১৯৯৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। কাক ডাকা ভোরের ঘটনা।
আম্মানের রাবিয়া এলাকায় অবস্থিত ইসরাইলি দূতাবাস থেকে দুটি হুন্ডাই সেলুন কার সাঁ করে বেরিয়ে গেল। গন্তব্য শুমায়সানি এলাকা। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের রাজনৈতি প্রধান খালিদ মিশালের সেখানে বসবাস। প্রথম গাড়ির লাইসেন্স প্লেট সবুজ রং-এর। জর্ডানে সাধারনত এ ধরনের প্লেট ভাড়া করা গাড়িতে দেখা যায়। গাড়িতে বসা ইসরাইলের কিডন ইউনিটের চারজন সক্রিয় সদস্য।
‘কিডন’ বেয়োনেটের হিব্রু পরিভাষা। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রমের দেখভাল করে থাকে কিডন ইউনিট সদস্যরাই। মূলত এরা ইসরাইলের চিহ্নিত শত্রুদের গোপনে হত্যার মিশন বাস্তবায়ন করে।
মোসাদের আজকের অভিযান মিশালের বাসা অভিমুখে। প্রথম গাড়ির চারজনের একজন ড্রাইভার, একজন নিরাপত্তাকর্মী আর দুজন হিটম্যান। দুই হিটম্যানের নাম জন কেনডাল (২৮) এবং ব্যারি বেডস (৩৬)। তাদের উপরই হত্যা মিশনের মুল দায়িত্ব অর্পিত ছিল। এই দুই আততায়ী ঘটনার মাত্র একদিন আগে কানাডার পাসপোর্ট নিয়ে জর্ডানে প্রবেশ করে।
দ্বিতীয় গাড়ির গায়ে কূটনৈতিক লাইসেন্স প্লেট লাগানো ছিল। সেই গাড়িতে ছিলো আরেকটি ব্যাকআপ দল; যারা প্রয়োজনে এগিয়ে আসবে। এই দলে একজন চিকিৎসকসহ মোসাদের চারজন সদস্য বসে ছিল। তারা মিশালের বাড়ির সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। সকাল ১০টার দিকে মিশাল তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটি গাড়িতে উঠলেন। গাড়িতে ছিল ড্রাইভার, মিশালের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী মুহাম্মাদ আবু সাইফ এবং তার তিন সন্তান। জর্ডানে তখন ছুটির মওসুম। বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ ছিল। কথা ছিল বাচ্চারা মিশালের সাথে তার অফিসে যাবে। অফিসটি ছিল ওয়াসফি আল তাল সড়কে শামিয়াহ নামক একটি ভবনে। মিশালকে অফিসে নামিয়ে বাচ্চাদের সেলুনে নিয়ে চুল কাটানো হবে।
কিডন সদস্যদের ভাড়া করা গাড়ি পুরোটা পথই মিশালকে অনুসরন করল। কূটনৈতিক প্লেট লাগানো গাড়ি নিকটস্থ মক্কা সড়কে অবস্থান নিল। মিশাল গাড়ি থেকে নেমে অফিস ভবনে প্রবেশ করল। আততায়ী কেনডাল এবং বেডস তার পেছনে ছুটে গেল। একজন আততায়ীর হাতে একটি ডিভাইস ছিল; হাত ব্যান্ডেজ করে নিয়েছিল বিধায় বাইরে থেকে তা বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু এই দুই আততায়ী খেয়াল করেনি মিশালের গাড়িতে তখনও দেহরক্ষী আবু সাইফ বসে ছিল। প্রথম আততায়ী পেছন থেকে এসে তার হাতের ডিভাইস খালিদ মিশালের বাম কানে লাগিয়ে দিলো। পরবর্তীতে এক সাক্ষাতকারে মিশাল জানিয়েছিলেন— যন্ত্রটি কানে লাগানোর সাথে সাথে তার মনে হয়েছিল তিনি প্রচন্ড জোরে বৈদ্যুতিক শক খেয়েছেন। যন্ত্রটি আসলে কী ধরনের ছিল— তা তখনো জানা যায়নি। তবে মিশাল সেই যাত্রায় বেঁচে যান। তার দেহরক্ষী নেমে সেই দুই ইসরাইলি আততায়ীকে ধাওয়া শুরু করে। মিশালের গাড়িচালক তড়িঘড়ি করে তাকে অফিসে নিয়ে যায়।
