ইসলামী অর্থনীতির প্রথম যে মডেল মদিনায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তাতে শরিয়তের সীমার মধ্যে উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় ও ভোগের স্বাধীনতা ছিল। এ স্বাধীনতাকে পুঁজিবাদী হিসেবে গণ্য করা যায় না। কেননা মদিনার ইসলামী অর্থনীতি পুঁজিবাদ চালু হওয়ার বহু আগেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। কাজেই ইসলাম পুঁজিবাদ থেকে কিছু নিয়েছে, এ কথা বলা যায় না।
ইসলামের অর্থনীতির লক্ষ্য কী, তা আমাদের জানতে হবে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী অর্থনীতির মূল লক্ষ্যগুলো নিম্নরূপ :
ক. অর্থনীতিতে সুবিচার প্রতিষ্ঠা : ইসলাম অর্থনীতিসহ সর্বক্ষেত্রে সুবিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কুরআনে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে : আল্লাহ তোমাদের আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠা করার আদেশ করেছেন। (সূরা নাহল : আয়াত ৯০) লোকদের মধ্যে যখন কোনো বিষয়ে ফয়সালা করবে, তখন ইনসাফের সাথে করবে। (সূরা নিসা : আয়াত ৫৮)
সূরা নাহলে যে আদেশ আল্লাহ তায়ালা করেছেন, তা যেমন ব্যক্তির ওপর প্রযোজ্য, তেমনি প্রযোজ্য সরকারের ওপর। কাজেই সরকারকে শ্রমিক, কৃষকসহ সব শ্রেণী ও গোষ্ঠীর প্রতি সুবিচার করতে হবে। ব্যক্তি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরও দায়িত্ব একই। সূরা নাহলে আল্লাহপাক কেবল সুবিচারের কথাই বলেননি, ইহসান বা সদাচরণের কথাও বলেছেন। সুবিচার পাওয়া তো প্রত্যেকের অধিকার। তবে সুবিচারের অতিরিক্ত জনগণকে দিতে হবে এবং সেটিই হচ্ছে, ইহসান। সূরা নিসার আয়াতের আলোকে বিভিন্ন অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর পারস্পরিক দ্বন্দ্ব মীমাংসা করার জন্য উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান বা আদালত থাকতে হবে, যা বিরোধের মীমাংসা করবে সুবিচারের সাথে এবং অধিকার আদায় করে দেবে।
খ. নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের স্বার্থ সংরক্ষণ : নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের প্রতি আল্লাহ বিশেষভাবে সহানুভূতিশীল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাকের ঘোষণা হচ্ছে : পৃথিবীতে যারা নির্যাতিত ও বঞ্চিত তাদের অনুগ্রহ করতে চাই। তাদের পৃথিবীতে ইমাম (নেতা) ও উত্তরাধিকারী বানাতে চাই। তাদের পৃথিবীতে ক্ষমতাসীন করতে চাই। (সূরা কাসাস : আয়াত ৫-৯)
এ হচ্ছে বঞ্চিতদের সম্পর্কে আল্লাহ পাকের সাধারণ নীতি। ‘উত্তরাধিকারী’ করার অর্থ হচ্ছে এমন সুযোগ-সুবিধা দেয়া, যাতে বঞ্চিতরা পৃথিবীকে ন্যায়সঙ্গতভাবে উপভোগ করতে পারে। এ নীতির অর্থ, এমন বেতন, সুবিধা, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বসবাসের সুবিধা, যা তাদের জীবনকে সুন্দর করে তোলে। কাজেই ইসলামী অর্থনীতিতে এমন সব আইন, বিধি, নীতি, প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে সাধারণ লোকজনের স্বার্থ বিশেষভাবে রক্ষিত হয় এবং তা কোনোভাবে ক্ষুণ্ণ না হয়।
গ. অর্থনীতিতে সুনীতি প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি উৎখাত করা : এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা যে সাধারণ নীতি দিয়েছেন (যা অর্থনীতিতেও সমভাবে প্রযোজ্য) তা হচ্ছে : যাদের পৃথিবীতে ক্ষমতা দেয়া হয় তাদের দায়িত্ব হচ্ছে সালাত ও জাকাতের প্রতিষ্ঠা, মারুফ-এর (সুকৃতি বা ভালো কাজ) আদেশ দেয়া এবং মুনকার (দুর্নীতি) প্রতিরোধ করা। (সূরা হজ : আয়াত ৪১)
