মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.) ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ সালে ভারতের হায়দরাবাদ দাক্ষিণাত্যের শহর আওরঙ্গাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নিজ জীবনকালের এক মহান ব্যক্তিত্ব। তার অন্তর ছিল আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের যথার্থ ভালবাসা, মুসলিম উম্মাহর দরদ এবং গোটা মানবজাতির কল্যাণকামিতার চেতনায় পরিপূর্ণ। মাওলানা মওদূদী (রহ.) তার রচিত বহুমূখী জ্ঞানে সমৃদ্ধ গ্রন্থাবী ছাড়াও যেই মহামূল্যবান ‘উত্তরাধিকার’ সম্পদ এ পৃথিবীতে রেখে গেছেন, তা হচ্ছে তারই প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘জামায়াতে ইসলামী’।
২৬ আগস্ট ১৯৪১ সাল। পাক-ভারত বাংলা তথা গোটা হিমালয়ান উপমহাদেশের কিছু বিশিষ্ট লোক, যারা আগে থেকেই মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.)-এর অতীব জ্ঞানগর্ভ লেখায় প্রভাবিত ছিলেন এবং তার সম্পাদনাধীন মাসিক ‘তারজুমানুল কুরআন’-এর মাধ্যমে তার চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি এ ব্যক্তিত্বের চারিত্রিক গুণাবলী সম্পর্কে ছিলেন পূর্ণ অবহিত, তারই আহবানে তারা লাহোরে সমবেত হন। ঐ সভাতেই ‘জামায়াতে ইসলামী’ নামক একটি ছোট্ট সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। কয়েক বছর ধরে মওলানা মওদূদীর ব্যক্তিগত বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বেই দলটি চলতে থাকে।
তখন খোদ বিশ্বকবি আল্লামা ইকবালের পরামর্শ ও এই সংগঠনের চালিকা শক্তিরূপে কাজ করে। মওলানা মওদূদী (রহ.) এবং কবি আল্লামা ইকবালের মধ্যে কি গভীর সম্পর্ক ছিল এ থেকেই তা অনুমেয় যে, জামায়াতে ইসলামীর প্রথম কেন্দ্রটি পূর্ব পাঞ্জাবের পাঠানকোট সংলগ্ন ‘দারুল ইসলাম’ নামক একটি বস্তি এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। মওলানা মওদূদীই জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিসের জন্যে দারুল ইসলামকে বেছে নেন। দারুল ইসলামের এ ভূমিটি ছিল পাঞ্জাবের জনৈক জমিদার মরহুম চৌধুরী নিয়াজ আলীর তিনি আল্লামা ইকবালকে এই লক্ষ্যে কমিটি প্রদান করেছিলেন, যেন কবি ইসলামী কর্মকান্ডের প্রধান কেন্দ্র হিসাবে তা ব্যবহার করেন। আল্লামা ইকবাল মাওলানা মওদূদীকে (রহ.) এই মর্মে আহবান জানালেন, তিনি যেন এখানে একটি ইসলামী কেন্দ্র স্থাপন করেন। ব্যাপারটি এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা, যা কারোর অস্বীকার করার উপায় নেই। শুধু তাই নয়, এ ঐতিহাসিক বাস্তবতা দ্বারা ঐ সকল অভিযোগের অসারতা প্রমাণ হয়ে যায়, যা মাওলানা মওদূদী সম্পর্কে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রশ্নে বিরোধিতার অন্যায় অভিযোগ তোলা হয়েছিল। পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা আল্লামা ইকবাল (রহ.) নিজেই গোটা হিমালয়ান উপমহাদেশে মাওলানা মওদূদীকে (রহ.) এরূপ যোগ্য মনে করেছেন যে, তিনিই উক্ত দারুল ইসলামে ইসলামী প্রচার কেন্দ্রের ভিত্তি স্থাপনের যোগ্য ব্যক্তিত্ব। যেখান থেকে উপমহাদেশের মুসলমানরা সার্থক নেতৃত্ব পেতে পারে।
