ইসলামের সাথে সন্ত্রাসবাদের কোন সংযোগ নেই। তাই জামায়াতে ইসলামী সকল প্রকার সন্ত্রাসবাদের বিরোধী। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর নিম্নলিখিত পুস্তিকা এ বিষয়ে পরিষ্কারভাবে জামায়াতে ইসলামীর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে:
“ইসলাম আল্লাহ মনোনীত, রাসূল (সা.) প্রদর্শিত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। যার লক্ষ্য দলমত, জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের শান্তি, কল্যাণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সর্বস্তরের জনমানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ন্যায়বিচারের গ্যারান্টি দেওয়া।
ইসলামের আদর্শ যারা গ্রহণ করে, শুধু তাদেরই নয়- যারা ইসলাম গ্রহণে ব্যর্থ হয় বা বিরত থাকে ইসলাম তাদেরও মৌলিক চাহিদা ও মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের পূর্ণ নিশ্চয়তা দেয়। স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম কর্ম পালনের সুযোগ দেয়, তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
ইসলাম গ্রহণ করা না করার বিষয়টি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার উপর স্বয়ং আল্লাহই ছেড়ে দিয়েছেন এবং এক্ষত্রে বল প্রয়োগ করা নিষিদ্ধ করেছেন। আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণা-
“যার মন চায় সে ঈমান আনবে, আর যার মন চায় সে কুফরী করবে।” (সূরা আল কাহফ – ২৯)
আল্লাহ তা’য়ালার আরো ঘোষণা :
“আমি তাদের সামনে দুটি পথই দেখিয়েছি। একটি মানুষের রবের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার পথ, অপরটি তাদের রবকে অস্বীকার করার (কুফরীর) পথ।” (সূরা আদ-দাহর – ২)
আরো স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে-
“দীন গ্রহণে কাউকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে বাধ্য করা যাবে না। সত্য পথ গোমরাহী বা ভুল পথ থেকে সুস্পষ্টভাবেই পৃথক হয়ে পড়েছে।” (সূরা আল বাকারা – ২৫৬)
এই আয়াতটি থেকে স্পষ্ট যে দিক নির্দেশনা মিলে তা হল নবী-রাসূল এবং তাদের অনুসারীদের কাজ হলো সত্য দীনকে ভ্রান্ত দীন ও মতবাদ থেকে স্পষ্টভাবে পৃথক করে দেখানো যুক্তি-প্রমাণ ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে। বল প্রয়োগের মাধ্যমে কাউকে বাধ্য করা তাদের কাজ নয়। আল্লাহ তাঁর রাসূলকে (সা.) পর্যন্ত এ ভাষায় সতর্ক করেছেন-
“তোমাকে তো উপদেশ প্রদানকারী হিসেবে পাঠানো হয়েছে- বল প্রয়োগকারী রূপে নয়।”
বাস্তবে নবী-রাসূলগণ আল্লাহর নির্দেশে যুগে যুগে ইসলামের দাওয়াত উপস্থাপন করেছেন মানুষের একান্ত দরদী বন্ধু হিসেবে, বিশ্বস্ত কল্যাণকামী ও একনিষ্ঠ উপদেশ দানকারী হিসেবে। তাঁরা নির্যাতিত হয়েছেন, চরম জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন; কিন্তু প্রতিশোধ নিতে যাননি।
শান্তির স্বার্থে, অশান্তি ও ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের কবল থেকে মজলুম মানবগোষ্ঠীকে মুক্তি দেবার স্বার্থে, যুদ্ধ অবশ্যই কারো কারো জীবনে করতে হয়েছে। তবে তা হয়েছে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে, নিছক শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে জালেমের জুলুম নির্যাতন ও ফিতনা-ফাসাদের মূলোৎপাটন করে সমাজে শান্তি, কল্যাণ ও ন্যায়-ইনসাফ এবং মানুষের জানমাল ইজ্জত আব্রুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যেই।