আবু সাইফ সেদিন প্রচণ্ড আঘাত পাওয়ার পরেও অনেকটা পথ দৌড়ে নিজের দক্ষতা এবং পথচারীদের সহযোগিতা নিয়ে সেই দুই আততায়ীকে ধরতে পেরেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তাকে সাহায্য করেছিলেন জর্ডানস্থ ফিলিস্তিনি লিবারেশন আর্মির কর্মকর্তা সাদ নাইম আল খতিব; যিনি ঘটনাচক্রে সেদিন আবু সাইফের তাড়া করার সময়ে ঐ সড়কে তাকে দেখতে পান এবং সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। ধস্তাধাস্তির এক পর্যায়ে আবু সাইফের মাথায় একজন আততায়ী ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করলে মাথা ফেটে প্রচণ্ড রক্তক্ষরনও হচ্ছিল।
এরই মধ্যে খালিদ মিশাল তার বাচ্চাদের ড্রাইভারের সাথে বাসায় পাঠিয়ে দেন। হামাস কার্যালয়ের অন্য একজন স্টাফকে বলেন তাকে জর্ডানস্থ হামাসের প্রতিনিধি মুহাম্মাদ নাজ্জালের বাসায় নামিয়ে দেওয়ার জন্য। অবশ্য ইতোমধ্যেই নাজ্জালকে খালিদ মিশালের উপর আক্রমনের বিষয়ে জানানো হয়েছে। নাজ্জাল তখন বাইরে ছিলেন। খবরটি পেয়েই তিনি দ্রুতগতিতে বাসায় ফিরে আসেন। নাজ্জাল একই সংগে তার বাসায় হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্যদের নিয়ে একটি জরুরি বৈঠক আহবান করেন এবং গোটা ঘটনাটি নিয়ে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই মোতাবেক তিনি এএফপির প্রতিনিধি রান্দা হাবিবের সাথে যোগাযোগ করেন। পরবর্তীতে রান্দা হাবিব গোটা ঘটনাটি জর্ডানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী সামির মুতাভিকে জানান। মুতাভি বলেন— এই আক্রমণ সম্পর্কে তিনি মোটেও অবগত নন। একই সংগে তিনি ঘটনার নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত করারও আশ্বাস দেন। কিন্তু কিছুক্ষন পরই মুতাভি আবার রান্দা হাবিবকে ফোন ব্যাক করে বলেন— এই ধরনের কোনো ঘটনাই আদতে ঘটেনি। কানাডার পাসপোর্টধারী ঐ দুই ব্যক্তি আসলে নিরীহ। তারা কেনাকাটা করছিল। খালিদ মিশালের সাথে তাদের বাদানুবাদ হয়েছিল। আর বাদানুবাদের মূল কারণ মিশালের দেহরক্ষী আবু সাইফ তাদেরকে হয়রানি করেছিল।’
তথ্যমন্ত্রী ঘটনাটি অস্বীকার করলেও এএফপি বেঁকে বসে। তারা পুরো ঘটনা খালিদ মিশালকে হত্যার প্রচেষ্টা মর্মে দেওয়া হামাসের প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে। এই বিজ্ঞপ্তি জর্ডান গোয়েন্দা সংস্থার তৎকালীন পরিচালক সামিহ আল বাত্তিখির নজরে আসে। তিনি সাথে সাথেই উত্তেজিত হয়ে পড়েন। হামাসের গোটা দাবিকেই তিনি অসত্য ও বানোয়াট বলে বিবেচিত করেন। বাত্তিখি তাৎক্ষনিকভাবেই হামাস নেতা মুসা আবু মারজুকের সাথে যোগাযোগ করেন এবং নাজ্জালের বিবৃতির প্রতিবাদ জানান। তিনি নাজ্জালকে মিথ্যাবাদী হিসেবেও আখ্যায়িত করে বলেন, তার সোর্সরা তাকে জানিয়েছে— কানাডার দুই পর্যটক আর খালিদ মিশালের দেহরক্ষীদের মধ্যে বাদানুবাদ ছাড়া সেখানে আর কিছুই হয়নি।
মুহাম্মাদ নাজ্জালের বাড়িতে হামাসের বৈঠকও তখন চলছিল। বৈঠকে খালিদ মিশাল সহকর্মীদের কাছে তার উপর আক্রমনের পুরো ঘটনা বর্ণনা করছিলেন। মিশাল জানান আততায়ীরা তার উপর পেছন দিক থেকে আক্রমন করেছে এবং তারা এই কাজে একটি অজানা যন্ত্রও ব্যবহার করেছে। যন্ত্রটি তাকে স্পর্শ করেনি, কিন্তু তার কানের ভেতরে বিকট একটি শব্দ বা অনুরণন সৃষ্টি করেছে। এর পরপরই তার মনে হয়েছে, তিনি বোধহয় মারাত্মক আকারের বৈদ্যুতিক শক খেয়েছেন। ঘটনার পর থেকেই তিনি বেশ অসুস্থ, ক্লান্ত এবং ঘুমঘুম ভাব অনুভব করছেন।
হঠাত করেই খালিদ মিশালের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করল। সহকর্মীরা দ্রুততার সাথে তাকে জর্ডানের ইসলামিক হাসপাতালে নিয়ে যায়। দুপুর ১টা ২০—এ তারা হাসপাতালে পৌঁছান। তিনি জ্ঞান হারালেন। হাসপাতালের প্রাথমিক পরীক্ষাতেই বুঝা গেল, মিশালের রক্তে অক্সিজেনের পরিমান আশংকাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। এদিকে হামাসের নেতা খালিদ মিশালের উপর হামলা হয়েছে— সেই খবর ততক্ষণে পুরো জর্ডানসহ সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। বড়ো বড়ো রাজনৈতিক দলের এবং ইখওয়ানের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ মিশালকে দেখতে হাসপাতালে চলে আসেন। জর্ডান ইখওয়ান নেতা এবং তৎকালীন জর্ডান পার্লামেন্টের সদস্য ড. আব্দুল্লাহ আল আকাইলাহ সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগও শুরু করে দেন। তার তৎপরতায় গোটা ঘটনাটি জর্ডানের বাদশাহ হোসেনকে জানানো হয়।
হাসপাতালে যখন এই পরিস্থিতি, তখন পুলিশের কাস্টডিতে থাকা দুই আততায়ীর অবস্থা একেবারেই অন্যরকম। কানাডীয় পাসপোর্টধারী আটক দুই ব্যক্তি জানান— তারা সাধারনভাবেই পর্যটক হিসেবে ঘুরাফেরা করছিলেন। আবু সাইফ কোনো উস্কানি ছাড়াই তাদের উপরে চড়াও হয়েছে। পুলিশের দায়িত্বরত কর্মকর্তা তাদের বক্তব্য রেকর্ড করে জর্ডানস্থ কানাডা দূতাবাসে ফোন দেন এবং দুই কানাডীয় পাসর্পোটধারী আটকের বিষয়টি তাদেরকে অবহিত করেন। তারা কানাডা দূতাবাসের কর্মকর্তাদের দ্রুত জর্ডান পুলিশের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। কিছুক্ষন পরই দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা পুলিশ স্টেশনে হাজির। কিন্তু সেই কূটনৈতিক কর্মকর্তা ও পুলিশেরা সবাই পরবর্তী ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে যান। আটক দুই ব্যক্তি প্রচণ্ড ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ শুরু করে। তারা পুলিশ বা দূতাবাসকে কোনো সহযোগিতা করতে কিংবা নিতে অস্বীকার করেন।
আদতে জর্ডানস্থ মোসাদের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এই আক্রমন প্রচেষ্টা সম্পর্কে জানতেন। তিনি মূলত গোটা আক্রমনের পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া তত্বাবধান করছিলেন। যখনই এই দুই আততায়ী ধরা পড়ে যায়, তখন পেছনের গাড়িতে থাকা ব্যাকআপ টিম সাথে সাথেই স্পট থেকে সরে যায় এবং সরাসরি ইসরাইলি দূতাবাসে গিয়ে মোসাদের সেই কর্মকর্তাকে হত্যা মিশন সম্পর্কে জানায়। মিশনের ব্যর্থতা এবং দুই গোয়েন্দার ধরা পড়ে যাওয়ার তথ্য ব্যাকআপ টিমের মাধ্যমেই মোসাদের ওই কর্মকর্তা জানতে পারেন। তিনি জর্ডানের তথ্যমন্ত্রী সামিহ আল বাত্তিখিকে তাৎক্ষনিক সরাসরি ফোন দিয়ে বলেন—আটককৃত দুই ব্যক্তি মোসাদের এজেন্ট এবং তাদেরকে যেন কোনো হয়রানি না করা হয়। তিনি আরও জানান, ইসরাইলি সরকার খুব সহসাই বাদশাহ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করবে।
হামাস নেতা খালিদ মিশালের উপর আক্রমনের ঘটনা বাদশাহ হোসেনের কানে এসে পৌছায়। সাথে সাথেই তিনি পুরো বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব নেন। এরই মধ্যে আটক দুই মোসাদ সদস্য স্বীকার করে— তারা খালিদ মিশালকে হত্যা করার জন্যই এসেছিল এবং ইতোমধ্যে তারা মিশালের উপর এক ধরনের বিষ প্রয়োগ করেছে। বাদশাহ হোসেন সাথে সাথেই খালিদ মিশালকে ইসলাম হাসপাতাল থেকে আল হোসেন মেডিকেল সেন্টারে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। সেখানে একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক খালিদ মিশালকে পরীক্ষা করেন এবং অবস্থার উন্নয়ন কীভাবে করা যায়— সেটা নিয়ে পর্যালোচনা করেন। শুধু তাই নয়, বাদশাহ হোসেন সেই সময়গুলোতে নিজের ক্যান্সার চিকিৎসা করাচ্ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মায়ো ক্লিনিকে। তিনি মিশালের চিকিৎসার জন্য সেই মায়ো ক্লিনিক থেকেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়ে আসেন। শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও জর্ডানের ভূখণ্ডে ইসরাইল যেভাবে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে, সে প্রসঙ্গে তিনি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে সরাসরি ফোন দিয়ে অবহিত করেন। তিনি বিল ক্লিনটনকে বলেন—
‘আপনি ইসরাইলের উপর চাপ দিন যাতে তারা জানায় যে, খালিদ মিশালের উপর তারা কোন ধরনের বিষ প্রয়োগ করেছে। আর তাদের কাছে এর প্রতিষেধক থাকলে, তা দেওয়ার জন্য আপনি ইসরাইলকে অনুরোধ করুন।’
মিশালকে হত্যার প্রয়াস সম্পর্কে জর্ডানের বাদশাহ হোসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে ফোনে বিস্তারিতই খুলে বলেন। ক্লিনটন শুনে অবাক হয়ে যান। বিশেষ করে জর্ডানে এমন হামলা হতে পারে, তা তিনি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। হোসেনের সাথে কথা বলার শেষ দিকে ক্লিনটন ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে ওঠেন—
That man is impossible। এখানে ‘ইমপসিবল’ শব্দটির অর্থ ‘অসম্ভব’ নয়, বরং ‘অসহনীয়’। এটা বলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুঝাতে চাইলেন, উগ্রপন্থী ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর এসব কাজ আর সহ্য করা যায় না। তিনি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।’
যদিও মোসাদের আততায়ীরা খালিদ মিশালের এতটাই কাছাকাছি যেতে পেরেছিল যে চাইলেই তারা তাকে গুলি করে হত্যা করতে পারত। কিন্তু তারা বুঝে শুনেই সেই পথে যায়নি। তারা চেয়েছিল হামাসের এই নেতাকে ধীরেধীরে সন্তোপর্ণে এবং আন্তর্জাতিকভাবে কোনো শোরগোলের সৃষ্টি না করে নীরবে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে। খালিদ মিশালের উপর যেই বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল, তাতে তার এমনিই ধীরেধীরে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে রহস্যজনকভাবে মৃত্যুবরণ করার কথা। মোসাদের এই হত্যা প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল হামাসকে একটি সতর্কতামূলক বার্তা পৌছে দেওয়া। সে বার্তা হলো—
তারা যেখানে যে অবস্থানেই থাকুক না কেন ইসরাইল চাইলে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে পারবে।
সরাসরি হত্যা না করায় ইসরাইল ধারণা করেছিল যে, তারা একটু সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পারবে। তাদের ঘাড়ে সরাসরি কেউ দায় দিতে পারবে না। আর দিলেও তারা বলিষ্ঠতার সাথে তা অস্বীকার করতে পারবে। তবে তারা যা ভেবেছিল, তা হয়নি।
খেলা উল্টে গেল। আন্তর্জাতিকভাবে ইসরাইল খুবই বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়ে গেল। তারা এখন সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে লাগ জর্ডানের সাথে সম্পর্ক অবনতির হাত থেকে ইসরাইলকে যতদূর সম্ভব রক্ষা করা এবং একই সঙ্গে তার দুই গোয়েন্দা এজেন্টকেও নিরাপদে জর্ডানের কাস্টডি থেকে মুক্ত করে নিরাপদে ফিরিয়ে নেওয়া। এই দুই আততায়ী যদি বেশি সময় আটক থাকে, তাহলে হয়তো তারা জিজ্ঞাসাবাদে এই অপারেশনের পেছনে জর্ডানের স্থানীয় সহযোগীদের নামও ফাঁস করে দিতে পারে।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জর্ডানের বাদশাহ হোসেনের আহবানে সাড়া দিলো। তারা ইসরাইলের উপর চাপ সৃষ্টি করল— যেন তারা খালিদ মিশালের উপর প্রয়োগকৃত বিষের প্রতিষেধক প্রেরণ করে। প্রতিষেধক ছাড়া মিশালকে বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। বিষের প্রতিক্রিয়া এতটাই মারাত্মক যে আক্রান্ত মানুষটি ঘুমিয়ে পড়লে কিংবা জ্ঞান হারিয়ে ফেললেই ফুসফুস অকার্যকর হয়ে পড়বে এবং মেকানিক্যাল ভেন্টিলেটর ব্যবহার করা ছাড়া তিনি আর শ্বাস নিতে পারবেন না।
৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭। খালিদ মিশালের হত্যা প্রচেষ্টার ৫ দিন অতিবাহিত হয়েছে। বাদশাহ হোসেন জর্ডানের জারকা এলাকায় এক জনসমাবেশে ভাষণ দেন। তিনি তার ভাষণে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুকে কার্যকর কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার স্পষ্ট আহবান জানান। খালিদ মিশালের চিকিৎসায় ইসরাইল সহায়তা না করলে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাবে। তিনি পারষ্পরিক ভরসা ও বিশ্বাস প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবিলম্বে শেখ আহমেদ ইয়াসিন এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তি দাবি করেন। অন্যথায় ইসরাইলকে চরম মূল্য দিতে হবে বলে দৃঢ় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই ইসরাইল তাদের মিত্র আমেরিকার সাথে যোগাযোগ শুরু করে। শুরু হয় দেন-দরবার। টানটান উত্তেজনা। বাদশাহ হোসেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের কাছে ফোনে কয়েকটি দাবি জানালেন। মিশালকে যে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে, ইসরাইলকে তার প্রতিকারের ঔষধ পাঠাতে হবে এবং প্রয়োগকৃত বিষের রাসায়নিক তথ্য জর্ডানের ডাক্তারদের জানাতে হবে বলে বাদশাহ হোসেন দাবি তুললেন। হোসেন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন,