জামায়াতে ইসলামী সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা কেন হয়েছিল? এর কী প্রয়োজন ছিল? যেখানে ঐ সময় আগে থেকেই মুসলিম লীগ এবং মুসলমানদের অন্যান্য দল বিদ্যমান ছিল? মাওলানা সায়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.) এমন কোন ব্যক্তি ছিলেন না যে, শুধু একটি আনুসাঙ্গিক দল সৃষ্টির জন্যে অথবা নিজ নেতৃত্বের জৌলূস দেখাবার উদ্দেশ্যে কোন নতুন দল গঠনের তার প্রয়োজন ছিল। তিনি তার মাসিক গবেষণাধর্মী ম্যাগাজিন ‘তার জুমামুল কোরআন’-এ বিস্তারিতভাবে সেসব কারণ বর্ণনা করেছিলেন যার ফলে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন। মূলত যেই লক্ষ্যণীয় আল্লাহর নির্দেশে মহানবী (সাঃ) নিজ সাহাবীদের সমন্বয়ে সংগঠিত হয়েছিলেন, সেই লক্ষ্য হাসিলের উপযোগী ও সেই কর্মপদ্ধতির অনুসরণের জন্যেই তিনি একটি নতুন দলের চিন্তা করেন। তারই মহানবীর নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছেন মানব ইতিহাসের এক সর্বাত্মক বিপ্লব মানবের সার্বিক কল্যাণের দিক যার সাথে পৃথিবীতে সংঘটিত আর কোনো বিপ্লবেরই তুলনা চলে না।
কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত উদ্দেশ্য লক্ষ্য অর্জনের জন্য তখন মহানবী (সঃ) কর্তৃক মনোনীত কর্মপদ্ধতি অনুযায়ী কাজ করার জন্য একটি দলের প্রয়োজন ছিল। হাদীস শরীফে রয়েছে যে, শেষ যুগেও মুসলিম উম্মাহর সংশোধন ঐ কর্মপদ্ধতিতেই হবে, ইসলামের শুরুতে যেই পদ্ধতিতে এই জাতির সংশোধনের সূচনা হয়েছিল। মহানবী (সঃ) যেসব সুমহান লক্ষ্যে এবং যেই কর্মপদ্ধতির ভিত্তিতে মুসলিম দল গঠন করেছিলেন আজও সেই উদ্দেশ্য লক্ষ্য অর্জন এবং এই জাতির সংশোধন সেই কর্মপদ্ধতিতেই সম্ভব– অন্য কোনো কর্মপদ্ধতিতে নয়। আল্লাহ এবং তার রাসূল (সঃ) মুসলিম জাতির যেই দায়িত্ব কর্তব্য বর্ণনা করেছেন এই জন্যে এই জাতিকে পুনর্বার সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করা অপরিহার্য। আর এই জন্যে প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত দলের মূলত মাওলানা মওদূদী (রঃ) জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করার আগে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তারই ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছিলেন একথাটি স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন যে, মাওলানা মওদূদী (রঃ) নিজের পক্ষ থেকে নতুন কোন ফেকাহ্ প্রদান করেননি, বরং কোরণ ও সুন্নাহর নির্দেশনার অধীনই মুসলিম জাতিকে এক সুমহান লক্ষ্যের অভীশারী করতে সচেষ্টা হয়েছেন।
গোটা হিমালয়ান উপমহাদেশ থেকে প্রথমে মাত্র ৭০/৭২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি সমবেত হয়েছিলেন। তাদের সকলেই তেমন বড় মাপের আলেম ছিলেন না। তবে তাদের মধ্যে এমন কয়েক জন দক্ষ ইসলামী জ্ঞান বিশেষজ্ঞ আলেম ছিলেন যারা ইল্ম ও তাকওয়ার দিক থেকে ছিলেন শীর্ষস্থানীয়। এদের মধ্যে ছিলেন কতিপয় যোগ্য ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তি। আর ছিলেন প্রচুর সাধারণ শিক্ষিত লোক। তাঁরা মাওলানা মওদূদীর লেখায় প্রভাবিত হয়ে এই জামায়াতে শরীক হয়েছিলেন কিন্তু স্বল্পসংখ্যক এই কতিপয় লোক যারা ছিলেন দরিদ্র, অতি সামান্য মূলধন হাতে নিয়ে একটি নতুন দলের ভিত্তি স্থাপন করলেন। তারা নিজেদের পক্ষ থেকে এই