আধুনিক বিশ্বে সন্ত্রাসের যে চিত্র আমরা দেখি, ইসলামী আদর্শ এবং শিক্ষা সংস্কৃতির সাথে, ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে তার দূরতম কোন সম্পর্কও খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এরপরও দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান বিশ্বের এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে, ইসলামের পক্ষে গণজাগরণের শুভ সূচনার ইশারা যখন স্পষ্ট- ঠিক সেই মুহূর্তে মুসলিম নামধারী এক শ্রেণীর বিপথগামী পথভ্রষ্ট ও অপরিণামদর্শী অর্বাচীন লোকদের পক্ষ থেকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্যে সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়ায় ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর জন্যে সৃষ্ট সম্ভাবনা হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, বিশ্বব্যাপী জড়বাদী বস্তুবাদী সভ্যতার পতনের প্রেক্ষাপটে ইসলামের বিজয়ের সম্ভাবনা দেখে ভীত-শংকিত একটি চিহ্নিত গোষ্ঠী তাদের কায়েমী স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে চতুর্মুখী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র করছে। তাদের এই যড়যন্ত্র বাস্তবায়নের জন্যে মুসলিম উম্মাহর ওপর ক্র্যাকডাউনের যে প্রেক্ষাপট দরকার ইসলামের নামে সন্ত্রাসকারীরা সেই প্রেক্ষাপট তৈরির কাজটাই করে যাচ্ছে।
ইসলামের প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গৃহীত কোন কার্যক্রমের সাথেই সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সংগতিপূর্ণ নয়- এটা যেমন দুনিয়াব্যাপী মুসলিম উম্মাহর স্বীকৃত পরিচিতি ও প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যক্তিত্ব, দল ও প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছে সুস্পষ্ট তেমনি সুস্পষ্ট মুসলিম উম্মাহর কাছেও।
এতদসত্ত্বেও জায়নবাদী প্রচারণায় ও পৃষ্ঠপোষকতায় একশ্রেণীর মুসলিম নামধারী বুদ্ধিজীবী তথা সুশীল সমাজ ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ইসলামী আন্দোলনের মূল ধারাকে তথাকথিত ইসলামী জঙ্গিবাদের সাথে সম্পৃক্ত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে আসছে। অথচ সন্ত্রাসের সংজ্ঞা, যুগে যুগে সন্ত্রাসবাদের খণ্ড চিত্র এবং সন্ত্রাসবাদের আধুনিক রূপ এর কোনটার সাথেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত কার্যক্রমের কোন সাজুয্য থাকার প্রশ্নই উঠে না।
সন্ত্রাসের মূল কথা- মানুষকে ভীত সন্ত্রস্ত করে, জানমালের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে কোন কিছু করতে বাধ্য করা। এটা রাজনৈতিক রূপ নিলে যার অর্থ দাঁড়ায় “সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর সংখ্যালঘিষ্ঠের মতকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে চাপিয়ে দেওয়া।” “সংখ্যাগরিষ্ঠের উপর সংখ্যালঘু কোন গোষ্ঠীর মতামত চাপিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে যে ভয়ংঙ্কর ভীতিকর, অমানবিক পৈশাচিক ও অগণতান্ত্রিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় বল প্রয়োগের মাধ্যমে” তাকেই আমরা রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদ হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। যার সাথে ইসলামী আদর্শের মূলনীতি এবং শিক্ষা-দীক্ষার কোন দূরতম সম্পর্কই থাকতে পারে না।
এ সম্পর্কে কুরআনের বক্তব্য সুস্পষ্ট :
“আল্লাহ কোন জাতির ভাগ্য ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না-যতক্ষণ না সে জাতি নিজে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট হয়।” (সূরা আর রা’দ-১১)
শেষ নবী (সা.) মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। মক্কায় প্রথম ওহি নাযিল হয়। দীর্ঘ তের বছর মক্কাতেই তিনি দাওয়াত দিতে থাকেন এবং ইসলামের আদর্শ ও শিক্ষা-দীক্ষার প্রচার-প্রসারে নিয়োজিত থাকেন। কিন্তু মক্কার আগে মদীনায় ইসলাম বিজয়ী হয় কিভাবে? উত্তর একটাই। মক্কাবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম গ্রহণে সক্ষম হয়নি- পক্ষান্তরে মদিনাবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম গ্রহণে ও রাসূলের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে এগিয়ে আসার কারণেই মদীনায় ইসলাম বিজয় লাভ করে এবং ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার গোড়া পত্তন হয়। আল কুরআনের স্পষ্ট নির্দেশনা ও রাসূল (সা.)-এর বাস্তব আমলকে উপেক্ষা করে মনগড়াভাবে কেউ ইসলাম কায়েমের স্বপ্ন দেখতে পারে না। আর দেখলে তা ইসলাম সম্মত হতে পারে না।
