক্ষত মঞ্জিলে। শাহাদাতের মৃত্যুর জন্য মুজাহিদ প্রায় তার মায়ের কাছে দোয়া চাইতেন। মাবুদ আজ তার আকাক্সক্ষা পূর্ণ করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
শহীদ মুজাহিদ তার মাকে বলত, “মাগো বেশি বেশি কুরআন পড়ো, তাফসির সহকারে, আমল করার লক্ষ্যে কুরআনকে হৃদয়ে ধারণ করো। সে রেগুলার তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তো, নফল রোজাও রাখতো। মাগো, শহীদ হতে চাইলেই কি শহীদ হওয়া যায়? যায় না মা। শহীদ হতে হলে অনেক বড় ভাগ্য লাগে, সত্যিকারার্থে আমার কি সেই ভাগ্য আছে মা, শহীদ হলে কর্মফলের কোন হিসাব দিতে হয় না, কোন শাস্তি হয় না কবরে, জাহান্নামে যেতে হয় না। শাহাদাত হলে সরাসরি জান্নাতে যাওয়া যায়।”
শহীদেরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েও তারা যেন অমর! আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে নিজের মেহমান হিসেবে জান্নাতে থাকতে দেন। আল্লাহ বলেন, “আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদের মৃত মনে করো না, প্রকৃত পক্ষে তারা জীবন্ত, কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা অনুভব করতে পারো না।” (সূরা বাকারা: ১৫৪) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, “তাদের প্রাণ সবুজ পাখির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। আল্লাহর আরশের সাথে ঝুলন্ত রয়েছে তাদের আবাস, ভ্রমণ করে বেড়ায় তারা গোটা জান্নাত, অতঃপর ফিরে আসে আবার নিজ নিজ আবাসে।” (মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) প্রিয় রাসূল (সা) বলেছেন: “শাহাদাত লাভকারী ব্যক্তি নিহত হওয়ার কষ্ট অনুভব করে না। তবে তোমাদের কেউ পিঁপড়ার কামড়ে যতটুকু কষ্ট অনুভব করে, কেবল ততটুকুই অনুভব করে মাত্র।” (তিরমিযী)
হায়েনারা আমাদের প্রিয় ভাই শহীদ মুজাহিদকে হত্যার পর গলির মধ্যে ফেলে রেখেছে। আমাদের ভাইয়েরা কয়েকজন মিলে যখন কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে তার মৃতদেহ। কিন্তু রক্তপিপাসু আওয়ামী সন্ত্রাসীদের রক্তের পিপাসা তখনও থামেনি। লাশের ওপর তারা ছুড়ে মারছে ইট, পাথর, বোতল ও লাঠি। আল্লাহর প্রিয় বান্দা শহীদ মুজাহিদ শাহদাতের অমিয় সুধা পান করে বিদায় নিয়েছেন। আল্লাহর জান্নাতের মেহমান হিসেবে তাকে কবুল করেছেন। আমি হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে শুনলাম প্রিয় ভাই মুজাহিদ আর নেই। তখন স্মৃতিতে ভেসে উঠলো সব ঘটনা।
এ পর্যায়ে দীর্ঘ ৫-৬ ঘণ্টা পর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের পিস্তলের গুলি আমার বাম পায়ে আঘাত হানল। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। গাড়ির চাকা পাংচার হওয়ার মতো জমিনে লুটিয়ে পড়লাম। আমাদের কয়েকজন ভাই কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে। পায়ের যন্ত্রণায় যতটুকু কাতর তার থেকে বেশি কষ্ট লাগছে এই ধন্য মানুষগুলোর কাতার থেকে এই অধমের বিদায় নিতে হচ্ছে এ জন্য। তখন নিজেকে খুব স্বার্থপরই মনে হচ্ছিল। সবাই যখন জীবনবাজি রেখে ভূমিকা রাখছে তখন আমি চলে যাচ্ছি অন্যের কাঁধে ভর করে। গুলিবিদ্ধ পা-টি ঝুলছে আর সেই সাথে রক্ত ঝরছে। কষ্টের মধ্যে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলাম। অনেক ভাই পেরেশান হয়ে গেল এবং আমার সাথে আসতে লাগল। ভাইদের বললাম, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন? পরিস্থিতি মোকাবেলা করুন।
আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। এ যেন আরেক কারবালা। কিন্তু কঠিন পরিস্থিতিতে দারুণ শৃঙ্খলা শহীদি কাফেলার ভাইদের মাঝে। এখানেও ইয়ামামার যুদ্ধের সেই সাহাবীদের মত অপর ভাইকে অগ্রাধিকারের দৃষ্টান্ত। নিজেদের শরীর থেকে রক্ত ঝরছে তবুও ডাক্তারকে বলছেন, ঐ ভাইকে আগে চিকিৎসা করুন। এ যেন ‘বুন ইয়ানুম মারসুস’এর উত্তম দৃষ্টান্ত। এ যেন আনসার মুহাজিরদের ভ্রাতৃত্বের জীবন্ত দলিল। জোহরের নামাজ আদায় করলাম অপারেশন থিয়েটারে গুলিবিদ্ধ পা প্লাস্টার করা অবস্থায়। নিজের অজান্তেই ভাইদের জন্য দোয়া করতে লাগলাম। প্লাস্টার করছেন ডাক্তার। এক্সরে রিপোর্ট ঝুলানো দেখা যাচ্ছে পায়ের হাড় দ্বি-খণ্ডিত হয়ে গেছে। আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম এই এক্সরেটি আমার? কেউ যেন বলতে চেয়েও আমি ভয় পাবো সে জন্য আর কিছু বলছে না। আমি বললাম, এই গুলিটি আমার জন্য আল্লাহ কবুল করেছিলেন। শুধু তাই নয়, গুলিটি আমার পায়ের নামেই লেখা ছিল। এ বিশ্বাস থাকতে হবে প্রতিটি আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকের। এই বিশ্বাসের ইমারতের ওপর যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তার ওপর আঘাতের পর আঘাত এলেও তাকে কখনো স্তব্ধ করা যাবে না, ইনশাআল্লাহ।
আলী (রা) বলেন : “ঈমানের ক্ষেত্রে সবরের উদাহরণ হলো দেহের মধ্যে মাথার মত।” এরপর আওয়াজ উঁচু করে বললেন, “যার ধৈর্য নাই তার ঈমান নাই।” আবু সাঈদ খুদরী (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : “আল্লাহ তায়ালা ধৈর্যের চেয়ে উৎকৃষ্ট এবং ব্যাপকতর দান কাউকে দেননি।” (সুনান আবু দাউদ, অনুচ্ছেদ: নিষ্কলুষ থাকা সহীহ)
আল্লাহ তায়ালা বলেন : “আল্লাহর হুকুম ছাড়া কোন বিপদ আসে না। আর যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে তিনি তাঁর অন্তরকে সঠিক পথের সন্ধান দেন।” (সূরা তাগাবুন : ১১) আলকামা বলেন, “আল্লাহ তায়ালা ‘যার অন্তরকে সঠিক পথের সন্ধান দেন’ সে হলো ঐ ব্যক্তি যে বিপদে পড়লে বিশ্বাস করে এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। ফলে বিপদে পড়ে ও সে খুশি থাকে এবং সহজভাবে তাকে গ্রহণ করে।”
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “বিপদ যত কঠিন হয় পুরস্কারও তত বড় হয়। আল্লাহ কোন জাতিকে ভালোবাসলে তাদেরকে পরীক্ষা করেন। সুতরাং যে তাতে সন্তুষ্ট থাকে আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান আর যে তাতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে আল্লাহ তার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে যান।”
আল্লাহ তায়ালা বলেন- “হে ঈমানদারগণ, তোমরা নামায ও সবরের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য অনুসন্ধান কর। নিশ্চয় আল্লাহ সবরকারীদের সাথে থাকেন।” (সূরা বাকারা : ১৫৩)
২৮ অক্টোবরের এই ঘৃণ্য ও হৃদয়বিদারক ঘটনা পর্যালোচনা এখনো চলছে। কেউ খুঁজছেন বিশ্বাসঘাতকদের। কেউ বলেন, আমাদের প্রস্তুতির কথা। অনেকে বলেন আর কি করলে এ ঘটনা এড়ানো যেত তা নিয়ে। কিন্তু আমি মনে করি যদি আমাদের প্রস্তুতি আরো ভালো থাকতো! তাহলে কি হতো? কারণ দীর্ঘ সাত ঘণ্টা যাদের সাথে আমরা মোকাবেলা করেছি, কী তাদের পরিচয়? তারা আওয়ামী লীগ ভাড়াটে সন্ত্রাসী, টোকাই, গার্মেন্টসকর্মী ও হিন্দার মতো লোকদের নিয়ে এসেছে। মুখে রুমাল, কোমরে মাফলার, খালি গায়ে মারামারিতে অংশ নিয়েছে ওরা। কোন ভালো ঘরের সন্তান কি এখানে ছিলো? আমাদের প্রস্তুতি আরো ভালো হলে সেদিন লাশের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেতো। আর এ ধরনের একজন সন্ত্রাসী, টোকাই এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া, নামাজী, আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকদের লাশ সবাই একই হিসেবে মূল্যায়ন করতো। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে হিসাব হতো কাদের কয়টি লাশ। অন্তত আল্লাহ তায়ালা সে কলঙ্কের হাত থেকে এ আন্দোলনকে রক্ষা করেছেন। আল্লাহ যা করেন তার মধ্যে এই আন্দোলনের কল্যাণ নিহিত। ২৮ অক্টোবর বিশ্বের মানুষ চিনতে সক্ষম হয়েছে উগ্র ও জঙ্গি কারা। কিন্তু আজও ভাবি আওয়ামী লীগ আর কত সন্ত্রাস, খুন, গুম করলে তাদের জঙ্গি বলা হবে?
