সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী ছিলেন একজন মুসলিম গবেষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা ও বিংশ শতাব্দীর একজন গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী চিন্তাবিদ, মুজাদ্দিদ ও দার্শনিক। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ছিলেন। তিনি জামায়াতে ইসলামী নামে একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলেরও প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিম স্কলারদের মধ্যে একজন। তিনি ইতিহাসের দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ ব্যক্তি যার গায়েবানা জানাজার নামাজ পবিত্র কাবাতে পড়া হয়।
জন্ম :
মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.) ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ সালে ভারতের হায়দরাবাদ দাক্ষিণাত্যের শহর আওরঙ্গাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন তার বাবা মাওলানা আহমদ হাসান এর তিন সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। তাঁর পিতা ছিলেন চিশতি ধারার বংশধর। তাঁর পিতা ও মাতা উভয়ের পরিবার আফগানিস্তান থেকে ভারতে এসেছিলেন।
শিক্ষা ও ক্যারিয়ার :
শৈশবে নয় বছর পর্যন্ত মওদূদীকে গৃহশিক্ষা দেওয়া হয়, তিনি তার পিতার হাতে এবং তার দ্বারা নিযুক্ত বিভিন্ন শিক্ষকের কাছ থেকে ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন। এই শিক্ষার মধ্যে ছিল আরবি, ফারসি, ইসলামী আইন ও হাদীস শিক্ষা। তিনি মানতিক (যুক্তিবিদ্যা) বইগুলিও অধ্যয়ন করেন। এগারো বছর বয়সে তিনি আরবি থেকে উর্দু ভাষায় কাশিম আমিনের আল মারহা আল-জাদিদাহ অনুবাদ করেছিলেন। ১৯২১ সালে তিনি দিল্লির মাওলানা আব্দুস সালাম নিয়াজির কাছে আরবি ভাষা ও ব্যাকরণ শিক্ষা গ্রহণ করেন। মাওলানা মওদূদী ১৯২৬ সালে দিল্লির ‘দারুল উলুম ফতেহপুরি’ থেকে ‘উলুম-এ-আকালিয়া ওয়া নাকালিয়া’ সনদ লাভ করেন। ১৯২৮ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে ‘জামে তিরমিযি’ এবং ‘মুয়াত্তা ইমাম মালিক’ সনদ লাভ করেন।
ছোটবেলা থেকেই মাওলানা সাংবাদিক হিসেবে ক্যারিয়ার তৈরি করেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি ‘বিজনোর’ পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯২০ সালে ‘তাজ’ পত্রিকার এডিটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯২১ সালে ‘দৈনিক মুসলিম’ পত্রিকার এডিটর হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর ১৯২৫ সালে ‘আল জামিয়াহ’ পত্রিকার এডিটর হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এটি ছিলো মুসলিমদের জনপ্রিয় পত্রিকা। ১৯৩৩ সালে ভারতের হায়দারাবাদ থেকে নিজেই ‘তরজুমানুল কুরআন’ নামক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। এই পত্রিকার মাধ্যমেই তিনি তার চিন্তা প্রচার করতে শুরু করেন।
জামায়াত প্রতিষ্ঠা :
২৬ আগস্ট ১৯৪১ সাল। পাক-ভারত বাংলা তথা গোটা হিমালয়ান উপমহাদেশের কিছু বিশিষ্ট লোক, যারা আগে থেকেই মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ.)-এর অতীব জ্ঞানগর্ভ লেখায় প্রভাবিত ছিলেন এবং তার সম্পাদনাধীন মাসিক ‘তারজুমানুল কুরআন’-এর মাধ্যমে তার চিন্তাধারা, দৃষ্টিভঙ্গি এ ব্যক্তিত্বের চারিত্রিক গুণাবলী সম্পর্কে ছিলেন পূর্ণ অবহিত, তারই আহবানে তারা লাহোরে সমবেত হন। ঐ সভাতেই ‘জামায়াতে ইসলামী’ নামক একটি ছোট্ট সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। কয়েক বছর ধরে মাওলানা মওদূদীর ব্যক্তিগত বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বেই দলটি চলতে থাকে।
তখন খোদ বিশ্বকবি আল্লামা ইকবালের পরামর্শ ও এই সংগঠনের চালিকা শক্তিরূপে কাজ করে। মাওলানা মওদূদী (রহ.) এবং কবি আল্লামা ইকবালের মধ্যে কি গভীর সম্পর্ক ছিল এ থেকেই তা অনুমেয় যে, জামায়াতে ইসলামীর প্রথম কেন্দ্রটি পূর্ব পাঞ্জাবের পাঠানকোট সংলগ্ন ‘দারুল ইসলাম’ নামক একটি বস্তি এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। মওলানা মওদূদীই জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিসের জন্যে দারুল ইসলামকে বেছে নেন। দারুল ইসলামের এ ভূমিটি ছিল পাঞ্জাবের জনৈক জমিদার মরহুম চৌধুরী নিয়াজ আলীর তিনি আল্লামা ইকবালকে এই লক্ষ্যে কমিটি প্রদান করেছিলেন, যেন কবি ইসলামী কর্মকান্ডের প্রধান কেন্দ্র হিসাবে তা ব্যবহার করেন। আল্লামা ইকবাল মাওলানা মওদূদীকে (রহ.) এই মর্মে আহবান জানালেন, তিনি যেন এখানে একটি ইসলামী কেন্দ্র স্থাপন করেন।
ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন :
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ এই কথা বলে প্রচার চালিয়েছেন একটি স্বাধীন দেশ হাতে পেলে তাঁরা দেশটিকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করবেন। এতে সাধারণ মুসলিম তাদের পক্ষে জনমত গড়ে তুলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পাবার পর তারা সেইসব কথা ভুলে যেতে থাকেন। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে গিয়ে তারা আলোচনা শুরু করেন পাকিস্তানের জন্য বৃটিশ পার্লামেন্টারি সিস্টেম উপযোগী, না আমেরিকান প্রেসিডেনশিয়াল সিস্টেম, তা নিয়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয় ইসলামপন্থী মানুষরা।
১৯৪৮ সনের এপ্রিল মাসে করাচির জাহাংগীর পার্কে জামায়াতে ইসলামীর প্রথম রাজনৈতিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান বক্তা ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী। তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য পেশ করেন। বক্তব্যে তিনি পাকিস্তানের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত গণপরিষদের প্রতি চারটি দফার ভিত্তিতে ‘আদর্শ প্রস্তাব’ গ্রহণ করার উদাত্ত আহ্বান জানান।
দফাগুলো হচ্ছে
১। সার্বভৌমত্ব আল্লাহর। সরকার আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দেশ শাসন করবে।
২। ইসলামী শরীয়াহ হবে দেশের মৌলিক আইন।
৩। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক আইনগুলো ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত করে ইসলামের সাথে সংগতিশীল করা হবে।
৪। ক্ষমতা প্রয়োগ করতে গিয়ে রাষ্ট্র কোন অবস্থাতেই শরীয়াহর সীমা লংঘন করবে না।
এইভাবে জামায়াতে ইসলামী ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন শুরু করে। আরো জানতে ক্লিক করুন।
কাদিয়ানীদেরকে অমুসলিম ঘোষণার আন্দোলন :
১৯৫৩ সনের জানুয়ারি মাসে জামায়াতে ইসলামী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, মাজলিসে আহরার, জমিয়তে আহলে হাদীস, মুসলিম লীগ, আনজুমানে তাহাফ্ফুযে হুকুকে শিয়া প্রভৃতি দল করাচিতে একটি সম্মেলনে মিলিত হয়। জামায়াতে ইসলামী প্রস্তাব করে যে কাদিয়ানী ইস্যুটিকে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত করে নেওয়া হোক। সেই সম্মেলনে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হলো না।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসে করাচিতে সর্বদলীয় নির্বাহী পরিষদের মিটিং ডাকা হয়। এই মিটিংয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশনের’ পক্ষে প্রবল মত প্রকাশ পায়। জামায়াতে ইসলামী গোড়া থেকেই শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলো বিধায় ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশনের’ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সর্বদলীয় নির্বাহী পরিষদ থেকে বেরিয়ে আসে।
১৯৫৩ সনের মার্চ মাসে কাদিয়ানীদের বিরুদ্ধে কতিপয় দলের ডাইরেক্ট এ্যাকশনের ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এই অবনতি পাঞ্জাবেই ঘটেছিলো বেশি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মার্শাল ল’ ঘোষণা করা হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসে যায়।
মাওলানা মওদুদীর গ্রেফতার ও ফাঁসির আদেশ :
যদিও ডাইরেক্ট এ্যাকশনের বিপক্ষে ছিল জামায়াত তারপরও ১৯৫৩ সনের ২৮শে মার্চ মার্শাল ল’ কর্তৃপক্ষ সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী ও আরো কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করে। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার, সামরিক ট্রাইব্যুনাল ১৯৫৩ সনের ৮ই মে সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদুদীকে ফাঁসির হুকুম দেয়। জামায়াতে ইসলামীর জনশক্তি এবং সকল শ্রেণীর ইসলামী ব্যক্তিত্ব এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক ও বলিষ্ঠ আন্দোলনে নেমে পড়ে। ফলে সরকার মৃত্যুদণ্ড রহিত করে সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদীর চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের কথা ঘোষণা করে।
তবে দুই বছর একমাস জেলে থাকার পর ১৯৫৫ সনের ২৯শে এপ্রিল সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদুদী মুক্তি লাভ করেন। তাঁকে মেরে ফেলার চক্রান্তের আসল লক্ষ্য ছিলো ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের বলিষ্ঠতম কণ্ঠটিকে স্তব্ধ করে দেওয়া। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছা ছিলো ভিন্ন। তিনি মুক্তি পান। আর ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন বহুগুণ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। গণদাবির মুখে গণপরিষদ ১৯৫৬ সনের ২৯শে ফেব্রুয়ারি একটি শাসনতন্ত্র পাস করে।
