অধ্যাপক গোলাম আযম কেবল একটি নামই নয়- এ এক ইতিহাস, এক মহানায়কের ইতিহাস, এক যুগস্রষ্টার ইতিহাস। উনাকে নিয়ে ছোট্ট পরিসরে কোন কিছু লেখা সম্ভব নয়। এই কিংবদন্তির জীবন ও কর্ম নিয়ে অনেক উচ্চতর গবেষণা, এমনকি বহু পিএইচডির গবেষণা পর্যন্ত হতে পারে।
ক্ষণজন্মা এই মহান নেতা জীবনের প্রায় সকল দিকে সকলের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। উন্নত চরিত্রের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজের সারাটা জীবন উৎসর্গ করে, খোদাপ্রেম ও দায়ীর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন বিশ্ববাসীর সামনে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ এক ব্যক্তিত্ব-চিন্তা, চেতনা, মেধা, মনন, বিদ্যা, বুদ্ধিসহ সকল মানবীয় গুণাবলির এক বিরল সমন্বয় ঘটেছে এই মানুষটির মাঝে। উনার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের কারণে স্কুলজীবন থেকেই তিনি শিক্ষক-ছাত্র সকলের কাছে ছিলেন আদরণীয়। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় পাকিস্তান আন্দোলনের এক জনসভায় তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে বক্তৃতা করে জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলির পূর্বাভাষ। স্কুল ও কলেজ জীবনে স্কাউটিংয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করে ‘স্কাউট লিডার’ হিসেবে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট উভয় পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান পান। তারপর যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন, তখনই তাঁর প্রতিভার কারণে উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় এক নক্ষত্র হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৪৭-৪৮ সেশনে তিনি ডাকসুর নির্বাচিত জিএস এবং ফজলুল হক হলের নির্বাচিত ভিপির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮-৪৯ সালেও পুনরায় তিনি একই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালের ২৭ নভেম্বর, ডাকসুর জিএস হিসেবে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিসংবলিত স্মারকলিপিটি তিনি পেশ করেন। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে সেটাই প্রথম আনুষ্ঠানিক দাবি। দুঃখজনক হলো, ভাষা আন্দোলনের সেই সেনাপতির ভূমিকা এখন ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছে।
এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি কালের সাক্ষী হয়ে থেকেছেন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে তিনবার গ্রেফতার হন এমনকি শেষ পর্যন্ত রংপুর কারমাইকেল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে চাকরিচ্যুত হন। এরপর থেকেই তিনি সার্বক্ষণিক সক্রিয় রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৫৫-২০০০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৫ বছর নিরলসভাবে তিনি আল্লাহ্র জমিনে আল্লাহ্র দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজের বিদ্যা-বুদ্ধি, মেধা-মনন সবকিছু ঢেলে সর্বাত্মক শ্রম দিয়ে কাজ করে গেছেন। ২০০০ সালে তাঁর দল যখন অত্যন্ত মজবুত ও দৃঢ় অবস্থানে, তখন তিনি সম্পূর্ণ কর্মক্ষম থাকা অবস্থায় স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে আমীরের পদ থেকে অব্যাহতি নেন। কেবল বাংলাদেশের রাজনীতিতেই নয়, বিশ্বের ইতিহাসে কর্মক্ষম থাকা অবস্থায় স্বেচ্ছায় কোনো নেতা অবসর গ্রহণের আর কোনো নজির নেই।
জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞার যে বিরল সমন্বয় ছিল এই মানুষটির মাঝে তা পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি পাওয়া যায় না। ’৬০-এর দশকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে ‘ডাক’ (উঅঈ-উবসড়পৎধঃরপ অপঃরড়হ ঈড়সসরঃঃবব), ‘কপ’ (ঈঙচ- ঈড়সনরহবফ ঙঢ়ঢ়ড়ংরঃরড়হ চধংঃু) এবং ‘পিডিএম’ (চউগ- চধশরংঃধহ উবসড়পৎধঃরপ গড়াবসবহঃ)-এর সব আন্দোলনের পুরোভাগ থেকে আওয়ামী লীগসহ সকল দলের সম্মিলিত কর্মসূচির সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ১৯৭১ সালে তাঁর দূরদৃষ্টির কারণে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে, ভারতের সাহায্যে স্বাধীনতা অর্জন করলে ভারত আমাদের এই দেশকে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও অর্থনৈতিক বাজারে পরিণত করবে। আর তাই তিনি দেশের কল্যাণ ও মঙ্গলের কথা চিন্তা করে সেই যুদ্ধে যোগদান করা থেকে বিরত থাকেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস সাক্ষী যে, অধ্যাপক গোলাম আযমের আশঙ্কা শতভাগ সত্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
অধ্যাপক গোলাম আযম এক বিস্ময়কর মানবপ্রেমী ছিলেন। মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় চিকিৎসাধীন থেকেও নিজেকে নিয়ে কোনো চিন্তা করেননি। তিনি চিন্তা করেছেন গরিব নিকটাত্মীয়দের নিয়ে। আমাকে নাম ধরে ধরে নির্দেশনা দিয়েছেন কাকে কত টাকা পৌঁছাতে হবে। তাঁদের মধ্যে এক অসুস্থ আত্মীয়াকে টাকা দেয়ার সময় ছোট অঙ্কের টাকার নোট দেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন, কারণ সেই অসুস্থ আত্মীয়ার পক্ষে টাকা ভাঙানো কঠিন। কী বিস্ময়কর সূক্ষ্ম চিন্তা ৯২ বছর বয়সী মৃতপ্রায় এই বৃদ্ধ মানুষটির! মানুষের জন্য কতটুকু দরদ থাকলে এই অবস্থায়ও দরিদ্র, অসহায় ও অসুস্থ আত্মীয়দের ব্যাপারে খোঁজ-খবর করেন এবং সাহায্য করার নির্দেশ দেন। আমাকেও উপদেশ দেন গরিব আত্মীয়দের সাধ্যমত সাহায্য করার জন্য।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির বর্তমান সঙ্কটকালে এবং ভারতের করালগ্রাসে বন্দী শতধাবিভক্ত জাতির এই ক্রান্তিকালে একজন অধ্যাপক গোলাম আযমের অনেক প্রয়োজন ছিল। আমরা বড় হতভাগা জাতি। এত বড় মাপের এক বিশ্বনেতার সেবা থেকে বঞ্চিত হলাম। বাতিল আর কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রের ফলে অধ্যাপক গোলাম আযমকে জীবনের সায়াহ্নে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ১০১৬ দিন কারাগারে মানবেতর জীবন কাটিয়ে চলে যেতে হলো। মিথ্যা মামলায় প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে ষড়যন্ত্র করে উনার বৃদ্ধাবস্থায় যে জুলুম উনার ওপর করা হয়েছে, এর প্রতিফল জালিমদের একদিন পেতেই হবে এবং পাবেও ইনশাআল্লাহ্। আর অদূর ভবিষ্যতে কোন একদিন এই ভূখণ্ডে অধ্যাপক গোলাম আযমের সঠিক মূল্যায়ন হবে এবং তিনি যে আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিয়ে গেছেন সেই আদর্শ এই দেশে প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ্।
লেখক : অধ্যাপক গোলাম আযমের ৪র্থ ছেলে
সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল