বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি কালো অধ্যায়ের সংযোগ করলো অবৈধ আওয়ামী জালিম সরকার। ২২ নভেম্বর ২০১৫ দিনটি কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই দিন দু’জন দেশপ্রেমিক নাগরিককে হত্যা করা হলো। পৃথিবীতে আজ অসংখ্য জায়গায় আইনের দোহাই দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এখন বাংলাদেশ সেই ভয়ঙ্কর সময়টি অতিক্রম করছে। দার্শনিক সক্রেটিসকে হ্যামলক বিষ প্রয়োগে হত্যার রায় দিয়েছিল আদালতেই। জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয় আদালতের নির্দেশেই। হাজার বছর পর এসে প্রমাণিত হয়েছে আদালতের দু’টি রায়ই ভুল রায় ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে হয়ত একদিন এই হত্যাকান্ডের ক্ষেত্রেও তাই প্রমাণিত হবে। অধ্যাপক ম্যাকলোয়েন চার্লস বলেছেন, ‘আমার মতে ইতিহাসের কোন যুগেই কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এত কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়নি, প্রশাসনের সামনে বিচার বিভাগ কখনো এতটা অসহায়ত্ব বোধ করেনি।’ বেকন বলেছিল, ‘আইনের মাধ্যমে অত্যাচার করার চেয়ে বড় অত্যাচার আর নেই।’
সেই অত্যাচারের শিকার হয়েছেন জনাব আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদও।
পৃথিবীর সকল নীতি-নৈতিকতা, মানবাধিকারকে উপেক্ষা করে যাকে হত্যা করা হয়েছে তিনি- একজন রাজনীতিবিদ, প্রতিথযশা শিক্ষাবিদ, লেখক, ইসলামী ব্যক্তিত্ব, সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় নেতা। বিশ্বের কোটি-কোটি মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা আর চোখের অশ্রু সিক্ত হয়ে আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন। বাংলার মানুষের কাছে শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ একটি বিপ্লবী নাম, একটি আন্দোলন, একটি ইতিহাস, একটি আপসহীন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি হিসেবে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এ জাতি শ্রদ্ধার সাথে ইসলামী আন্দোলনের এই সিপাহসালারকে হৃদয়ের আবেগ আর ভালোবাসায় সিক্ত করবে শতাব্দী থেকে শতাব্দীকাল। এই ভূখন্ডে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম, প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে শহীদ মুজাহিদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। শহীদ মুজাহিদ ছিলেন আধিপত্যবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদী চেতনার বিপরীতে একটি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। ট্রাইব্যুনালের রায় শুনে তিনি বলেছিলেন, “সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে, যে শাস্তির ব্যবস্থা করেছে তার জন্য আমি মোটেই বিচলিত নই। আমি আল্লাহর দ্বীনের উদ্দেশ্যে আমার জীবন কোরবান করার জন্য সব সময় প্রস্তুত আছি।” তাঁর এই সাহসী উচ্চারণ থেকে তরুণ প্রজন্ম, এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেতনা খুঁজে পাবে।
বাংলার জমিনে নাস্তিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীর রক্তচক্ষু মোকাবেলা করে তৃণমূল থেকে গড়ে উঠে আসা একজন সংগ্রামী প্রাণপুরুষ। নীতির প্রশ্নে সদা আপসহীন এই মানুষটিকে কেবলমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধেই আজ হত্যা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তাদের অপরাধ, তারা মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে।” আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, “আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদেরকে মৃত মনে করো না, প্রকৃতপক্ষে তারা জীবন্ত, কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা অনুভব করতে পারো না” (২ : ১৫৪) প্রিয় রাসূল সা: বলেছেন, ‘‘শাহাদাত লাভকারী ব্যক্তি নিহত হবার কষ্ট অনুভব করে না। তবে তোমাদের কেউ পিঁপড়ার কামড়ে যতটুকু কষ্ট অনুভব করো, কেবল ততটুকুই অনুভব করে মাত্র।” (তিরমিজি)
এই ক্ষণজন্মা মহান ব্যক্তিত্বের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি। তাঁর পিতা প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আব্দুল আলীর কাছে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের মধ্য দিয়ে শিক্ষার হাতেখড়ি। শহীদ মুজাহিদের পিতা মাওলানা আব্দুল আলী একজন ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে আজও ফরিদপুরসহ গোটা অঞ্চলের মানুষের নিকট শ্রদ্ধার পাত্র। ১৯৬২-১৯৬৪ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যও (এমপিএ) নির্বাচিত হয়েছিলেন। শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ফরিদপুর ময়জুদ্দিন স্কুল শিক্ষাজীবন শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সর্বশেষ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।
ছাত্রজীবনে এই মেধাবী চৌকস সচেতন মানুষটি ছাত্রসমাজের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে শীর্ষে থেকে ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক সভাপতি নির্বাচিত হন। কর্মজীবনেও রেখেছেন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। পরবর্তীতে ঢাকা মহানগরীর আমীর, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও লিয়াজোঁ কমিটির প্রধান, শাহাদাতের পূর্ব পর্যন্ত সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠাসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তিনি কার্যকর ভূমিকা পালন করেছেন। শহীদ মুজাহিদ সমাজকল্যাণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করাকালীন সময়ে তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে জেল, জুলুম এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এক-এগারো সরকার তথাকথিত দুর্নীতির মিথ্যা মামলা দিয়েও তাঁদের বিরুদ্ধে কোন দুর্নীতি আবিষ্কার করতে পারেনি।
শহীদ মুজাহিদ ছিলেন ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অনুপম কারিগর। মন্ত্রী হয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে কায়েম করেছেন সততা, ইনসাফ, সত্যবাদিতার উজ্জ্বল উদাহরণ। আত্মত্যাগ, আন্তরিকতা, নিষ্ঠার মাধ্যমে দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখেছেন প্রতিটি ক্ষেত্রে। জনগণের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছেন একটি সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন। তাঁদের ঐতিহাসিক ভূমিকা দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তাই ষড়যন্ত্র আর কূটকৌশলের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে রাষ্ট্রীয় আয়োজনে হত্যা করার ঘৃণ্য চক্রান্ত।
শহীদ মুজাহিদকে হত্যা করে আওয়ামী লীগ নতুন করে আবার হিংসা-বিদ্বেষের বীজ বপন করলো, যা দেশের ঐক্য ও সংহতির জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়। বি. সি. রায় বলেছেন, ‘ক্ষমতা সবচেয়ে বড় মদের নেশার মতো। যাকে একবার পেয়ে বসে তাকে জীবনে শেষ করে দেয়।’ আওয়ামী লীগ আজ অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকার নেশায় মত্ত হয়ে শহীদ মুজাহিদকে হত্যা করেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের বিবেককে যদি প্রশ্ন করেন, আপনি কি জামায়াত নেতাদেরকে মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে হত্যা করেছেন? আমার মনে হয় উত্তর হবে, না! কারণ এখন জামায়াত আপনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বলেই এই হত্যাকান্ড। এক সময় শহীদ মুজাহিদ সাহেব আপনার রাজনৈতিক মিত্র ছিলেন। রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন একত্রে। একান্ত নিভৃতে ডেকে রাজনৈতিক শলা-পরামর্শও করেছেন জামায়াত নেতাদের সাথে, তাই নয় কি? আওয়ামী লীগ ঘরে-ঘরে হিংসা বিদ্বেষের বিষবাম্প ছড়াচ্ছে। এ খেলা একদিন হয়তো জাতির ললাটে পরাধীনতার কবজ ঝুলিয়ে দেবে।
শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ভাইয়ের অসংখ্য কর্মই এখন স্মৃতি। অনেকের মতো আমিও অত্যন্ত কাছ থেকে এই প্রিয় মানুষটিকে দেখেছি। মুজাহিদ ভাই ছিলেন নীতির প্রশ্নে আপসহীন। কিন্তু তিনি ছিলেন যেমন কঠোর তেমনি উনার হৃদয়টা ছিলো অনেক নরম প্রকৃতির। আমি তাঁর চরিত্রের মধ্যে হজরত ওমর ফারুক রা:-এর চরিত্রের ছাপ দেখতে পেয়েছি। বিশেষ করে দেশের সমস্ত ক্যাম্পাসে যখন ইসলামী ছাত্রশিবির ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের শিকার, নেতাকর্মীদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতনের বর্ণনা শুনার পর অনেক দিন তাঁর চোখে আমি পানি দেখেছি! তিনি ছাত্রশিবিরকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন। তিনি সব সময় ছাত্রশিবিরকে সৎ জীবন যাপন ও ধৈর্যের পরামর্শ দিতেন এবং বলতেন, “তোমরা কোন বাড়াবাড়ি করো না, তাহলে আল্লাহর সাহায্য পাবে।”