ইসলামের সাথে কোন প্রকারের সন্ত্রাসবাদের সম্পর্ক থাকতে পারে না, থাকার প্রশ্নই উঠে না, এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। আমরা এ পর্যন্ত সংক্ষেপে সে কথাটিই বলার প্রয়াস পেয়েছি। এই পর্যায়ে আমরা সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা ও এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরতে চাই- The World Book Encyclopedia ১৯৮৯ edition, Page ১৭৮-১৭৯ থেকে, এই আশায় যে পাঠক নিজেই এর সাথে মিলিয়ে দেখার পর সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, আমরা যে দাবি করেছি সন্ত্রাসবাদের সাথে ইসলামকে সম্পৃক্ত করার আদৌ কোন সুযোগ নেই, তা কতটা যথার্থ।
TERRORISM (সন্ত্রাসবাদ)
Terrorism is the use or threat of violence to create fear and alarm. Terrorists murder and kidnap people, set off bombs, hijack airplanes, set fires, and commit other serious crimes. But the goals of terrorists differ from those of ordinary criminals. Most criminals want money or some other form of personal gain. But most terrorists commit crimes to support political causes.
সন্ত্রাসবাদ হলো ভয় বা আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সহিংসতার প্রয়োগ বা প্রয়োগের হুমকি দেয়া।
সন্ত্রাসীরা মানুষ খুন বা অপহরণ করে, বোমা নিক্ষেপ করে, বিমান-ছিনতাই করে, অগ্নিসংযোগ করে অথবা এ ধরনের মারাত্মক অপরাধ সংঘঠন করে থাকে। কিন্তু সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য সাধারণ অপরাধীদের লক্ষ্য থেকে ভিন্নতর হয়।
সাধারণ অপরাধীরা অর্থ বা অন্যবিধ স্বার্থ হাসিল করতে চায়। বেশীরভাগ সন্ত্রাসী তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যেই অপরাধ ঘটিয়ে থাকে।
Most terrorist groups have a small number of members. They believe the threat or use of violence to create fear is the best way to gain publicity and support for their causes.
Common victims of terrorist kidnappings and assassinations include diplomats, business executives, political leaders, judges and police.
Terrorists simply choose any target certain to attract newspaper or TV coverage. They often threaten to kill the hostages if their demands are not met. Bombings make up about half of all terrorist acts.
Most terrorist groups fail to achieve their long range political goals.
বেশীরভাগ সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সদস্যসংখ্যা কমই হয়ে থাকে। তারা বিশ্বাস করে সহিংসতার হুমকি বা প্রয়োগ যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তাই তাদের প্রচার এবং তাদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য সবচেয়ে উত্তম পন্থা।
সাধারণত সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা অপহৃত ও নিহতদের মধ্যে রয়েছে কূটনীতিবিদগণ, ব্যবসায়ীবৃন্দ, কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিচারপতিবৃন্দ ও পুলিশ।
সন্ত্রাসীরা সংবাদপত্র বা টিভিতে প্রচার পাওয়ার উদ্দেশ্যে যে কোন টার্গেট বেছে নিয়ে থাকে।
তাদের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে তারা প্রায়শঃই তাদের হাতে আটককৃতদের হত্যার হুমকি দিয়ে থাকে।
সন্ত্রাসী কার্যকলাপের প্রায় অর্ধেকই বোমা নিক্ষেপ এর ঘটনা হয়ে থাকে।
অধিকাংশ সন্ত্রাসী গ্রুপ তাদের সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যর্থই হয়ে থাকে।
Terrorism may cross national boundaries. A quarrel in one nation may produce terrorist attacks in several other countries.