দলটির জন্য কোনো আকীদা বিশ্বাস ও লক্ষ্য উদ্দেশ্য পেশ করেননি। বরং কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে দলটির আকীদা-বিশ্বাস ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেন, যা জামায়াতে ইসলামী গঠনতন্ত্রে পূর্ণ ব্যাখ্যা সহকারে বর্ণিত হয়েছে। তা হচ্ছে– ‘‘আমাদের আকীদা হলো : লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোনো ‘ইলাহ’ নেই। মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল)। এটি হচ্ছে সেই আকীদা বিশ্বাস যা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক খোদ আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন এবং মহানবী (সাঃ) নিজ উম্মতের প্রতিটি ব্যক্তিকে এর শিক্ষা-প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। মওলানা মওদূদী (রহ.) তার নিকট আকীদা বিশ্বাসের ব্যাপারে সে কথাই জানিয়েছেন যে কথার ওপর গোটা মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা যেতে পারে। এটা কারও পক্ষেই অস্বীকারের উপায় নেই যে, মুসলিম জাতির মৌলিক আকীদা বিশ্বাস হচ্ছে একমাত্র লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)। যার ভিত্তিতে গোটা মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা যেতে পারে। এর সেই ব্যাখ্যাই সঠিক ও নির্ভরযোগ্য যা পবিত্র কুরআনে বিদফোন : ০১৭১৫৮১৯টি উপেক্ষা করে মনগড়া ব্যাখ্যা দিতে গেলেই ইখতেলাফ ও মতবিরোধী দেখা দেয়। কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক আকীদা-বিশ্বাসের বিস্তারিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দানের সঙ্গে সঙ্গে মাওলানা মওদূদী (রহ.) জামায়াতে ইসলামীর প্রকৃত লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি তাও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন শব্দে বর্ণনা করেছেন যে, আমাদের উদ্দেশ্য লক্ষ্য হচ্ছে একমাত্র বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। আমাদের সকল কর্মপ্রচেষ্টা এ জন্যেই নিবেদিত যেন আল্লাহ আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন এবং আখেরাতে মুক্তি ও সফলতা আমাদের ভাগ্যে জুটে। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতে মুক্তি লাভের জন্যে সেই কর্মপদ্ধতিই সকলের গ্রহণ করা কর্তব্য, মহানবী (সা.) যেই কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন। জামায়াতে ইসলামী সেই কর্মপদ্ধতি এভাবে স্পষ্ট ভাষায় চিহ্নিত করেছে যে, মানুষকে একমাত্র আল্লাহর দিকেই দাওযাত দিবে, শুধু তাঁর দিকেই সকলকে আহবান জানাবে। মাওলানা মওদূদী (রহ.) এবং জামায়াতে ইসলামী কিংবা অপর কোনো দল, দলনেতা অথবা কোনো ব্যক্তিত্বের দিকে কখনও জানাবে না। পবিত্র কুরআনও এই কর্মপদ্ধতিকে সঠিক আখ্যায়িত করে স্বল্পশব্দে বলে দিয়েছে,-
কুল্ হাযিহী সাবীলী, উদঊ ইলাল্লাহে আলা বাসীরাতি আনা ও মানিত্তাবাআনী (অর্থাৎ হে নবী; আপনি জানিয়ে দিন যে, আমার পথ তো এটাই যে, আমি আল্লাহর দিকে মানুষকে দাওয়াত দেই। আমি এবং আমার অনুসরণকারীরা পূর্ণ আলোতে নিজ রাস্তা দেখতে পাচ্ছে। (সূরা ইউসুফ : আয়াত ১০৮)