‘হামাস নেতা মিশাল যদি মারা যান, তাহলে জর্ডান ও ইসরাইলের মধ্যে যে শান্তিচুক্তি রয়েছে, সেটারও মৃত্যু ঘটবে।’
জর্ডানের ততকালীন বাদশাহ হোসেন
জর্ডানি বাদশাহ হোসেন এতদিন ঘোর ‘পাশ্চাত্যপন্থী’ হিসেবে সমালোচিত হতেন। এমনকি ১৯৭০ সালে জর্ডানে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সাথে সম্পর্কের অবনতি হলে জর্ডান সেনাবাহিনীর প্রচন্ড হামলায় বহু ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিল। তখন ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা (পিএলও) তল্পিতল্পা গুটিয়ে জর্ডান ছাড়তে বাধ্যও হয়েছিল। যে বাদশাহর আমলে এত কিছু ঘটেছিল, সেই বাদশাহ হোসেনই আবার ফিলিস্তিনি নেতা মিশালের প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রে ভীষণ বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তিনি নিরাপত্তা বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন আম্মানে ইসরাইলি দূতাবাস ঘেরাও করতে। কারণ, মোসাদের কিলিং মিশনের খুনিরা সেখানে লুকিয়ে আছে বলে মনে করা হয়েছিল।
এ দিকে খালিদ মিশাল তখন আম্মানের হোসেন মেডিক্যাল সিটি হসপিটালে মৃত্যুর সাথে লড়ছেন। ডাক্তাররা বুঝতে পারছিলেন না তাকে হত্যা করতে ঠিক কী ধরনের বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বিশেষজ্ঞরা এই উপসংহারে উপনীত হন যে, মরফিন ও আফিমজাতীয় বিপুল পরিমাণ বিষ ব্যবহার করেছে ইহুদি ঘাতকচক্র। এটা চেতনা নাশ করে দেয় এবং মন্থর গতিতে প্রাণহানি ঘটায়। শ্বাসতন্ত্র বিকল হয়ে আক্রান্ত ব্যক্তি ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।
আম্মান সামরিক হসপিটালে ডিপ কোমায় মৃত্যুর মুখোমুখি খালিদ মিশাল
বাদশাহ হোসেনের মতো ‘মিত্রে’র আকস্মিক ক্রুদ্ধ মনোভাব ও কঠোর পদক্ষেপের কারণে আমেরিকাও ভড়কে যায়। জর্ডান আর আমেরিকার তীব্র অসন্তোষ একসাথে যুক্ত হয়ে স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়। ইসরাইল পড়ে যায় তাদের ইতিহাসের অন্যতম বেকায়দায়। মিশাল মারা গেলে ইসরাইলের লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হতে পারে ভেবে তড়িঘড়ি করে খোদ মোসাদ প্রধান ড্যানি ইয়াতোম আম্মানে ছুটে যান। তিনি বাদশাহ হোসেনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ক্ষুব্ধ হোসেন তাকে ধমক দিয়ে বেশ কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন। এরই ফাঁকে ইহুদিদের দুনিয়ায় এক চরম অপমানকর ঘটনা ঘটে গেল। যে দুধর্ষ মোসাদ বাহিনীর সদস্যরা অপারেশন চালিয়ে খালিদ মিশালকে বিষ প্রয়োগ করেছিল, সেই মোসাদের প্রধান ড্যানি ইয়াটমকে লেজ গুটিয়ে মিশালকে বাঁচানোর ওষুধ নিয়ে আম্মানে ছুটে যেতে হয়েছিল। ইসরাইলিরা আজও এই পরাজয়ের গ্লানি বয়ে চলে। আজও তারা সেই ঘটনা ভুলতে পারে না। মোসাদের দেওয়া বিষের অ্যান্টিডোট পেয়ে খালিদ মিশাল কোমা অবস্থা থেকে ধীরেধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেন। দীর্ঘ কয়েক মাস চিকিৎসার পরে তিনি পূর্ণ সুস্থ হয়ে আবার হামাসের দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