এ ধরনের বহু আয়াত কুরআন মাজিদে রয়েছে। এসব আয়াতের ‘মারুফ’ ও ‘মুনকার’ শব্দকে সামগ্রিক অর্থে গ্রহণ করতে হবে, কেবল নৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ করলে চলবে না। এ আয়াতের আলোকে ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য হচ্ছে এমন সব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, নীতি, পলিসি ও প্রতিষ্ঠান কায়েম করা, যাতে কল্যাণের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা ঘটে এবং দুর্নীতি দূর হয়। একইভাবে এ আয়াতের তাৎপর্য হলো, অর্থনীতি থেকে এমন সব ব্যবস্থা, নীতি, পলিসি, প্রতিষ্ঠান, আইন সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ, অপসারণ ও দূর করা- যার ফলে জনগণের কল্যাণ সাধিত হয়। এসব কাজ করা ইসলামী সরকার ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অবশ্য কর্তব্য।
ঘ. জনগণের সহজ জীবন নিশ্চিত করা : আল্লাহ পাক নবী সা:-এর অন্যতম দায়িত্ব এভাবে নির্ধারণ করেছেন : তিনি তাদেরকে বোঝা থেকে মুক্ত করেন এবং যেসব শিকলে তারা আবদ্ধ, তা থেকে তাদের মুক্ত করেন। (সূরা আরাফ : আয়াত ১৫৭)
নবী সা:-এর উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রতিটি মুসলিম সরকার ও কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হচ্ছে মানুষকে সেসব অন্যায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ, বিধিবিধান ও নিয়মনীতি থেকে উদ্ধার করা, যা জনগণের জীবনের ওপর ‘বোঝা ও শিকল’ হয়ে আছে। অপ্রয়োজনীয় রীতি-রেওয়াজ ও আইনকানুন মানুষের জীবনের স্বাধীনতা ও শান্তি নষ্ট করে দেয়। কাজেই ইসলামী সমাজ আর অর্থনীতিতে কোনো অপ্রয়োজনীয় বিধিবিধানের স্থান নেই। এ ক্ষেত্রে কোনটি প্রয়োজনীয় আর কোনটি অপ্রয়োজনীয় তা ইসলামী সরকারের আইন পরিষদই ঠিক করবে।
ঙ. সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার : ইসলাম জনকল্যাণের জন্য সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার চায়। এ জনই ইসলাম পতিত জমি ফেলে রাখাকে সমর্থন করে না। যে কেউ তিন বছর পর্যন্ত জমি ফেলে রাখলে নবী সা: তা নিয়ে নিতে বলেছেন। পতিত সরকারি জমি আবাদ করার জন্য, হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ এক-দশমাংশ ফসল পাওয়ার বিনিময়ে হলেও চাষিদের কাছে বন্দোবস্ত দেয়ার জন্য গভর্নরদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে একই নীতি প্রযোজ্য বলে গণ্য করতে হবে।
চ. সম্পদের যথাযথ বণ্টন : ইসলাম সম্পদের যথাযথ বণ্টনের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। আল্লাহ পাকের নীতিনির্ধারণী ঘোষণা হচ্ছে : সম্পদ যেন তোমাদের ধনীদের মধ্যেই ঘোরাফেরা করতে না থাকে। (সূরা হাশর : আয়াত ৭)
এ আয়াতের আলোকে ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য হচ্ছে, আইন ও পলিসির মাধ্যমে সম্পদের সর্বাধিক বিস্তার ও বণ্টন নিশ্চিত করা এবং লক্ষ রাখা, যেন সম্পদের অতিরিক্ত পুঞ্জীভূত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি না হয়।
ছ. কল্যাণকর দ্রব্যের সর্বাধিক উৎপাদন : নবী সা:-এর দায়িত্ব হিসেবে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : তিনি তাদের জন্য পবিত্র দ্রব্য হালাল এবং অপবিত্র দ্রব্য হারাম করেন। (সূরা আরাফ : আয়াত ১৫৭)
এ আয়াতের আলোকে- ইসলামের উৎপাদন ব্যবস্থায় অপবিত্র দ্রব্যের কোনো স্থান নেই। অর্থাৎ, সেখানে কেবল স্বাস্থ্যকর ও পবিত্র দ্রব্যই থাকবে। তাই ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম লক্ষ্য, জনগণের স্বার্থে স্বাস্থ্যসম্মত পণ্য বা দ্রব্যের পর্যাপ্ত উৎপাদন নিশ্চিত করা এবং সব অকল্যাণকর দ্রব্যের উৎপাদন, আমদানি, রফতানি ও ব্যবসা নিষিদ্ধ করা।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার