পৃথিবীর ভূস্বর্গ হিসেবে পরিচিত কাশ্মীর। অনেক সভ্যতার মিলনস্থল। পারস্য, মধ্য এশিয়া, চীন ও ভারতীয় সভ্যতার মিলন হয়েছে কাশ্মীরে। ঐতিহাসিকদের দৃষ্টিতে, প্রতিটি সভ্যতাই যেন পর্বতবেষ্টিত কাশ্মীর উপত্যকার সীমানায় এসে থমকে গেছে। কেউ এসে এককভাবে একে দখল করতে পারেনি। কাশ্মীর শীতল ও নিরিবিলি হওয়ায় ধ্যান-জ্ঞান সাধনায় এলাকাটি বেশ উপযোগী। ফলে কাশ্মীর ছিল জ্ঞানের কেন্দ্র। ভারতীয় সভ্যতার অগণিত তথ্য ও উপাখ্যান লিখিত ও ব্যাখ্যাত হয়েছে কাশ্মীর থেকে। যুগান্তকারী সব জ্ঞানের বিকাশ হয়েছে এই জনপদে। বৈদিক যুগের পাঞ্জাবের তক্ষশীলা বিদ্যাকেন্দ্র ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিল কাশ্মীরের জ্ঞান দ্বারা। বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ পানিনির ব্যাকরণের ব্যাখ্যা ‘মহাভাষ্য’ লিখেছিলেন যিনি তার নাম পাতাঞ্জলি। তিনি ছিলেন কাশ্মীরি। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকেই এমন অসংখ্য জ্ঞান সাধকের উপস্থিতি পাওয়া যায় এখানে।
বৈজ্ঞানিক ধারণা, পৃথিবীর বয়স ৪.৬ বিলিয়ন বছর। আর ৩০ বিলিয়ন বছর আগে হিমালয় পর্বতমালা সৃষ্টি হয়েছে। ইতিহাসবিদরা বলেন, এখানে মানব বসতি শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ বছর আগে। অর্থাৎ এখন থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে। সম্ভবত নূহের (আ.) মহাপ্লাবনের কাছাকাছি সময়ে। প্রত্মতাত্ত্বিকদের মতে, প্যালিওলিথিক, নিওলিথিক ও মেগালিথিক সকল যুগের প্রত্মনিদর্শনের সন্ধান মিলেছে কাশ্মীর ভূখন্ডে।
কাশ্মীরের শ্রীনগর পাঁচ হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্যেবাহী রাজধানী। ঐতিহাসিক ঝিলাম নদী শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে। পাশেই সুবিশাল ডাল লেক। দক্ষিণ থেকে উত্তরে রয়েছে অগণন প্রত্মনিদর্শন রয়েছে এখানে। মোঘলদের প্রকৃতি আর প্রকৌশলের মিশেলে গড়ে তোলা বাগান-বিলাশ। চারপাশে পর্বতের সারি, মধ্যে সমতল ভূমিতে মানুষের বসবাস। ওয়াল্টার আর, লরেঞ্জ’র বর্ণনায় কাশ্মীর হলো, ‘কালো পর্বতমালার মধ্যে একখন্ড জমিন সাদা পায়ের ছাপের মতো। কাশ্মীরের মুসলিম ইতিহাস কৃষি, বাণিজ্য, শিক্ষা, ভাষা, সংস্কৃতি ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। তাই মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আকুল আকাঙ্ক্ষা ছিল কাশ্মীরের তৃণভূমিতে মৃত্যুবরণ করার। তিনি ফার্সি ভাষায় বলেছিলেন, ‘আগার ফেরদৌস বেরোহী যামীন আস্ত, হামীন আস্ত, হামীন আস্ত, হামীন আস্ত-যদি পৃথিবীতে কোন বেহেশত থেকে থাকে তাহলে তা এখানে, এখানে, এখানে”।
অপরুপ মহিমায় ভাস্কর মনোমুগ্ধকর এই জনপদে প্রায় দেড়কোটি মানুষের বসবাস। কিন্তু ৭২ বছর ধরে আধিপত্যবাদী শক্তির নোখরে রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত। এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা-তে কাশ্মীর শব্দটি প্রাচীন কাশ্যপনগর এর পরিবর্তিত রূপ। এটি অনেক প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থান। ”কাশ্মীরে ইসলামের আগমন কোনো রাজার শোষণ বা দখল করার মাধ্যমে হয়নি। বরং পীর ও সাধকদের হাত ধরে ইসলাম এসেছিল ও বিকশিত হয়েছিল। ভালবাসা, ভ্রাতৃত্ব আর সাম্যের বার্তা নিয়ে ক্রমান্বয়ে জনসংখ্যার সংখ্যাধিক্য অর্জন করেছিল। কাশ্মীরে ইসলামের ভিত্তি গড়ে তোলাটা চতুর্দশ শতকে হলেও মুসলমানদের আনাগোনা বহু পুরনো। অধ্যাপক ফিদা এম হাস্নাইন লিখেছেন, ‘৬২৮ সালে ইসলামের মুহাম্মদ (ﷺ) তার দূত পাঠাচ্ছিলেন বিভিন্ন সম্রাটের কাছে। ৬৩০ সালে তিনি এশিয়ার বিভিন্ন রাজার কাছে দূত পাঠান। আবু হুযাইফা ইয়ামান (রা:)-কে দিয়ে একটি পত্র পাঠানো হয়েছিল চীনে। ওই আরব দূত সিল্কারুট হয়ে চীনের দিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তীব্র তুষারপাতের কারণে তিনি কাশ্মীরে আটকা পড়েন। আরব ওই দূতকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন কাশ্মীরের রাজা ভীনাদিত্য। এমনকি তিনি আবু হুযাইফা ইয়ামানকে ‘জলকার’ উপাধি দেন। পরের বছর নবী (ﷺ) দু’জন দূত পাঠান কাশ্মীরের রাজার কাছে। সঙ্গে দেন কিছু উপহার। এর মাধ্যমে ইসলাম কাশ্মীরে আসে সপ্তম শতকেই। সরাসরি আরব থেকেই আসে।
জম্মু -কাশ্মীর দীর্ঘদিন হিন্দু এবং মুসলিম সুলতানদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। সম্রাট আকবরের সময়ে তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৭৫৬ সাল থেকে আফগান শাসকদের অধীনে থাকার পর ১৮১৯ সালে শিখ রাজ্য পাঞ্জাবের সাথে সংযুক্ত হয়। ১৮৪৬ সালে ব্রিটিশ ও শিখদের মধ্যে ঐতিহাসিক সাবরুন যুদ্ধে শিখরা পরাজিত হলে পর অমৃতসর চুক্তি (Treaty of Amritsar) অনুযায়ী কাশ্মীর ভূখণ্ড ইংরেজরা গুলাব সিংয়ের কাছে মাত্র ৭.৫ মিলিয়ন নানকশাহী রুপির বিনিময়ে বিক্রি করে। হতভাগা কাশ্মীরিদের এই কেনাবেচাকে ১৯৪৭ সালে মহাত্মা গান্ধী ‘ডিড অব সেল’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছিলেন। বিখ্যাত কবি আল্লামা ইকবালও কাশ্মীরকে উপমিত করেছিলেন ‘বিক্রীত জাতি’ হিসাবে। তার কবিতায় বলেন, ‘হায়! ফসলের মাঠ, পানির ছড়া, উপত্যকার কৃষকদেরও ওরা বেচে দিল! বেঁচতে বাদ রাখেনি কিছুই’। এ নিয়ে হাফিজ জালান্দারি তার বিখ্যাত উর্দু কবিতার শিরোনাম দিয়েছিলেন ’৭৫ লাখ কা সওদা’। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৮৪৬ সালে কাশ্মীরকে বিক্রির ঘটনা কোন জাতির বিক্রি হওয়ার সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। ১৭০ বছর পরও ৭৫ লাখ রুপির এই ক্রয় চুক্তি এখনও কাশ্মীর জাতিসত্তার সমস্যার মূল হিসেবে সামনে আসছে। ( সুত্র: কাশ্মীরের ইতিহাস)
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময় কাশ্মীরের তৎকালীন রাজা হরি সিং হিন্দু হলেও তার প্রজারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় তার পক্ষে ভারত অথবা পাকিস্তান কোনো একটিতে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে একদল মুসলিম পাকিস্তানে যাওয়ার চেষ্টা করলে পাকিস্তান তাদেরকে গ্রহণ করতে কাশ্মীরে প্রবেশ করে। ফলে রাজা হরি সিং ভারতে পালিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের কাছে সামরিক সহায়তা চায়। সে ভারতকে কাশ্মীরে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে ২৬ অক্টোবর একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। যদিও এর সত্যা-সত্যি প্রমানে রয়েছে অনেক প্রশ্ন। ১৯৪৭-১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালের ১৩ আগস্ট তারিখে জাতিসংঘ পাকিস্তানকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়ার নির্দেশ দেয়। ফলে ভারত ও সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। কাশ্মির শত শত বছর ধরেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। ১৯৪১ সালো আদমশুমারি অনুযায়ী জম্মু-কাশ্মিরে মুসলিম ছিল ৭৫.৯৭ শতাংশ। আর সবচেয়ে জনবহুল কাশ্মির উপত্যকায় এ হার ৯৫ শতাংশ। জম্মু-কাশ্মির পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার, নইলে স্বাধীন হওয়ার কথা। কিন্তু চক্রান্ত তা হতে দেয়নি।