মুজাহিদ ভাই আত্মপর্যালোচনার ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন। ক্যাম্পাসের কোন ঘটনা শুনলেই তিনি বলতেন, “তোমাদের কোন ভুল, কোন বাড়াবাড়ি ছিল কি না তা আগে খতিয়ে দেখ।” সময়ানুবর্তিতায় তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। মুজাহিদ ভাইয়ের সাথে কোন মিটিং থাকলে তিনিই আগে উপস্থিত হতেন। তিনি যে মিটিংয়ে মেহমান থাকতেন সেখানেও তিনি দেরিতে উপস্থিত হয়েছেন বলে আমার জানা নেই।
ব্যক্তিজীবনে অল্পে তুষ্ট, নির্লোভ, পরোপকারী, দৃঢ়চেতা, ছিলেন শহীদ মুজাহিদ। জীবন-যাপন করতেন অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে। অনেক সময় জামায়াতের কেন্দ্রীয় অফিসে গিয়ে দেখতাম, ফ্লোরে মাদুর ফেলে তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। পোশাক আশাকেও তিনি অত্যন্ত সিম্পল। অনেক সময় দেখেছি তার গায়ের ফতুয়া ছেঁড়া। আমরা তাকালে হাসতেন আর বলতেন অল্পে তুষ্ট জীবন লালন করতে শিখ। তাহলে জীবনে টেনশন ফ্রি থেকে হালাল পথে থাকতে সহজ হবে। কত মানুষ আছে যাদের একটা জামাও নেই। একবেলা খেতে পায় না। তাদের কথা আমাদের ভাবতে হবে। দেশের মানুষের মুক্তির জন্য সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন তিনি।
একদিন মুজাহিদ ভাই আমাকে বললেন, তোমরা কি ফুটপাথ থেকে অল্প দামে জামা কিন? আমি বললাম মুজাহিদ ভাই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কিনেছি, এখন অবশ্য কেনা হয় না। তিনি বললেন, অল্প দামে জামা-কাপড় কিনবা তাহলে সাধারণ মানুষের জীবনকে উপলব্ধি করতে পারবা। আর বাকি টাকা দিয়ে যার প্রয়োজন তাকে সহযোগিতা করতে পারবা। শহীদ মুজাহিদ ব্যক্তিজীবনে তিলে তিলে নিজের জীবনকে গড়ে তুলেছেন। কৃচ্ছ্রতা সাধন করে রাষ্ট্রীয় খরচের ক্ষেত্রেও অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দুই মন্ত্রী দলীয় কাজে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করতেন খুব কমই। সরকারি সফরে গিয়ে দলীয় লোক নিয়ে বিরাট খরচের বোঝা না বাড়িয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে খেতেন জামায়াত অফিসে। বাঁচিয়ে দিতেন সরকারি টাকা। তাদের সাথে দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিরা আজও তাঁদের এ সততার সাক্ষী। আবার দলীয় কাজে সফরে গিয়ে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিতেন না তারা। তাঁর স্ত্রী বলেছেন, স্ত্রী হিসেবে আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমার স্বামী ঘরে বাইরে, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে আল্লাহর রহমতে অত্যন্ত স্বচ্ছ ও সৎ জীবন যাপন করেছেন।
২০০৯ সালে আমি ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি থাকাকালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করি। সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় ৬৮ রাষ্ট্রের ছাত্রযুব প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনের অতিথি হিসেবে আধুনিক তার্কির রূপকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিম উদ্দিন এরবাকান এসেছিলেন। নাজিম উদ্দিন এরবাকানকে ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে ক্রেস্ট প্রদান করার সময় তিনি ধন্যবাদ জানিয়ে উচ্ছ্বাসের সাথে বললেন, ইয়েস ইউর লিডার মি. নিজামী, মি. মুজাহিদ! তখন নিজেকে অনেক ধন্য মনে করলাম। বুঝতে আর বাকি নেই নাজিম উদ্দিন এরবাকান সত্যই হৃদয় দিয়ে বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে ভালোবাসেন। এভাবে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে আমাদের নেতৃবৃন্দ দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছিয়েছেন। আজ আওয়ামী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কালো কাপড় দিয়ে সব অর্জনকে ঢাকতে চায়। এটা কি সম্ভব?
