বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেছেন, ৭ নভেম্বরে সিপাহী-জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে শৃঙ্খলমুক্ত করেছিল। মূলত বিপ্লব ও সংহতি দিবসের চেতনা আধিপত্যবাদী ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ববিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের চেতনা। তাই ৭ নভেম্বরের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অগণতান্ত্রিক শক্তির মোকাবিলায় সকলকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে ঝঁপিয়ে পড়তে হবে। তিনি দেশ, জাতিসত্তা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় সকলকে ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
তিনি আজ রাজধানীর একটি মিলনায়তনে কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগরী উত্তর আয়োজিত বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষ্যে এক আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। আলোচনা সভায় উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের নায়েবে আমীর আব্দুর রহমান মুসা, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সেক্রেটারি ড. মুহা. রেজাউল করিম, কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের সহকারি সেক্রেটারি লস্কর মোহাম্মদ তসলিম ও কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য নাজিম উদ্দীন মোল্লা প্রমূখ।
সেলিম উদ্দিন বলেন, অনেক ত্যাগ ও কোরবানীর বিনিময়ে ১৯৭১ সালে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল নাগরিকদেরকে দেশপ্রেমের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করে সকলকে জাতীয় উন্নয়নের অংশীদারে পরিণত করার পরিবর্তে হিংসা, বিদ্বেষ ও বিভাজনের রাজনীতির অপকৌশল গ্রহণ এবং সার্বিকভাবে তাদের অদূরদর্শিতা, অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার কারণেই আজও স্বাধীনতার কাঙ্খিত সুফল আমরা ঘরে তুলতে পারিনি। তারা ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও ৪টি রাষ্ট্রায়ত্ব পত্রিকা বাদে সকল গণমাধ্যমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একদলীয় বাকশালী শাসন কায়েম করেছিল। সে ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর তদানীন্তন সেনা প্রধান জিয়াউর রহমানসহ দেশপ্রেমী সেনা কর্মকর্তাদের আটক করে দেশে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল। ফলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আবার হুমকির মুখোমুখী হয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সিপাহী-জনতার ঐক্য অত্যাবশ্যকীয় হয়ে ওঠে।
তিনি বলেন, মূলত ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার ঐক্য ও সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে আধিপত্যবাদী অপশক্তি ও তাদের দোসরদের কবল থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা হয়। সিপাহী-জনতার সাথে সকল পেশা ও শ্রেণির মানুষ রাজপথে নেমে আসে। তারা দেশ ও জাতিকে আধিপত্যবাদী শক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে রাজপথে নেমে এসে ট্যাংকের উপরে উঠে উল্লাস প্রকাশ করে। ‘নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার’ ও ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ। এর মাধ্যমে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রকৃত চিন্তা-চেতনা, বোধ-বিশ্বাস, আবেগ-অনুভূতি ও দেশপ্রেমের স্ফূরণ ঘটে। তাই ৭ নভেম্বরের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে আধিপত্যবাদ ও দুঃশাসন মুক্ত করতে এই চেতনার লালন, বাস্তবায়ন ও বিকাশ সাধনে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭৫ সালে দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ক্ষমতাসীনরা সারা দেশে লুটপাট ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। তারা ২০০৬ সালে লগি-বৈঠার তান্ডবের মাধ্যমে প্রকাশ্য দিবালোকে রাজপথে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করে বিশ^বিবেককে স্তম্ভিত করে দেয়। ২০০৮ সালের পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে সারা দেশে অসংখ্য মানুষ খুন, অপহরণ, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডসহ বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক মামলা, গণগ্রেফতার ও রিমান্ডের নামে নির্মম ও নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায়। নির্বাসনে পাঠানো হয় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে। তারা ৫ জানুয়ারির তামাশা ও ভাঁওতাবাজির নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতায় এসে নতুন করে খুন, গুম অপহরণ ও গুপ্তহত্যাসহ নানাবিধ অপকর্মে লিপ্ত হয়। ক্ষমতাসীনরা কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে জাতীয় নেতাদের একের পর এক নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে দেশকে রক্তাক্ত ও কলঙ্কিত করে।
মহানগরী আমীর বলেন, ক্ষমতাসীনরা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসতে পারবে না জেনেই আদালতের দোহাই দিয়ে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছে। এক অনিবার্য বাস্তবতায় কেয়ারটেকার সরকারের ফর্মূলা দিয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর, ডাকসুর সাবেক নির্বাচিত জিএস, প্রখ্যাত, দূরদর্শী ও বর্ষীয়ান রাজনীতিক ভাষা সৈনিক মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে ক্ষমতাসীনদের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার কোন রেকর্ড নেই। তাই তিনি জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্যই নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকারের ফর্মূলা জাতির সামনে উপস্থাপন করেছিলেন। ১৯৮৪ সালের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেইটের এক সমাবেশ থেকে দলের তদানীন্তন ভারপ্রাপ্ত আমীর মরহুম আব্বাস আলী খান জাতির সামনে এই প্রস্তাব উপস্থাপন করেন।