আমরা মৌলিকভাবেই আল্লাহর প্রতি মানুষকে দাওয়াত দেয়ার লক্ষ্যেই এই জামায়াত গঠন করেছি। শুধু একটি জামায়াত বা দল গঠনই উদ্দেশ্য নয় বরং এটি আল্লাহর প্রতি মানুষকে ডাকার আসল উদ্দেশ্যের একটি মাধ্যম মাত্র।
এ নিয়ে ওলামা-এ-কেরামের মধ্যে বহু বাহাস-গবেষণা হয়েছে যে, আল্লাহর প্রতি মানুষকে দাওযাত দানের জন্যে কোনো জামায়াত বা দল গঠন বৈধ অথবা উম্মতের প্রতিটি মানুষ ব্যক্তিগতভাবে এ কাজ সম্পাদন করবে? অবশেষে তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, কোনো একটি দল সংগঠিত করা ছাড়া এ মহান লক্ষ্যের দাওয়াতী কাজ কার্যকর হবে না। সুতরাং এ জন্যে একটি দল সংগঠন কারা অত্যাবশ্যক। তবে সঙ্গে সঙ্গে একথাও স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়া হয় যে, আল্লাহর প্রতি মানুষকে দাওয়াত দানের লক্ষ্যে গঠিত কোনো জামায়াত বা দল এ দাবি করতে পারবে না যে, তাতে যেসব লোক শামিল না হবে, তারা গোমরাহ বা পথহারা। কেননা, কোনো সংগঠিত দল বা জামায়াতের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি মানুষকে দাওয়াত দেয়াটা, মহানবী (সা.) এরই পদ্ধতি। সুতরাং এই পদ্ধতিতে জাতিকে সংশোধন ও পরিশুদ্ধ করার জন্যে আমরা জামায়াত আকারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। যাদের সুযোগ হয় এবং এ পদ্ধতি যারা পছন্দ করে, তারা আমাদের সঙ্গে মিশে কাজ করতে পারেন। যারা আমাদের সাথে মিলে কাজ করতে অনিচ্ছুক তাদের কর্তব্য হলো, এ মহান কাজ সম্পাদনকল্পে, তারা সম্মিলিতভাবে সংগঠিত হোন। নবী মুহাম্মদ (সা.) ছাড়া অপর কেউ এই দাবি করতে পারবে না যে, যারা আমার অনুসরণ না করে, তারা গোমরাহ পথভ্রষ্ট। একমাত্র আল্লাহর কোনো নবীই একথা বলতে পারেন। শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর পর আর কোনো নবী আসবেন না। তিনিই খাতামুন্নাবীঈন। অপর কোনো জাতিও এ দাবি করতে পারবে না যে, তাদের সঙ্গে মিলে কাজ করতে অস্বীকারকারীরা পথভ্রষ্ট-গোমরাহ। মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.) নতুন কোনো ধর্ম প্রবর্তন করেননি। তেমনি এটা কোনো নতুন দল বা ফেরকাও নয়। এ জামায়াত কখনও মানুষকে একথাও বলেনি যে, আমাদের সঙ্গে যারা না আসবে, তারা গোমরাহ ভ্রান্ত।
জামায়াতে ইসলামী কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা আদর্শমাফিক যেই আকীদা-বিশ্বাস, উদ্দেশ্য-লক্ষ্য কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছে, এগুলোর ভিত্তিতেই দলটি মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়। যারা এ দাওয়াত গ্রহণ করে মহানবী (সা.)-এর অনুসৃত নীতি অনুসারে জামায়াত তাদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক ও কর্মপদ্ধতিগত প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এভাবে তাদেরকে আত্মশুদ্ধি, আল্লাহপ্রীতির প্রশিক্ষণ দিয়ে জামায়াত তাদের অন্তর থেকে নেফাক তথা দ্বিমুখী নীতি, কর্ম বৈপরীত্ব ও চিন্তার বৈষম্য দূর করে। তাদের মধ্যে ইসলামের কাক্মিখত মানবের গুণাবলী সৃষ্টির চেষ্টা করে।
এ পদ্ধতিতে তাদের চিন্তা, মনন ও চরিত্র গঠনের কাজ সমাপ্তির পর তাদেরকে এমন এক সুসংগঠিত ও দলভুক্ত করে, যে দলটি উল্লেখিত মানদন্ডে সমাজ সংস্কার ও সংশোধনে তৎপর হয়ে ওঠে। এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুসংগঠিত দলটির মাধ্যমেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং চেষ্টা সাধনা অব্যাহত রেখে আসছে।