Some governments secretly support certain terrorist groups by providing weapons, training and money for attacks in other countries. *
সন্ত্রাসবাদ জাতীয় সীমানা অতিক্রম করতে পারে। একটি জাতির বিবাদ অন্যান্য দেশের ভিতরেও আক্রমণের জন্ম দিতে পারে।
কোন কোন সরকার সংগোপনে কিছু সংখ্যক সন্ত্রাসী গ্রুপকে অন্য দেশের মধ্যে আক্রমণের জন্য অস্ত্রশস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং অর্থ দিয়ে সাহায্য করে থাকে।
উপরোল্লিখিত সংজ্ঞার সাথে আমরা সন্ত্রাসবাদের ইতিহাস সম্পর্কে উক্ত এনসাইক্লোপিডিয়ায় যা কিছু উল্লেখ করা হয়েছে তাও মিলিয়ে দেখতে চাই:
History of Terrorism
The word terrorism first appeared during the French Revolution (1789-1799). Some of the revolutionaries who seized power in France adopted a policy of violence against their enemies.
An American group, the Ku Klux Klan used violence to terrorize blacks and their sympathizers in 1865 and during 1900’s. In 1930’s the dictators Adolf Hitler of Germany, Benito Mussolini of Italy and Joseph Stalin of Soviet Union used terrorism to discourage opposition to their governments. **
সন্ত্রাসবাদ প্রথমে ১৭৮৯-১৭৯৯ এ ফ্রান্সের বিপ্লবের সময় দেখা দেয়। ঐ সময় যারা ক্ষমতা দখল করেছিল সে বিপ্লবীদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার নীতি অবলম্বন করে।
একটি আমেরিকান গ্রুপ, ‘কু-ক্লাঙ্ ক্ল্যান’ ১৮৬৫ এবং বিংশ শতাব্দীতে সহিংসতা অবলম্বন করে কালোদের এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীলদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করার লক্ষ্যে। ১৯৩০ সালের দিকে জার্মানীতে স্বৈরশাসক হিটলার এবং ইটালীতে মুসোলিনী এবং রাশিয়ায় স্ট্যালিন সরকার বিরোধীদের নিরুৎসাহিত করার জন্যে সহিংসতা প্রয়োগ করে।
Another wave of terrorism began during the 1960’s. Terrorist groups that surfaced included the Red Brigades in Italy and the Red Army Faction in West Germany. Before the independence of Israel in 1948, a Jewish group used terror to speed the end of the British rule in Palestine and create a Jewish homeland.
Since 1960’s various Palestinian groups carried out campaign of terrorism aimed at…….the establishment of an independent Palestinian state.
The provisional Irish Republican Army, established in 1970 used violence in its fight to rid Northern Ireland of British rule.
A Puertorican Nationalist group called FALN Committed numerous bombings in US during 1970’s.*
আরো একটি সন্ত্রাসবাদের ঢেউ ১৯৬০ সালের দিকে শুরু হয়। যেসকল সন্ত্রাসবাদী গ্রুপে আবির্ভাব হয় তার মধ্যে ইটালীর ‘রেড ব্রিগেড’ এবং জার্মানীর রেড আর্মী অন্যতম। ১৯৪৮ সালে ইসরাইলের জন্ম লাভের পূর্বে একটি ইহুদী গ্রুপ সন্ত্রাসকে ব্যবহার করে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ইহুদী রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে।
১৯৬০ সাল থেকে বিভিন্ন ফিলিস্তিনি গ্রুপ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র লাভের উদ্দেশ্যেই সহিংস আন্দোলন চালিয়ে আসছে।
১৯৭০ সালে গঠিত ‘আইরিশ রিপাবলিকান আর্মী’ সহিংসতার পথ অবলম্বন করে উত্তর আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের লক্ষ্যে।
১৯৭০ সালের দিকে একটি পূর্টোরিকান জাতীয়তাবাদী গ্রুপ এফ এ এল এন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেকগুলো বোমা বর্ষণের ঘটনা ঘটায়।
ওয়ার্ল্ড বুক এনসাইক্লোপিডিয়ায় সন্ত্রাসবাদের যে ইতিহাস উল্লেখিত হয়েছে তার মধ্যে মুসলিম দেশ হিসেবে শুধু ফিলিস্তিনের কথাই আলোচনায় এসেছে। এখানে আমরা দুটো বিষয় আলোচনা করতে চাই।
এক.
