পাকিস্তান ও ভারত জন্ম হওয়ার আগে ২০০ বছর কাশ্মীর ভারতীয় উপমহাদেশ (Indian Sub-continent) একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল ছিল। ব্রিটিশ রয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন এর পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশের বিবাদের বিষয় (Apple of discord) বানিয়ে রেখে যায় কাশ্মীর রাজ্যকে। অথচ কাশ্মীর যা বর্তমান বিশ্বের অনেক স্বাধীন রাষ্ট্রের চেয়েও বেশি সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৯৩% মুসলিম)। ভাষা-সংস্কৃতিতে পাকিস্তানের সাথে সাদৃশ্য থাকায় পাকিস্তানের অংশ না বানিয়ে, লর্ড এর কূটকৌশলের কারণে কাশ্মীরকে দু’ভাগ ও পরবর্তীতে তিন ভাগ হয়ে যেতে হয়। কাশ্মীর দীর্ঘদিনের আজাদী ও স্বায়ত্তশাসনের দাবির মুখে ১৯৯০ সালে ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ নং ধারায় কাশ্মীরের জন্য আলাদা সংবিধান, পতাকা প্রভৃতি অনুমোদন করে।
কাশ্মির সমস্যার সমাধান গণভোটের মাধ্যমেই সম্ভব। ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রের দাবীদার ভারত কখনই গণভোটে আগ্রহী নয়। কারণ ভারত ভালো করে জানে কাশ্মিরের মুসলিমরা অধীন মানতে চায়না। ভারত স্বায়ত্তশাসনের ৩৭০ সাংবিধানিক ধারা বাতিল করে অধিকার হরণ করছে। লঙ্ঘন করছে সংবিধান। খুলে দিয়েছে অবাধ অসভ্য, উশৃঙ্খলদের অনপ্রবেশের দুয়ার। মুদি সরকার বাস্তবায়ন করছে সংখ্যাগুরু কাশ্মীরী মুসলিমদের সংখ্যালঘুতে পর্যবসিত করার নীলনকশা।
কিন্তু ভারতের অধীনতা থেকে পুর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন চলছে। এসব আন্দোলনের অযুহাত দিয়ে ভারতীয় আইনশৃংখলা বাহিনী কাশ্মীরী বহু যুবককে তুলে নিয়ে কারাবাসে দিয়েছে। কাউকে বিচারিক কায়দায় হত্যা করেছে। কাউকে হত্যা করা হয়েছে বিচারবহির্ভুতভাবে। এসব ঘটনা বিশ্ব মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে বহুবার। কিন্তু এবার ঘটলো সম্পূর্ণ অযাচিত ঘটনা। যে সম্বন্ধে বিশ্ববাসীর কোনো ধারণাই ছিলো না। সর্বশেষ গত ০৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির বিশেষ অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিলের মাধ্যমে এবার কাশ্মীরকে পরিচয়হীন বানিয়ে দিলো ভারত। সংসদের নিম্নকক্ষের সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ যখন বিশেষ অধ্যাদেশ পড়ে শোনাচ্ছিলেন তখনো ১২ মিলিয়ন কাশ্মীরবাসী সহ সারাবিশ্ব জানে না কি থেকে কি হয়ে গেলো!। একটি ঘোষণা একটি স্বাধীন জাতির ললাটে একে দিল অবর্ণনীয়, নির্যাতন আর একটি অমানিষার কালো ঘোর অন্ধকার।
নয়াদিল্লির এই সিদ্ধান্তের ভারতের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সংসদে বিরোধী দলীয় সদস্যদেরকে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়। ভারতের দিল্লি, কলকাতা ও হায়দারাবাদ সহ বিভিন্ন জায়গায় জনগণ প্রতিবাদী মিছিল করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখনো বিক্ষোভ প্রতিবাদ অব্যাহত। অধ্যাদেশ জারির আগে মোদী সরকার সকল প্রকারের প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলার সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। ০৪ আগস্ট তারিখ রাত হতে কাশ্মীরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কয়েক দফায় ২০ হাজারের অধিক নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। বন্ধ করা হয় ইন্টারনেট, টেলিফোন, মোবাইল সংযোগ এমনকি ডাকবিভাগও। সারাবিশ্ব থেকে কাশ্মীর উপত্যকাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। রাজ্যের সাবেক মূখ্যমন্ত্রী, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দকে গৃহবন্দীত্ব থেকে গ্রেফতার করা হয়। যোগাযোগের সকল মাধ্যম বিচ্ছিন্ন থাকায় কাশ্মীরের হালনাগাদ খবর বিশ্ব গণমাধ্যমে আসতে পারছেনা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী পৃথিবীর যুদ্ধ হবে পানিকে কেন্দ্র করে। কাশ্মিরে রয়েছে প্রকান্ড সব হিমবাহ। হিমালয় থেকে নেমে আসা ঝিলাম, চেনাব, সাটলেজ, রাঙি, বিয়াস, সিন্ধু প্রভৃতি নদনদী ভারতের এক বিলিয়ন মানুষকে পানি এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। আবার পাকিস্তানের কৃষিও প্রধানত এই অঞ্চল থেকে প্রবাহিত পানির ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে ভারত মরিয়া। কেন্দ্রীয় জলশক্তিমন্ত্রী গজেন্দ্র সিং জানিয়েছেন, ভারতীয় নদ-নদীর পানি পাকিস্তানে যাওয়া বন্ধ করতে তিনি কাজ শুরু করেছেন।
”হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গঠনে ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ’ (আরএসএস) এখন প্রায় উম্মুক্ত হিংস্র সিংগের মত। তারা মুলত ভারতের হিন্দু সাম্প্রদায়িক জঙ্গি সংগঠন। মুসলিমদের হত্যা ও উচ্ছেদ করা আরএসএসের অন্যতম প্রধান কর্মসূচি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন গান্ধীজী। স্বাধীনতার চার মাসের মাথায় আরএসএস সদস্য নাথুরাম গডসে তাকে গুলি করে হত্যা করে। হত্যার কারণ সে আদালতে জবানবন্দীতে বলে গেছে। তার ভাষায়, ‘মুসলিমরা এক হাজার বছর ভারত শাসনের নামে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করে গেছে। অখন্ড ভারত স্বাধীন হলে এসব অত্যাচারের শোধ নেয়া যেত। কিন্তু গান্ধী মুসলিমদের জন্য আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের সুযোগ দিয়ে ভারতকে খন্ডিত করেছেন।’ এমনই কট্টর সাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসবাদী মতাদর্শের জন্য ইংরেজ আমলে আরএসএস নিষিদ্ধ ছিল। পরে গান্ধী হত্যা ও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরও একে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। আরএসএসের দৃষ্টিতে নাথুরাম ‘বিরাট বীর’। মধ্যপ্রদেশে মহাত্মা গান্ধীর এই স্বীকৃত খুনির নামে এখন মন্দির নির্মিত হচ্ছে।
তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। তিনজনেরই চোখ এখন কাশ্মিরে। সরকারের প্রধান তিন কর্তাই আরএসএসের সদস্য ছিলেন। অমিত শাহ সম্প্রতি সংসদে বলেছেন, পাক-অধিকৃত আজাদ কাশ্মিরের জন্য তিনি প্রাণ দিয়ে দেবেন। রাজনাথ সিং বলেছেন, পাকিস্তানের সাথে কোনো আলোচনা যদি হতে হয়, তা হবে আজাদ কাশ্মির নিয়ে। জম্মু-কাশ্মির নিয়ে তাদের সাথে আমাদের কিসের কথা? এ ছাড়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী আগে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার না করার নীতি থেকেও ভারতের সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাহলে কি কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে পারমানবিক যুদ্ধ অত্যাসন্ন? ভারত শক্তি দিয়ে কাশ্মীরিদের দমন করতে পারবে?
মজলুম বনী আদমের কান্নার আওয়াজ আরশ পর্যন্ত প্রসারিত হলেও পৃথিবীর বধির, অন্ধ, ক্ষমতাস্বার্থলিপ্সু অ-মানুষদের হৃদয় যেন নাড়া দিতে পারছেনা। নির্যাতিত নারীর ক্রন্দন, বঞ্চিত, ক্ষুদার্ত অবুঝ শিশুর করুণ চাহনি ভাবিয়ে তুলছে। কত হিংস্র, জঘন্য, বর্বর আর অসভ্য তা বিশ্ববাসী দেখছে। কাশ্মীর এখন জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড। গত কয়েকদিনে প্রায় লক্ষাধিক নর-নারী-শিশু নিহত নাকি এ হিসাব এরও বেশী? প্রতিনিয়ত গুম হচ্ছে হাজারো স্বাধীনতাকামী যুবক যোদ্ধারা। পাশবিক নিগ্রহের শিকার মায়ের জাতি নারী। নতুন প্রজন্মকে ধ্বংশ করতে শিশুদের উপর চলছে অমানবিক নির্যাতন। হিন্দুত্ত্ববাদী আরএসএস এর উত্তরসুরীরা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করছে বাড়ি, ঘর, ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান, স্কুল, মক্তব ও মসজিদ। জাতি ধ্বংসের এক উন্মুক্ত নেশায় মত্ত্ব মুদি সরকারের রক্ত পিপাসুর দল। মানবতা বিধবংসী জাতির নিধনের জঘন্যতম ঘটনা সম্প্রতি মায়ানমারে প্রত্যক্ষ করেছে সারা বিশ্ব। রহিঙ্গারা আজ নিজেদের ভিটে-মাটি থেকে বিতাড়িত হয়ে খোলা আকাশের নিচে ধুকে ধুকে মরছে। কারণ তারা মুসলমান!।
কাশ্মীরীরাও অধিকাংশ মুসলমানমান। তাই তাদের জন্য আইন, মানবিকতা, অধিকার সবই যেন তুচ্ছ! মুসলমান না হলে এত দিনে সারা দুনিয়ায় হৈ চৈ পড়ে যেত। জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংগঠন আর বিশ্ব মোড়লেরা থাকত সোচ্চার এবং সক্রীয়। কিন্ত মুসলমান! বলেই কি বিশ্ব মোড়লরা নিশ্চুপ!। তাছাড়া মধ্যপ্রচ্যের মুসলিম শাসকরাতো ক্ষমতায় টিকে থাকতে নিজেদের বিবেক বন্ধন রেখেছে পশ্চিমা প্রভুদের কাছে। মুসলমানদের নানাবিধ সংকট আর বিভেদ তৈরী করে নিয়ন্ত্রন করছে। আজ মুসলিম উম্মাহর নেই কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। ফলে দিশেহারা ১’শ ৭০ কোটি মুসলমান জুলুম-নির্যাতন, লাঞ্ছনা-বঞ্ছনার শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এ কথা আজ দিবালোকের মত পরিস্কার ভারত ১৯৭১ সালে নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের জনগণকে সহযোগিতা করেছিলো। আবার নিজেদের স্বার্থেই কাশ্মীরের স্বাধীনতা কামীদের দমন করছে।