উদ্দেশ্য, যাতে সমাজ ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব কর্তৃত্ব কোনো অসৎ নেতৃত্বের হাতে না গিয়ে সৎ নেতৃত্বের হাতে যায়। কারণ অসৎ নেতৃত্বে শোষণ, জুলুম-নিপীড়নে মানুষ একদিকে যেমন বৈষয়িক শান্তি-সুখ, নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হয়, অপরদিকে পরজীবনের মুক্তি ও কল্যাণের পথ থেকেও তারা বিচ্যুত হয়ে পড়ে। মহানবী (সা.) মদীনা কেন্দ্রিক একটি ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঐ রাষ্ট্রকে তিনি সংশোধনও করেছেন। ক্ষমতায় সমাসীন অযোগ্য অসৎ নেতৃত্ব অপসারণ করে তিনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, সৎ, খোদাভীরু যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী ((রহ.) মুসলিম জাতির মধ্যে ঐক্য-সংহতি প্রতিষ্ঠায় সকল সময় সচেষ্ট ছিলেন। তাঁর এই আহবানে সাড়া দিয়ে যারা তাঁর সঙ্গে এসে এ মহান কাজে শরীক হননি, তিনি তাদের ব্যাপারে কখনও একথা বলেননি যে, তারা ভ্রান্ত পথের অনুসারী। জাতিকে সুমহান লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে জামায়াত একটি আন্দোলন, যেই আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন মাওলানা মওদূদী (রহ.)। জামায়াতে ইসলামী যদি কোনো একটি সম্প্রদায় হতো আজ আমরা কুরআন-সুন্নাহ ছেড়ে বিশেষ কোনো মতানুসারী হতাম, তাহলে জাতীয় ঐক্য-সংহতি বিধানে কোনোই অবদান রাখতে পারতাম না। এই খেদমতটি এ জন্যেই সম্পন্ন হবার যোগ্য যে, আমরা কুরআন ও সুন্নাহ ছাড়া কোনো মতবিশেষের সঙ্গে নিজেকে জড়িত করিনি।
এ সময় মুসলিম উম্মাহর সামনে যেই চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান তা হলো, আমেরিকা গোটা মুসলিম জাহানের বিরুদ্ধে এক অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছে। সে বিশ্ব এবং বিশ্ববাসীর উপর নিজের ইচ্ছা আধিপত্য ও শোষণমূলক ব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে চায়। তার পাল্টা মুসলমানদের কাছে রয়েছে, আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামী কল্যাণধর্মী জীবন ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া অপরিহার্য। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জন্য মুসলিম উম্মাহর একনিষ্ঠ ও ঐক্যবদ্ধ হওয়া সময়ের মস্ত বড় দাবি। জামায়াতে ইসলামী এই ঐক্যেরই আহবায়ক। এ জন্যেই জামায়াত নিজেকে কোনো বিশেষ ধর্মীয় মত ও সম্প্রদায়ে পরিণত করেনি, যেন তারা জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে বরং এই উম্মতের মধ্য থেকেই মুসলমানদেরকে তওহীদের একই প্লাটফরমে সমবেত করে মহানবীর কর্মপদ্ধতি মোতাবেক তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবানের কাজে ভুক্ত করতে সচেষ্ট, যেন ভূপৃষ্ঠ পুনরায় নবুওত পদ্ধতির খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যেই খেলাফত তথা রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল আল্লাহর নবীর জীবদ্দশায়, ছিল সাহাবা-এ-কেরামের শাসনকালের সোনালী যুগে।
লেখক : সাবেক পাকিস্তান আমীরে জামায়াত
অনুবাদক : জুলফিকার আহমদ কিসমতি