যে আইন দিয়ে জামায়াত নেতাদের হত্যা করছে, সেই আইন পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত, সমালোচিত, বিতর্কিত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কালো আইন হিসেবে খ্যাত। আন্তর্জাতিক বার অ্যাসোসিয়েশন, মানবাধিকার সংগঠন, সংস্থা এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার রিপোর্টে যে আশঙ্কা করা হয়েছে যে, “সরকার তার পরিচিত প্রতিপক্ষ এবং রাজনৈতিক শত্রুদেরকে দমন করতেই এ বিচারকে ব্যবহার করছে।” জামায়াত নেতাদের হত্যার মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ভলতেয়ার বলতেন, ‘অস্ত্রের জোরে তুমি সারা পৃথিবী জয় করতে পার, কিন্তু পারবে না একটা গ্রামের মানুষেরও মন বশীভূত করতে।’ তথাকথিত বিচারের ক্ষেত্রে আজ আওয়ামী লীগ সেই নীতিই অবলম্বন করছে। শহীদ মুজাহিদের মৃত্যুদন্ডে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ব্যক্তিত্ব তাদের উদ্বেগ অব্যাহত রেখেছে।
অথচ এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ট্রাইব্যুনালে জেরার সময় স্বীকার করেছেন, বাংলাদেশের কোথাও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সংঘটিত কোনো অপরাধের সাথে জনাব মুজাহিদ সম্পৃক্ত ছিলেন তার সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণ তার হাতে নেই। সম্পূর্ণ ধারণা ও ঢালাও অভিযোগের ভিত্তিতে একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। যাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে তিনি জানতেই পারলেন না কী অপরাধে তাঁকে হত্যা করা হলো।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যে অন্যায়ভাবে কোন ব্যক্তিকে হত্যা করলো, সে যেন গোটা মানবজাতিকে হত্যা করলো।” রাসূল (সা) বলেছেন, “বিচারক তিন ধরনের- দুই ধরনের জাহান্নামি ও এক ধরনের জান্নাতি। যে সত্য জেনেও অন্যায় বিচারকার্য করে সে জাহান্নামি, যার বিচারকার্যের জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও বিচারকার্য করল সে জাহান্নামি। আর যে সত্যকে জানলো এবং সে অনুযায়ী বিচার রায় দিল সে জান্নাতি (ইবনে মাজাহ)। বিচারের সাথে মিথ্যা সাক্ষ্যদানকে তিনি শিরকের সমতুল্য বড় গুনাহ বলে উল্লেখ করেছেন। যারা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়, মিথ্যা সাক্ষ্যদানে উদ্বুদ্ধ করে এবং জেনে-বুঝে এর পক্ষাবলম্বন করে এরা সবাই মুশরিক ও জালেম। জাহান্নামই তাদের ঠিকানা।” আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, ‘মুসলমানদের ওপর থেকে শাস্তি যতটা পারো রহিত করো। তাকে অব্যাহতি দেয়ার সুযোগ থাকলে অব্যাহতি দাও। কেননা শাসকের জন্য ভুলক্রমে শাস্তি দেয়ার চেয়ে ভুলক্রমে মাফ করা উত্তম।’
আওয়ামী লীগ হয়তো মনে করেছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের মাধ্যমে জামায়াত নেতৃবৃন্দকে একের পর এক হত্যা করে ইসলামী আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। কিন্তু আল্লাহর ঘোষণা, “তারা মুখের ফুৎকারে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তাঁর আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।” (৬১ : ৮)