ফিলিস্তিনের ভূমি-সন্তান ফিলিস্তিনীরাই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের শিকার হয়ে নিজের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছে। তারা সন্ত্রাস করেনি বরং সন্ত্রাসের শিকারে পরিণত হয়েছে। তারা নিজ জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে পার্শ্ববর্তী আরব রাষ্ট্রসমূহে আশ্রয় নিতে ও উদ্বাস্তু শিবিরে বছরের পর বছর বসবাস করতে বাধ্য হয়েছে। ১৯৪৮ সন থেকে ‘৭৩ সন পর্যন্ত আরব ইসরাইল যুদ্ধে রাষ্ট্র হিসেবে মিসর, সিরিয়া ও জর্দানই ইসরাইলের প্রতিপক্ষের ভূমিকা পালন করেছে।
ফিলিস্তিনীরা নিজেদের জন্মভূমি উদ্ধারের ও জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তনের জন্যে এক পর্যায়ে গেরিলা যুদ্ধের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। এটা সকল বিচারে স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে আর স্বাধীনতা সংগ্রামকে কোন বিচারেই সন্ত্রাসী কার্যকলাপ রূপে চিত্রিত করা সকল ন্যায়-নীতির পরিপন্থী। তাই ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতা সংগ্রামকেও সন্ত্রাসবাদ হিসেবে চিত্রিত করা যায় না।
দুই .
ফিলিস্তিনীদের মুক্তি সংগ্রামকে পুরোপুরি ইসলামের সাথে যুক্ত করাও ন্যায় বিচারের ধোপে টিকে না। বর্তমানে হামাসের কার্যক্রমকে ইসলামের সাথে যুক্ত করা ছাড়া আর কোন গ্রুপের কাজকে এ বিবেচনায় আনা যায় কিনা তা বিচার্য বিষয়।
ষাটের দশকে ফিলিস্তিনীদের মুক্তি সংগ্রামে শরীক গ্রুপগুলোর মধ্যে প্রধান গ্রুপটি ছিল আল-ফাতাহ। তাদের আদর্শ আরব জাতীয়তাবাদ ও ফিলিস্তিনে সব ধর্মের লোকদের নিয়ে একটি স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র গঠনের অতিরিক্ত কিছু ছিল না। অপর একটি গ্রুপ আস-সায়েকা বামধারা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল।
অপর যে গ্রুপটি অধিকতর উগ্র হিসেবে বিবেচিত ছিল সেটির নাম ছিল পপুলার ফ্রণ্ট- যার নেতৃত্বে ছিল উগ্র বামপন্থী খ্রিস্টান নেতা জর্জ হাবাস। এই গ্রুপেরই পলিট ব্যুরোর সদস্য লায়লা খালেদ উড়োজাহাজ হাইজ্যাক করে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। এই কাজটিকে সন্ত্রাসের পর্যায়ে অবশ্যই ফেলা যায়। কিন্তু এর জন্যে ইসলাম বা কোন ইসলামী গ্রুপকে দায়ী করা যায় না।
হামাস পরবর্তী পর্যায়ে ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে প্রতিরোধ আন্দোলনের ডাক দিয়ে জনসমর্থন পুষ্ট হয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। পশ্চিমা জগতের কাছে ফাতাহ গ্রুপ গ্রহণযোগ্য। অথচ গেরিলা যুদ্ধে ফিলিস্তিনীদের প্রধান প্রতিষ্ঠান ছিল এই ফাতাহ গ্রুপ। পক্ষান্তরে হামাস ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে প্রতিরোধ আন্দোলনের পাশাপাশি বহির্বিশ্বে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে সহানুভূতি অর্জনের প্রয়াস চালিয়েও তারা সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রিত এবং পাশ্চাত্যের কাছে অগ্রহণযোগ্য কেন, বিশ্ব বিবেকের কাছে প্রশ্ন।