শাসনতন্ত্র বাতিল ও পুনরায় আন্দোলন :
১৯৫৮ সনের ২০শে সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খান সরকারের প্রতি আস্থা ভোটের জন্য পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসে। অধিবেশনে স্পিকার আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাস হয়। স্পিকারের দায়িত্ব লাভ করেন ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পাটোয়ারী। পরিষদে হট্টগোল চলতে থাকে। উত্তেজিত সদস্যদের আঘাতে শাহেদ আলী পাটোয়ারী মারাত্মক আহত হন। তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি হাসপাতালে মারা যান।
১৯৫৮ সনের ৭ই অকটোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কানদার আলী মির্যা দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। জাতীয় পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদসমূহ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভাগুলো ভেঙ্গে দেন। নয় বছরের চেষ্টাসাধনার ফসল শাসনতন্ত্রটি বাতিল করে দেন।
প্রধান সামরিক প্রশাসক নিযুক্ত হন সেনাপ্রধান জেনারেল মুহাম্মাদ আইউব খান। ২৭ অক্টোবর আইউব খান প্রেসিডেন্ট পদটিও দখল করেন। চলতে থাকে এক ব্যক্তির স্বৈরশাসন। ১৯৬২ সনের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্ট আইউব খান দেশের জন্য একটি নতুন শাসনতন্ত্র জারি করেন। এটি না ছিলো ইসলামিক, না ছিলো গণতান্ত্রিক। এতে বিধান রাখা হয়, দেশের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদের সদস্যগণ এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’দের দ্বারা নির্বাচিত হবেন। আর ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ হবেন পূর্ব পাকিস্তানের ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যান ও মেম্বার মিলে ৪০ হাজার জন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যান ও মেম্বার মিলে ৪০ হাজার জন। অর্থাৎ ৮০ হাজার ব্যক্তি ছাড়া দেশের কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।এই আজগুবী শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম আওয়াজ তোলে জামায়াতে ইসলামী।
১৯৬২ সনে রাওয়ালপিন্ডির লিয়াকতবাগ ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী এই স্বৈরতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন এবং জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান। এতে প্রেসিডেন্ট আইউব খান ক্ষেপে যান। তাঁরই নির্দেশে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এবং পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ১৯৬৪ সনের ৬ই জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনী ঘোষণা করে। আমীরে জামায়াত সহ মোট ৬০ জন শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।
বন্দিদের মধ্যে ছিলেন- আমীরে জামায়াত সাইয়েদ আবুল আ‘লা মওদূদী, মিয়া তুফাইল মুহাম্মাদ, নাঈম সিদ্দিকী, নাসরুল্লাহ খান আযিয, চৌধুরী গোলাম মুহাম্মাদ, মাওলানা ওয়ালীউল্লাহ, মাওলানা আবদূর রহীম, অধ্যাপক গোলাম আযম, জনাব আবদুল খালেক, ইঞ্জিনিয়ার খুররম জাহ মুরাদ, অধ্যাপক হেলালুদ্দীন, মাস্টার শফিকুল্লাহ, মাওলানা এ.কিউ.এম. ছিফাতুল্লাহ, অধ্যাপক ওসমান রময্, মাস্টার আবদুল ওয়াহিদ (যশোর), আবদুর রহমান ফকির, জনাব শামসুল হক, মাওলানা মীম ফজলুর রহমান প্রমুখ।
জনাব আব্বাস আলী খান, জনাব শামসুর রহমান ও মাওলানা এ.কে.এম. ইউসুফ জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন বিধায় গ্রেফতার হননি। এবারও জামায়াতে ইসলামীর জনশক্তি উচ্চমানের ধৈর্যের উদাহরণ পেশ করেন।
জামায়াতে ইসলামী সরকারের অন্যায় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। স্বনামধন্য আইনজীবী মি. এ.কে. ব্রোহীর নেতৃত্বে একটি টিম মামলা পরিচালনা করে। পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর বিপক্ষে এবং পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে রায় দেয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে যায়। সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে রায় দেয়। ১৯৬৪ সনের ৯ই অকটোবর জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দ কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।