ড্যানি ইয়াটমঃ তৎকালীন মোসাদ প্রধান
৫ অক্টোবর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকার একটি প্রেস রিলিজ ইস্যু করে— যেখানে তারা প্রথমবারের মত জর্ডানের আম্মানে হামাস নেতা খালিদ মিশালকে হত্যা প্রচেষ্টার বিষয়টি সরাসরি স্বীকার করে নেয়। ইসরাইল এই হত্যা প্রচেষ্টার পুরো দায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করার পর জর্ডান কর্তৃপক্ষ তাদের দেশে আটক হওয়া মোসাদের ঐ দুই এজেন্টকে ছেড়ে দেয়। এই ব্যাপারে একটি প্রেস রিলিজে জর্ডান সরকার জানায়,
ইসরাইলের সাথে চুক্তির অংশ হিসেবে সেদিন ইসরাইলের বিভিন্ন কারাগার থেকে জর্ডান ও ফিলিস্তিনের ৪০ জন বন্দিকেও মুক্তি দেওয়া হয়। কয়েকজন হামাস নেতা অবশ্য মনে করেছিলেন যে জর্ডান ইসরাইলের সাথে আরও ভালো চুক্তি করতে পারত; বিশেষত শ খানেক হামাস নেতাকর্মীকে এই সুযোগে মুক্ত করা সম্ভব হতো যদি জর্ডান আরেকটু তৎপর হতো। বাদশাহ হোসেন ইসরাইলকে কাবু করার একটা মওকা পেয়েছিলেন; আরও দরকষাকষি করার সুযোগ ছিল। কেউ কেউ আবার মনে করেছিলেন যে মোসাদের দুই এজেন্টকে বিচার না করে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হয়নি। তবে অধিকাংশই মনে করেন, যে পরিমান সাহস, বুদ্ধিমত্তা এবং কৌশলের মাধ্যমে বাদশাহ হোসেন এই কাজটি সুসম্পন্ন করেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
খালেদ মিশালকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল অভিযানের পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মিশাল। মোসাদের এই অভিযান সফলতার দ্বারপ্রান্তে গিয়েও ব্যর্থ হয়। ব্যর্থ অভিযানের কারণ খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি কমিটি করে দেয় ইসরায়েল সরকার। তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। সমস্ত দায় গিয়ে পড়ে মোসাদ প্রধানের উপর। এ নিয়ে বিতর্কের মুখে এর সপ্তাহ খানেক বাদেই ড্যানি ইয়াটমের পদত্যাগ করেন। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হয় এই ঘটনাকে। মোসাদের যে কয়জন গুপ্তচর খালেদ মেশাল হত্যাচেষ্টায় অংশ নিয়েছিলেন, তাদেরই একজন মিশকা বেন ডেভিড। তিনি বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন,
“মোসাদের সিদ্ধান্ত, অভিযানের কৌশল, পরিচালনা পদ্ধতি, সবকিছুই সঠিক থাকলেও কোনো কিছুই সফল হয়নি”।
খালিদ মিশালকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার এই ইসরাইলি ঘৃণ্য অপারেশন নিয়ে আল জাজিরা ‘Kill Him Silently’ নামে একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে।
পৃথিবীর অন্যতম কৌশলী গোয়েন্দা সংস্থার এই পরাজয়ের থ্রিলার গল্প আজও মুসলিম তরুণদের প্রেরণা যোগায়। দৃঢ় ঈমান, অটুট সাহস আর প্রজ্ঞা থাকলে সেরা যোদ্ধাকেও যুদ্ধে হারানো সম্ভব— সেই রোমাঞ্চকর ঘটনা আমাদের এ কথাই স্বরণ করে দেয়।
কৃতজ্ঞতা : চিন্তাধারা