ইসলামী আন্দোলনের মুল বিষয় হলো, মানুষ আল্লাহর জমিনে আল্লাহর খলিফা। আল্লাহর খলিফা হিসেবে তার দায়িত্ব দুনিয়াতে আল্লাহর মর্জি মতো চলা। সমস্ত নবী রাসূল এসেছেন এই দায়িত্ব পালনের শিক্ষা দেয়ার জন্য। এই দায়িত্বেরই অংশ হচ্ছে ইসলামী আন্দোলন। আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা থেকে যদি আমরা বুঝার চেষ্টা করি তাহলে দেখা যাবে, ইসলামী আন্দোলন জাগতিক সাফল্যকে উপেক্ষা করেনি। কিন্তু মূখ্য বিষয় বানিয়েছে আখেরাতের সাফল্য। সূরা সফের ওই আয়াত তো সবারই মুখে মুখে
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَىٰ تِجَارَةٍ تُنجِيكُم مِّنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ
হে ঈমানদারগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি ব্যবসার সন্ধান দেবো যা তোমাদেরকে কঠিন আযাব থেকে মুক্তি দেবে? – সূরা সফ : ১০
প্রশ্নটাই এসেছে আজাবে আলিম থেকে নাজাতের উপায় কী। এই উপায় বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনা এবং আল্লাহর পথে মাল দিয়ে, জান দিয়ে সংগ্রাম করা। এখন তো এদেশের মাটিতে ‘জিহাদ’ শব্দ উচ্চারণ করতে আমার ভয় লাগে। জিহাদকে বানায় ফেলা হয়েছে সন্ত্রাসের বিকল্প শব্দ।
‘জিহাদ’ একটা সার্বিক প্রচেষ্টার নাম যার সূচনা হয় দাওয়াতের মাধ্যমে। দাওয়াতী কাজ ও জিহাদের মধ্যে পার্থক্য নেই। দাওয়াতটা itself Jihad, beginning of Jihad. এর পরিসমাপ্তি বিভিন্ন রকমের। সেটা অন্য আলোচনা। আমার বলার বিষয় হচ্ছে, ইসলামী আন্দোলনের মূখ্য চাওয়া পাওয়া হলো আখেরাতে নাজাত ও মুক্তি। আল্লাহর পথে মাল দিয়ে, জান দিয়ে জিহাদ করার কথা বলার পরে এর ফল সম্পর্কে বলা হয়েছে, তোমাদের গুনাহ মাফ করা হবে। তারপর তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে এবং এটাই সর্বোত্তম পুরস্কার।
দুনিয়ার সাফল্য আল্লাহ উপেক্ষা করেননি। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এখানে যে ভাষা ও বাচনভঙ্গি ব্যবহার করেছেন এটা গভীরভাবে তলিয়ে দেখার দাবি রাখে। বলা হচ্ছে ‘উখরা’ মানে ‘আরেকটা আছে’। প্রধানটা হলো নাজাত, মাগফিরাত ও জান্নাত। জাগতিক সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে বলা হচ্ছে উখরা। আরো এসেছে, ‘তুহিব্বুনাহা’ তোমরা যেটা পছন্দ করো। সেটা কী? নাসরুম মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন ক্বারীব অবাশ্বিরুল মু’মিনিন। আল্লাহর পক্ষ থেকে নিকটতম বিজয়। এটা মানুষের কাছে বেশি পছন্দের।
এখন আমরা বাস্তব অভিজ্ঞতায় যেটা দেখি, আন্দোলনের সাফল্য একটু দূরে মনে হলে হতাশা আসে, প্রশ্ন জাগে ঠিক পথে চলছি কিনা, আন্দোলন ঠিক আছে কিনা। এটা হলে, ওটা হলে তাড়াতাড়ি বিজয় আসতো। মাওলানা মওদূদী রহমতুল্লাহ আলাইহি সাফল্যের শর্তাবলি বইতে (মূলত এটা একটা বক্তৃতা) সবরের আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, সাফল্য বিলম্বিত হওয়ায় অস্থির হওয়াটাও সবরের পরিপন্থি। সারা দুনিয়ায় ইসলামী আন্দোলনকারীদের মধ্যে এই হতাশা দেখা যায় যে, এখনো ইসলামী আন্দোলন তো বিজয় অর্জন করতে পারেনি। জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে কথা ওঠে, সেই ১৯৪১ সালে জামায়াতের জন্ম! এতো বছর হয়ে গেলো! কী হবে আর?
এখানে দৃষ্টিভঙ্গি যদি পরিস্কার থাকে তাহলে হতাশা নিরাশা আমাদেরকে স্পর্শ করার কথা না। নূহ (আ) তো নবী ছিলেন। সাড়ে নয়শো বছর দাওয়াত দিয়েছেন। সেখানে ইসলাম কায়েম হয়নি। তিনি আফসোস করে বলছেন, আমি প্রকাশ্যে দাওয়াত দিলাম, গোপনে দাওয়াত দিলাম, একা একা দাওয়াত দিলাম, দলবেধে দাওয়াত দিলাম অথচ এরা শুধু ভাগতেই থাকলো। এরপরে কওমের জন্য বদদোয়া করে ফেললেন, দুনিয়ায় কাফেরদের জন্য একটা ঘরও রেখো না। আমরা কি বলতে পারি নূহ আ. নবী হিসেবে ব্যর্থ হয়েছিলেন?
সাফল্যের ব্যাপারে পরিস্কার কথা, যদি ইসলাম কায়েম হয়েও যায় আর আমার মধ্যে ইখলাসের অভাব থাকে তাহলে ব্যক্তি হিসেবে আমি ব্যার্থ। আর আমার মধ্যে যদি ইখলাসের ব্যাপারে কোনো ত্রুটি না থাকে, আল্লাহর দেয়া সামর্থ আল্লাহর পথে পুরোপুরি ব্যয় করে থাকি তারপরও যদি ইসলাম বিজয়ী না হয় তাহলে আমি কামিয়াব। সফলতা ব্যর্থতা সম্পর্কে এই ধারণাটা মজবুত ও সঠিক না থাকার কারণে একটু বিপদ দেখলে, একটু বিলম্ব দেখলে হতাশা আসে। এটা ইসলামী আন্দোলনের স্পিরিটের পরিপন্থি। দুনিয়ার সর্বত্র ইসলামী আন্দোলনের ব্যাপারে এমন ঘটছে। উপমহাদেশে যেখানে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেখানেও এটা আছে।
(শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর একটি বক্তব্য থেকে সংগৃহীত)