‘কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ’ :
১৯৬৪ সনের ২০শে জুলাই ঢাকায় খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আইউব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক জোট গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। এই জোটের নাম দেওয়া হয় ‘কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ’। এতে শরীক ছিল কাউন্সিল মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও নেযামে ইসলাম পার্টি।
১৯৬৪ সনের সেপ্টেম্বর মাসে ‘কম্বাইন্ড অপোজিশন পার্টিজ’ ১৯৬৫ সনের ২রা জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিতব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইউব খানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মি. মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহর বোন মিস ফাতিমা জিন্নাহকে নমিনেশন দেয়।
এই সময় জামায়াতে ইসলামী ছিলো বেআইনী ঘোষিত। নেতৃবৃন্দ ছিলেন জেলখানায়। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মাজলিসে শূরার যেইসব সদস্য জেলের বাইরে ছিলেন, তাঁরা ১৯৬৪ সনের ২ অক্টোবর একটি মিটিংয়ে একত্রিত হন। ‘আলোচনান্তে মাজলিসে শূরা অভিমত ব্যক্ত করে যে স্বাভাবিক অবস্থায় একজন মহিলাকে রাষ্ট্রপ্রধান করা সমীচীন নয়। কিন্তু এখন দেশে চলছে এক অস্বাভাবিক অবস্থা। স্বৈরশাসক আইউব খানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষেত্রে মিস ফাতিমা জিন্নাহর কোন বিকল্প নেই। এমতাবস্থায় সার্বিক অবস্থার নিরিখে জামায়াতে ইসলামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মিস ফাতিমা জিন্নাহকেই সমর্থন করবে।’
স্বৈরাচারী আইয়ুবের কবলে জামায়াতে ইসলামী :
আইয়ুবের শাসনামলে জামায়াতের আমীর মাওলানা মওদূদীকে কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়। ১৯৬৪ সালে জাময়াতে ইসলামীকে হঠাৎ বেআইনী ঘোষণা করা হলো। জামায়াতে ইসলামী ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানের দাবিতে সমগ্র দেশব্যাপী স্বাক্ষর অভিযান পরিচালনা করে। এ অভিযানের ফলে মৌলিক অধিকারের দাবি তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আইনের খসড়া বিল পরিষদে গৃহীত হওয়া সত্ত্বে ও প্রেসিডেন্ট ইচ্ছাপূর্বক তাতে স্বাক্ষর দিতে বিলম্ব করেন।
১৯৬৪ সালের ৬ই জানুয়ারী জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং নেতাদের গ্রেফতার করে তারপর ১০ই জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট উক্ত বিলে স্বাক্ষর করে। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে তার এ পদক্ষেপও জামায়াতকে খতম করতে সক্ষম হয়নি। হাইকোর্ট জামায়াত নেতাদের গ্রেফতারী এবং সুপ্রিম কোর্ট জামায়াতের নিষিদ্ধকরণের নিদের্শকে বাতিল ঘোষণা করে। এর আগে ১৯৫৮ সালেও সামরিক আইনে জামায়াত ৪৫ মাস নিষিদ্ধ ছিলো।
ইসলামী সাহিত্য :
মাওলানা মওদূদী ইসলামকে যথাযথভাবে উপস্থাপনের জন্য বহু গ্রস্থ রচনা করেছেন। তিনি প্রথম একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করেন ১৯২৭ সালে, তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ২৪ বছর। আল জিহাদ ফিল ইসলাম ছিলো বইটির নাম। তিনি কুরআন, হাদীস, ইসলামী জীবন ও দর্শন, আইন, রাজনীতি, রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থা, ইসলামী আন্দোলন, অর্থনীতি, ব্যাংক ব্যবস্থা, দাম্পত্য জীবন, তাজকিয়ায়ে নফস, সীরাত ইত্যাদি বিষয়ে শতাধিক বই রচনা করেন। তার বড় অবদান ছিলো তিনি তাফহীমুল কুরআন রচনা করেছেন। এই তাফসীর গ্রন্থ তিনি প্রায় তিরিশ বছর ধরে রচনা করেন। তার সর্বশেষ গ্রন্থ সীরাতে সরওয়ারে আলম প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে।
শেষ জীবন :
মাওলানা মওদূদী ১৯৭২ সালে জামায়াতের আমীরের পদ থেকে ইস্তফা দেন। এই বছরেই তিনি তাফহীমুল কুরআন রচনা শেষ করেন। ১৯৭৯ সালে তিনি বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পাকিস্তান থেকে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় পাঠানো হয়। সেখানেই ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯ সালে ইন্তেকাল করেন যুগশ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী। সারা পৃথিবীতে বহুস্থানে এমনিকি কা’বার সামনে তার গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। লাহোরে বিশাল জানাজা শেষে সেখানেই তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়।