আমাদের উপমহাদেশে বৃটিশদের ঔপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা করেছেন হযরতে উলামায়ে কিরাম। তারা এই স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার অগ্রসৈনিক হিসেবে তদানিন্তন বৃটিশ ভারতে অকথ্য জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের একটি অংশকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে নির্বাসিত করা হয়েছে- কিন্তু তারা তাদের সংগ্রামকে নিয়মতান্ত্রিকভাবেই পরিচালনা করেছেন। কখনও কোন অবস্থায় সন্ত্রাসের পথে যাননি।
সকলের জানা কথা, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক পর্যায়ে সূর্যসেনের নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি অস্ত্র লুটসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হাতে নেয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে জোরদার করার লক্ষ্যে। ইতিহাস সাক্ষী সূর্য সেনের ঐ গ্রুপের সাথে এ দেশের আলেম-উলামা বা ইসলামী ব্যক্তিদের কোন সম্পর্ক ছিল না। আজ পর্যন্ত ইসলামী রাজনীতির সাথে যারা জড়িত তাদের মধ্যে সূর্য সেনের কোন সমর্থক খুঁজে পাওয়ার সুযোগ নেই। এরপরও একশ্রেণীর পত্রপত্রিকা সন্ত্রাসের সাথে ইসলামী দল ও প্রতিষ্ঠানগুলোকেই গায়ের জোরে তথ্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের সাথে জড়িত করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছে।
বিশেষ করে নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতি সর্বোপরি ইসলামী নীতি নৈতিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে তারা বিশেষভাবে টার্গেট করেছে। অথচ জন্মলগ্ন থেকেই জামায়াতে ইসলামী কঠোরভাবে যে কর্মনীতি অনুসরণ করে আসছে তার সাথে সন্ত্রাসের কোন দূরতম সম্পর্কও নেই। আমরা এ সম্পর্কে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র থেকে এর স্থায়ী কর্মনীতি হুবহু উদ্ধৃত করছি।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এর গঠনতন্ত্রের ধারা-৪-এ উল্লিখিত হয়েছে “জামায়াতের স্থায়ী কর্মনীতি নিম্নরূপ হইবে :
১. কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিংবা কোন কর্মপন্থা গ্রহণের সময় জামায়াত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শুধুমাত্র আল্লাহ ও তাঁহার রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নির্দেশ ও বিধানের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করিবে।
২. উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হাসিলের জন্য জামায়াতে ইসলামী এমন কোন উপায় ও পন্থা অবলম্বন করিবেনা যাহা সততা ও বিশ্বাসপরায়ণতার পরিপন্থি কিংবা যাহার ফলে দুনিয়ায় ফিতনা ও ফাসাদ (বিপর্যয়) সৃষ্টি হয়।
৩. জামায়াত উহার বাঞ্ছিত সংশোধন ও বিপ্লব কার্যকর করিবার জন্য নিয়মতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করিবে। অর্থাৎ দাওয়াত সম্প্রসারণ এবং সংগঠন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লোকদের মন-মগজ ও চরিত্রের সংশোধন এবং জামায়াতের অনুকূলে জনমত গঠন করিবে।”
জামায়াতে ইসলামী ঘোষিত এই স্থায়ী কর্মনীতি কেবলমাত্র গঠনতন্ত্রের পাতায়ই সীমাবদ্ধ নয় বরং শুরু থেকে আজ পর্যন্ত জামায়াতের যাবতীয় কার্যক্রম এই নীতির ভিত্তিতেই পরিচালিত হয়ে আসছে।
জামায়াতে ইসলামীর সাথে সংশ্লিষ্ট কোন সদস্য অথবা কোন পর্যায়ের সংগঠন এ নীতি লংঘন করলে জামায়াত তা সংশোধনের জন্যে গঠনতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিতে কখনই পিছপা হয়নি।