পল্টনে এ জাতি আরেকবার দেখে নিয়েছে আমাদের পরীক্ষিত নেতৃত্ব। শ্রদ্ধেয় আমিরে জামায়াত সাবেক সফল মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাহেবের সাহসী নেতৃত্ব। মুহুর্মুহু গুলি আর বোমা স্তব্ধ করতে পারেনি তার বলিষ্ঠ কণ্ঠকে। সেদিন তাঁর বক্তব্য ছিল তেজোদীপ্ত, নিশ্চল, অবিরত আর অবিচল। তিনি যেন মাওলানা মওদূদীর অবিকল প্রতিচ্ছবি। আমিরে জামায়াত সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী (রহ)কে সম্মেলনে সন্ত্রাসীরা গুলি চালালে, সবাই চিৎকার করে বলেছেন মাওলানা আপনি বসে যান। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমিই যদি বসে যাই তাহলে দাঁড়িয়ে থাকবে কে?” সেদিন শহীদ নিজামীসহ স্টেজে শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে রক্ষা করতে শহীদেরা জীবন দিয়েছেন কিন্তু মাথা নত করেননি। কিন্তু সেই নেতৃবৃন্দ অনেকেই আজ নিজেই শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে চলে গেছেন মহান মাবুদের দরবারে।
কিন্তু আমি জানি না ২৮ অক্টোবরের ঘটনা পর্যালোচনা আওয়ামী ১৪ দল কিভাবে করছে। তারা সেদিন কিছু মানুষ হত্যা করে যে জঘন্য কালিমা লেপন করেছে তা আজো মিডিয়ায় ভাস্বর। আজ যদি বলা হয়, এই দুনিয়ার বিবেচনায় ২৮ অক্টোবর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কে? কেউ বলবে, শহীদ মাসুম, শহীদ শিপন, শহীদ মুজাহিদ, শহীদ রফিক, শহীদ ফয়সালের পরিবার।
কিন্তু আমার মনে হয় তা সত্য নয়। এটি আমার-আপনার হিসাব হতে পারে! তবে শহীদ পরিবারের অনুভূতিতো ভিন্ন। কিন্তু তা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। শহীদ মুজাহিদের মায়ের অনুভূতি “২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আমার জীবনের সবচেয় বড় স্মরণীয় দিন, সবচেয়ে বেদনার দিন এবং সবচেয়ে বড় শুকরিয়া আদায়ের দিন। এই দিনে আমার রক্তের বাঁধন ছিন্ন করে মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করলো। সে ছিল আমার অতিপ্রিয় সন্তান। সে ছিল পরম প্রিয় বন্ধু। আমার জীবনের যত কষ্ট, যন্ত্রণা, বোবা কান্না তা শুধু তার সাথে শেয়ার করেছি, অন্য কারো সাথে নয়। আজ সে নেই তাই আমার অব্যক্ত বুকফাটা আর্তনাদ। তার মত ভালো আমলের ভালো ছেলে পরকালে আমি পাবো তো? এই জীবনে তাকে আমি কিছু দিতে পারিনি তাই আল্লাহকে বলি, হে আল্লাহ এই জীবনে যতটুকু পুণ্য করেছি এবং মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যা পুণ্য অর্জন করবো, তার সবটুকু সওয়াবই আল্লাহ যেন তার আমলনামায় যোগ করে দেন।”শহীদ ফয়সালের মায়ের অনুভূতি- “সেই ভয়াবহ ২৮ অক্টোবর সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্যটা ভোলার মতো নয়, ফয়সালকে হারিয়ে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা ‘মা’ হয়ে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সে ছিল খুবই নরম স্বভাবের। এমন ছেলেকে লগি-বৈঠা দিয়ে জীবনে শেষ করে ফেলা এটা মানুষের কাজ নয়, এরা নরপশু, ওদের মায়ামমতার লেশমাত্র নেই। আল্লাহর পছন্দনীয় সবদিক থেকে সুন্দর বান্দাটিকেই তার কাছে নিয়ে গেলেন। শহীদদের স্বভাবটা এরকমই হয়ে থাকে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ওদেরকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন।”