তিনি বলেন, ১৯৯০ সালে সেই প্রস্তাবনা ও রূপরেখার আলোকেই কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সফল ও সার্থক নির্বাচন অনু্িষ্ঠত হয়। উল্লেখ্য, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা জামায়াতে ইসলামীই প্রথম উত্থাপন করেছিল এবং বর্তমান ক্ষমতাসীনরা এই দাবিতে জামায়াতের সাথে একাত্ম হয়ে ১৯৯৬ সালে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। সে আন্দোলনের ফলশ্রুতিতেই সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা সাংবিধানিক ভিত্তি পায়। আর সে সংশোধনীর আলোকেই ১৯৯৬ সালের ১৫ জুনের নির্বাচনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন পর আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় এসেই তারা গণতন্ত্র ও অবাধ নির্বাচনের রক্ষাকবজ কেয়ারটেকার সরকারে বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তে লিপ্ত হয়। পরবর্তীতে জনৈক ব্যক্তি সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করে। মহামান্য হাইকোর্টে সে রীট খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু ২০০৮ সালে পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূলবোধের বিরুদ্ধে তাদের পুরাতন বাকশালী চিন্তা-চেতনাকে ধারন করে নতুন রূপে রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করে। যার ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক দল ও নেতা-কর্মীদের পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির যেটুকু ঐতিহ্য বহাল ছিল তাও ম্লান হয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় ত্রয়োদশ সংশোধনী বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা হয়। পরবর্তীতে আপীল বিভাগের এক বিভক্ত রায়ে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হলেও দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে করার নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৬ মাস পরে আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায়ে সংক্ষিপ্ত রায়ের কোন প্রতিফলন দেখা যায়নি। এতে প্রমাণিত হয় যে, সংবিধানের কথা বলে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছার প্রতিফলন ও রাজনৈতিক দুরভিসন্ধির বহিঃপ্রকাশ।
তিনি আরও বলেন, দেশের সকল বিরোধী দল ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ উপেক্ষা করে সরকার মনের মাধুরী মিশিয়ে সংবিধান সংশোধন করে এখন অবৈধ ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্যই সংবিধান রক্ষার ধুয়া তুলেছে। মূলত আমাদের দেশের কোন রাজনৈতিক সংকটেরই সংলাপের মাধ্যমে সমাধান হয়েছে এমন কোন নজির নেই। আবার সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই সবকিছুর সমধান হয়েছে এমনটাও নয়। বরং দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থ, দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও শান্তি-শৃঙ্খলা অব্যাহত রাখার জন্য সাংবিধানিক কাঠমোর বাইরেও যেতে হয়েছে। পরবর্তী সংসদে তা অনুমোদন করে নেয়ার রেওয়াজও আছে। ১৯৯০ সালের বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন কেয়ারটেকার সরকার এবং ২০০৬ সালের ফখরুদ্দীন-মঈন উদ্দীনের জরুরি সরকার সংবিধান সম্মত ছিল না। উল্লেখ্য ২০০৬ সালের অসাংবিধানিক সরকারের সুবিধাভোগী বর্তমান ক্ষমতাসীনরা। তারা নিজেদের অতীত ভুলে গিয়ে এখন সংবিধান রক্ষার নামে গণতন্ত্র হত্যা ও দেশে নবরূপে-নবকৌশলে একদলীয় বাকশালী শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ক্ষমতার মসনদকে চিরস্থায়ী করার সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছে ।
মহানগরী আমীর বলেন, সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচন গণদাবি হলেও সরকার সংবিধানের অপব্যাখ্যা করে তা পাশ কাটাতে চাচ্ছে। সংবিধানের ১২৩ (খ) ও ৫৬ (৪) অনুচ্ছেদ সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচনের অনুকুলে। ১৯৭৩ সালে গণপরিষদ বিলুপ্তির পর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল এমন নজীরও আমাদের সামনে রয়েছে। এমনকি বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক সংবিধানের মধ্যে অন্তত দশ জায়গায় সংসদ ভেঙে নির্বাচনের কথা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, আমরা চাই দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সকলের অংশগ্রহণমূলক একটি জাতীয় নির্বাচন। সে লক্ষ্যে প্রয়োজন হলে মহামান্য রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমেও অনেক রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হতে পারে। যেমনটি তিনি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বৈধতা দেয়ার জন্য অধ্যাদেশ জারি করেছেন। একইভাবে তিনি ইভিএম বাতিল, ম্যাজিষ্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনে সেনা মোতায়েন ও নির্বাচন কমিশন পূনর্গঠনের উদ্যোগ নিতে পারেন।
অতীত দৃষ্টান্তে একথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংবিধান কোন বাধা নয় বরং রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব। কিন্তু সরকার নিজেদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্যই সংবিধানের নামে রাজনৈতিক সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে। তাই নিরপেক্ষ নির্বাচন ও কেয়ারটেকার সরকারের দাবি আদায়ের জন্য সংলাপের পাশাপাশি রাজপথে শান্তিপূর্ণ দুর্বার গণআন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। তিনি হৃত গণতন্ত্র পূনরুদ্ধার ও ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার সংগ্রামে দল, মত, জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অহবান জানান।