তথাকথিত এই বিচারের নামে আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের নোংরা খেলায় নেমেছে তা এখন দিবালোকের মত স্পষ্ট। রাষ্ট্র পরিচালনায় জামায়াতের অংশগ্রহণ, দুই মন্ত্রীর জনপ্রিয়তা, জনসমর্থন ও সাংগঠনিক মজবুতি আওয়ামী বাম শিবিরকে দিশেহারা করে ফেলেছে। মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক হিসাব কখনো দুয়ে দুয়ে চারের পরিবর্তে অন্য কিছুও হয়। সে বার্তা উপজেলা নির্বাচনেই জামায়াতকে সমর্থন দেয়ার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
তা ছাড়া মিশরের কুখ্যাত প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসের মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা সাইয়েদ কুতুব, হাসান আল বান্নাকে হত্যা করে তাদের আদর্শকে স্তব্ধ করতে পারেনি। বর্তমানে ইখওয়ানের মুর্শিদে আম ড. বদি, প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসিসহ শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায় দিয়ে জুলুম-নিপীড়নের সব অস্ত্র ব্যবহার করেও দমাতে পারেনি। বরং অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী পশ্চিমা মদদপুষ্ট জালিম শাসক সিসি সম্প্রতি ব্রিটেন সফরে গিয়ে প্রকাশ্যভাবে বলতে বাধ্য হয়েছে যে, ব্রাদারহুড প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারবে। মূলত স্বৈরাচাররা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শক্তি দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী এটি সম্ভব হয়নি।
মুমিনের জীবনে সবচেয়ে বড় সফলতা শাহাদাতের মৃত্যু। এটি কোন মৃত্যু নয়, এ যেন নতুন জীবনের সূচনা। একেকজন শহীদের সাহসী উচ্চারণ আজ মুসলিম উম্মাহর পাথেয়। শহীদ মুজাহিদ বলেছেন, “আমি আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে বলছি, আমার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা ও বানোয়াট। ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন সময়ে কোন ধরনের অপরাধের সাথে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম না। শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধে এত বছর পর আমার বিরুদ্ধে এই মিথ্যা অভিযোগ সাজানো হয়েছে। প্রতিদিন বাংলাদেশে শত শত লোক স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। এসব মৃত্যুর সাথে ফাঁসির আদেশের কোনো সম্পর্ক নেই। কখন, কার, কিভাবে মৃত্যু হবে সেটা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই নির্ধারণ করেন। আল্লাহর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো সাধ্য কারো নেই। সুতরাং ফাঁসির আদেশে কিছু যায় আসে না। আমি মৃত্যুদন্ড বহাল রাখার ঘোষণায় উদ্বিগ্ন নই।
শহীদ পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রিয়জন হারানোর বেদনায় জ্বলতে থাকবে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, প্রতিটি মুহূর্ত। মহান রবের দরবারে সন্তানহারা মায়ের আহাজারি, স্বামীহারা স্ত্রীর ফরিয়াদ, বাবাহারা সন্তানদের অশ্রু বিসর্জন। আর প্রতি রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ শেষে চোখের পানি কি কোনোই কাজে আসবে না? হাদিসে আছে, শহীদেরা ৭০ জন ব্যক্তিকে সুপারিশ করে জান্নাতে নিতে পারবেন। শহীদের রক্তবিন্দু ঝরতেই তাকে মাফ করে দেয়া হয় এবং জান্নাতে যে তার আবাসস্থল, তা চাক্ষুষ দেখানো হয়। এই হত্যাকান্ডের বিচার দুনিয়ার আদালতে না হলেও আল্লাহর আদালত থেকে খুনিরা রেহাই পাবে না।