গঠনতন্ত্রে উল্লিখিত এই কর্মনীতির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর (রহ:) পবিত্র মক্কায় পবিত্র হজ্জ উপলক্ষে আগত ইসলামী দুনিয়ার নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণের একটি অংশের উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করতে চাই। উক্ত বক্তব্যটি মাওলানা মওদূদী (র.) আরবী ভাষায় প্রদান করেন ১৯৬৩ সালের জুন মাস মোতাবেক ১৬ জিলহাজ্জ ১৩৮২ হিজরীতে। বক্তব্যের শিরোনাম ছিল “ইসলামী বিশ্বে ইসলামী আন্দোলন সমূহের জন্যে কর্মপন্থা।” খুবই গুরুত্বপূর্ণ, অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ এই বক্তব্যের মাধ্যমে মাওলানা মুসলিম বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত অথচ বস্তুনিষ্ঠ ও পুঙ্ক্ষানুপুঙ্ক্ষ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের পর দিক নির্দেশনামূলক ৭টি মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করেন। এর সর্বশেষ বা ৭ম পরামর্শের মূল কথা ছিল ইসলামী আন্দোলনের জন্যে কোন গোপন তৎপরতা এবং সশস্ত্র বিপ্লবের ধ্যান-ধারণা এবং কার্যক্রম অবলম্বন করা যাবে না। বরং অত্যন্ত কঠোরভাবে এগুলো থেকে আন্দোলন ও সংগঠনকে মুক্ত রাখতে হবে। উল্লেখ্য যে ৬ষ্ঠতম পরামর্শে মাওলানা ছবর এবং হিকমত অবলম্বনের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আর আন্দোলনের কোন পর্যায়ে গোপন তৎপরতা অথবা সশস্ত্র কর্মপন্থা গ্রহণ করাকে তিনি অভিহিত করেছেন ছবরের পরিপন্থি হিসাবে। তাঁর ভাষায় এই ধরনের কর্মপন্থার পরিণতি ইসলামী আন্দোলনের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকর। একটি সঠিক বিপ্লব সবসময় কেবলমাত্র জন সমর্থনের ভিত্তিতেই সংঘঠিত হয়ে থাকে।
মাওলানা এই ক্ষতিকর কর্মপন্থা পরিহার করে সমবেত ইসলামী নেতৃবৃন্দকে বলেন, “মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত ব্যাপকভাবে তুলে ধরুন। ব্যাপকভাবে মানুষের চিন্তাধারায়, মনমানসিকতায় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করুন। মানুষকে উন্নত আমল আখলাকে সজ্জিত করে তাদের হৃদয় জয় করুন। এই প্রচেষ্টায় বাধা প্রতিবন্ধকতা এলে সাহসের সাথে তার মুকাবিলা করুন। পর্যায়ক্রমে এই কর্মকৌশলের ফলে যে বিপ্লব সাধিত হবে তাই হবে স্থায়ী এবং সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত- যাকে প্রতিপক্ষের গৃহীত হাওয়াই-তুফান মিটাতে সক্ষম হবে না। দ্রুত সাফল্যের জন্যে তড়িঘড়িভাবে গৃহীত কোন পদক্ষেপের মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে কোন বিপ্লব সংঘটিত যদি হয়েও যায় তা কখনও স্থায়ী হতে পারে না। বরং সেটা যেভাবে আসবে সেভাবেই বিদায় নেবে।”
জামায়াতে ইসলামী তার গঠনতন্ত্রে উল্লিখিত কর্মনীতি যেমন কঠোরভাবে অনুসরণ করে আসছে তেমনি এর প্রতিষ্ঠাতার দিক নির্দেশনার আলোকেই এযাবৎকাল নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক কর্মপন্থা ও কর্মকৌশল অবলম্বন করে আসছে অত্যন্ত নিষ্ঠা ও কঠোরতার সাথে। এরপরও যারা যেন তেন প্রকারে গায়ের জোরে জামায়াতকে সন্ত্রাসবাদের সাথে জড়িত করতে চায় এরা হয় জ্ঞানপাপী না হয় নিরেট অজ্ঞ। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ সংশয়ের অবকাশ নেই।”