শহীদ হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপনের মা বলেন, “সে দাখিলে ১১তম স্থান অধিকার করে। মানুষের যেকোন বিপদ কিংবা সমস্যা সমাধানে সে দ্রুত সাড়া দিত। এক ছেলের অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা উঠলে তাকে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তির পর দেখা গেল তার ওষুধের টাকা নেই। সে তার নিজের পকেটের টাকা দিয়ে ঐ ছেলের ওষুধ কিনে দেয় এবং সারারাত তার বিছানার পাশে থেকে শুশ্রুষা প্রদান করে ভোরে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরে। এলাকার এক বৃদ্ধ লোকের কাছ থেকে ছিনতাইকারীরা টাকা পয়সা ছিনিয়ে নিলে ঐ লোকটিকে ৩০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে তার নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। সরকারি বিজ্ঞান কলেজে অর্থ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে তার আচরণে মুগ্ধ হয়ে হিন্দু ছেলেরা পর্যন্ত বায়তুলমালে অর্থ প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করত। শিপন এলাকার অনেক ছেলেকে কুরআন শরিফ পড়তে শিখিয়েছে।
এলাকার ছেলেরা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তাদেরকে ভালো করতে হবে এই চিন্তায় সে সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল। সে সবাইকে মসজিদে নামাজ এবং কুরআনের আলোকে জীবন গড়ার তাগিদ দিতে ব্যতিক্রম আয়োজনের মাধ্যমে তাদেরকে দাওয়াত পৌঁছাতো। যেমন- ব্যায়াম, ফুটবল, ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন। ফজরের নামাজের সময় ছেলেদেরকে নামাজের জন্য ডাকতো।
আমার শিপনকে যে রকম নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে শহীদ করা হয়েছে আমার ছেলে কুরআনে হাফেজকে তারা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার দাঁত পর্যন্ত শহীদ করেছে। তাই আমি এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই এবং ভবিষ্যতে আর কোনো মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয় এবং কোন সন্তানকে যেন এভাবে না মারা হয়।”
শহীদ রফিকুল ইসলামের মা বলেন- “রফিকুল শিবির করার পর থেকেই নামাজ পড়তে বলত, গ্রামের মানুষ ঝগড়া করলে সে আমাদের সেখান থেকে দূরে থাকতে বলত। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর খাওয়া শেষ করে রফিকুল যখন চলে যাচ্ছে তখন ওর খালা ও আমি বাড়ি থেকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলাম। কে জানত যে, সেটাই তার শেষ দেখা?