আদর্শের লড়াইয়ে যারা পরাজিত, তারা হিং¯্রতা, পৈশাচিকতা, জঘন্য, মিথ্যা, বানোয়াট, নোংরামি আর কূটকৌশল দিয়ে এই জাতির বীর সৈনিকদের অবদানকে কলুষিত করতে পারবে কি? দেশে-বিদেশে, খানায়ে কাবা আর মসজিদে নববীতে লক্ষ কোটি মানুষের কান্নার আওয়াজ আর জানাজায় উপস্থিতি আওয়ামী লীগ কি বার্তা পাচ্ছে! আওয়ামী লীগের জিঘাংসা আর ক্ষোভ হয়তো আরো বাড়বে। কারণ অনেকের বাবার নামাজের জানাজায় ১৮-১৯ জন উপস্থিত ছিল! এত অপপ্রচার, নোংরামি, ভন্ডামি, আর তামাশা করেও লাখো জনতার গগনবিদারী কান্না, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সমাহিত হওয়াও কি ঠেকাতে পেরেছে সরকার? রাসূল সা: বলেছেন, “আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ভালোবাসেন তখন তিনি ফেরেশতাদের ডেকে বলেন, দুনিয়ার মানুষকে জানিয়ে দাও তারাও যেন আমার এ বান্দাহকে ভালোবাসে।
এই জনপদে মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম, শহীদ মুজাহিদ, শহীদ কামারুজ্জামান, শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা ইসলামী আন্দোলনের যে বীজ বপন করেছেন, তা বিকশিত হয়ে গড়ে উঠেছে একটি তরুণ প্রজন্ম। তাদের নিরলস কর্ম, বক্তৃতা আর লেখনীর মাধ্যমে এই দেশের মানুষ তাদেরকে নিজ গড়জেই সম্মান করতে থাকবে। জাতি তাদের ঐতিহাসিক অবদানকে মূল্যায়ন করবে শতাব্দীর পর শতাব্দী। এই বীর সেনানীদের ভালোবাসতে থাকবে আর ঝরাতে থাকবে চোখের পানি। পৃথিবীর প্রান্তে-প্রান্তে প্রতিনিয়ত তাদের জন্য দোয়া করবে বিশ্বমানবতা। আর খুনি অভিশপ্তদের ঘৃণা করতে থাকবে অনন্তকাল। তাঁদের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “একজন আইনজীবী হিসেবে আমি বলতে চাই, মানবতাবিরোধী অপরাধে যে চারজনকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন আইনের অধীনে বিচার হলে, তাদের কারোরই ফাঁসি হতো না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেভাবে বিচার করতে বলেছে, সেভাবে বিচার করা হলে কারোরই ফাঁসি হতো না বলে আমি মনে করি। সকলেই মুক্তি পেতেন।”
শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ শেষ দেখায় স্ত্রী তামান্না-ই জাহানকে ধৈর্য ধরতে এবং শান্ত থাকতে বলেছেন। তাঁর পুত্র আলী আহমেদ মাবরুর বলেন, বিদায় বেলায় আব্বাকে একেবারেই শান্ত স্বাভাবিক দেখা গেছে। তবে প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে তিনি বেশ রিঅ্যাক্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, জীবনের শেষ দিনও সরকার আমাকে নিয়ে জঘন্য মিথ্যাচার করেছে। এর চেয়ে বড় জুলুম আর কী হতে পারে! শহীদ মুজাহিদ স্বজনদের বলেছেন, আমি কোন অপরাধ করিনি। সরকার আমার কোন অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি। তবু বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছি সাক্ষ্যপ্রমাণবিহীন এমন ঢালাও অভিযোগ দিয়ে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। যে অপরাধের কোন প্রমাণ নেই সে অপরাধের(?) জন্য ক্ষমা চাইবো কেন। মুজাহিদ বলেছেন, প্রেসিডেন্টের কাছে প্রাণভিক্ষার বিষয়টি প্রচার করে সরকার আমাকে কাপুরুষ হিসেবে দেশ জাতি এমনকি বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু যারা আমাকে চিনে, আমার নীতি আদর্শ সম্পর্কে অবগত, তারা কখনো এসব বিশ্বাস করবে না। ক্ষমা প্রার্থনার নাটক করে সরকার দেশবাসী বিশেষ করে আমার দলের লোকদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে। হাশরের ময়দানে দেখা হবে- স্ত্রীকে এমন সান্ত্বনা দিয়ে বিদায়ের শেষ মুহূর্তে মুজাহিদ বলেছেন, সংসারজীবনে তোমার মত ভালো স্ত্রী পেয়ে ¯্রষ্টার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। প্রতি-উত্তরে শহীদ মুজাহিদের স্ত্রী তামান্না-ই জাহান স্বামীকে একজন ভালো এবং নির্দোষ মানুষ হিসেবে প্রশংসা করেন।”
দ্বীনের সে অকুতোভয় সৈনিক তাঁর সার্বিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে পালন করেছেন আপসহীন ভূমিকা। কোন শক্তির কাছেই তিনি মাথা নত করেননি। আজ আমাদের প্রিয় নেতা শহীদ মুজাহিদ ভাই সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কোনো এক ব্যক্তি রাসূলূল্লাহ সা:কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:! কবরে সকল মুমিনের পরীক্ষা হবে, কিন্তু শহীদের হবে না, এর কারণ কী? হুজুর সা: জবাবে বললেন, তার মাথার ওপর তলোয়ার চমকানোই তার পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট।’
তিনি আল্লাহর দ্বীনের দায়ী হিসেবে সারা বাংলাদেশে নয়, বরং ছুটে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর অনেক প্রান্তে। মিথ্যা কালিমা আর ষড়যন্ত্রের কালো কাপড় কি সেই আলোকচ্ছটাকে আবৃত করতে পারে? যেই শির আজন্ম এক পরওয়ারদিগার ছাড়া কারো কাছে নত হয়নি, ফাঁসির আদেশে সেই শির দুনিয়ার কোন শক্তির কাছে নতি স্বীকার করতে পারে?
বাংলার আকাশ, বাতাস নির্যাতিতের করুণ ফরিয়াদে প্রকম্পিত। জালিমের নখরে তিক্ত-বিষাক্ত প্রতিটি জনপদ। কিন্তু তারপরও কি সত্য পথের সৈনিকেরা ভিত? না, বরং প্রতিটি মুমিন এই বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দেয়াকে নিজের ঈমানী দায়িত্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেই এগিয়ে চলছে। এই রকম কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে সকল নবী-রাসূল সা:কে। যুগে-যুগে যারাই সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, তাদের প্রত্যেককেই একই পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে এটাই স্বাভাবিক। এটি চিরন্তন। মুমিনরা যদি আল্লাহর ওপরে তাওয়াক্কুল করে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যেতে পারে তাহলে আল্লাহর সাহায্য অবধারিত।
শহীদের রক্ত আর মজলুমের চোখের পানি কখনো বৃথা যায় না। রাসূল সা: মুয়ায (রা) কে বললেন, হে মুয়ায! মাজলুমের দোয়া থেকে ভীত থাকবে, কারণ মাজলুম যখন আল্লাহর নিকট দোয়া করে তখন তার এবং আল্লাহর মাঝে কোন পর্দা থাকে না। সুতরাং জেল-জুলুম, নির্যাতন, হত্যা, ফাঁসি আমাদের জীবনে নতুন হলেও ইসলামী আন্দোলনে তা একেবারেই পুরাতন। তাই আসুন, শোককে শক্তিতে পরিণত করে শহীদের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ বাস্তবায়ন করে গড়ে তুলি একটি সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। মহান পরওয়ারদিগার শহীদ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ সকলকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন। আমিন।
লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, বিআইসিএস