আমার ছেলেকে হারানোর দু-একদিন পর এক রাতে ঘুমের মাঝে আমার ছেলে আমার সাথে দেখা করতে এলো। আমি তার সাথে কথা বললাম। আমি বললাম ‘তুই না মরে গেছিস?’ সে বলল, ‘আম্মা, এ কথা আর কখনো তুমি বলবে না। আমি মরে যাইনি, আমি শহীদ হয়েছি।’
হ্যাঁ সে ইসলামের জন্যই শহীদ হয়েছে, আর আমি তার গর্বিত মা। আমার ছেলের কোনো অপরাধ ছিল না। সে এলাকার ছেলেদের কুরআন শেখাতো, নামাজ পড়াতো। এতো সুন্দর সোনার টুুুুুুকরো ছেলেকে যে আওয়ামী হায়েনারা আঘাতের পর আঘাতে আমার বুক খালি করিয়েছে আমি তাদের বিচারের অপেক্ষায় আছি। যদি দুনিয়ায় দেখে যেতে নাও পারি তবে অবশ্যই সবচেয়ে বড় ন্যায়বিচারক মহান আল্লাহর দরবারে বিচার দেখবো ইনশাআল্লাহ।”
শহীদ মাসুমের মায়ের অনুভূতি এমন- “মাসুম লেখাপড়ার পাশাপাশি কুরআন-হাদিসের চর্চা করে এবং আমল করে। ছাত্রশিবিরের একজন ছাত্রকে পিতা-মাতার চক্ষুশীতলকারী সন্তান হিসেবে সমাজে উপহার দেয়। অভাবীদের ও গরিব ছাত্রের ভর্তির টাকার ব্যবস্থা করে নিজের প্রিয় পছন্দের জামাটি পরিয়ে দিয়ে তাকে মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল শহীদ মাসুম।
লেখাপড়ায় ও মেধাবী ছিল। মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসিতে প্রথম বিভাগ ৩টি লেটারসহ ও বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ইংলিশে অনার্সে ভর্তি হয়েছিল। আওয়ামী-সন্ত্রাসীরা তাকে মেরে ফেলল এ কথাটি এখনো এলাকাবাসী সহ্য করতে পারছে না। আল্লাহর কাছে চলে যাওয়ার পর এখন বুঝি কী সম্পদ হারিয়েছি। ওকে আমি একটি মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না। সেই মাসুমকে ছাড়া আমি চোখের পানিকে সাথী করে বেঁচে আছি। সব আছে মাসুম নেই।
আমাদের সন্তানরা নিহত হয়েছে তার সোনার ছেলেদের লগি- বৈঠার আঘাতে। আওয়ামী লীগ কোনোভাবে অস্বীকার করতে পারবে না। তিনি বলেছিলেন, লগি-বৈঠা, অস্ত্র নিয়ে এসেছ।’ আল্লাহপাক অবশ্যই তার বিচার করবেন। এই জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই আমরা শহীদের মা হতে পেরেছি। আল্লাহর পথে বাধা দিতে গিয়ে তারাই ধ্বংসের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে ফেরাউন ও নমরূদের মত। এই আটাশে অক্টোবরে নতুন করে শহীদদের আত্মদানের কথা স্মরণ করে আমাদের দ্বীন কায়েমের পথ চলা হোক আরো বেগবান।”
বাংলার জমিনে প্রতিটি মুহূর্তে আজ শাহাদাতের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। সন্তানহারা পিতা-মাতার আহাজারি, ভাইহারা বোনের আর্তনাদ, পিতাহারা সন্তানের করুণ চাহনি, মা-হারা সন্তানের অব্যক্ত বেদনা বাংলার আকাশ বাতাসকে প্রকম্পিত করছে। এবার শাহীদের তালিকায় যোগ হচ্ছে সমাজের শ্রেণী-পেশার মানুষ। আমিরে জামায়াত থেকে শুরু করে বৃদ্ধবনিতা এমনকি অনেক নিষ্পাপ শিশুও শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা পান করেছেন। আর এর মধ্য দিয়ে ইসলামী আন্দোলন অনেক বেশি জনপ্রিয় ও জনমানুষের আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে। হক ও বাতিলের এই দ্বন্দ্ব কোন সাময়িক বিষয় নয়, এটি চিরস্থায়ী শাহাদাত ইসলামী আন্দোলনের বিপ্লবের সিঁড়ি, কর্মীদের প্রেরণার বাতিঘর, উজ্জীবনী শক্তি, নতুন করে পথচলার সাহস।
২৮ অক্টোবর পল্টনে শাহাদাতের নজরানার মধ্য দিয়ে রাজপথে যে যাত্রা শুরু হয়েছে সে জমিন এখন শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (র), অধ্যাপক গোলাম আযম (র), মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ (র), শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ (র), শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান (র), শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা (র) ও শহীদ মীর কাসেম আলী (র)-এর রক্ত ও স্মৃতিবিজড়িত এ জমিনে বিজয়ের সূচনা করবে ইনশাআল্লাহ। হে বিস্তীর্ণ আকাশ ও জমিনের মালিক! তুমি সকল শহীদের শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান কর। তুমি আমাদের ফরিয়াদকে কবুল কর। হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে সকল ত্যাগের বিনিময়ে বাংলার জমিনে দ্বীন কায়েমের তাওফিক দাও। আমিন।