দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি চট্টগ্রাম বন্দর। এ বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের ৮০ ভাগ পরিচালিত হয়। তবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও আওয়ামী লীগের নেতারা এখনও চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনা করছে। এতে বন্দর ঘিরে যেকোনো সময় অস্থিরতা তৈরি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও তাদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। ফ্যাসিস্ট এ দলটির নেতা-কর্মীরা বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এবং বিতর্কিত করতে নানা ষড়যন্ত্র করছে। দেশের অর্থনীতিতে অস্থিরতা তৈরির জন্য চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় জড়িত আওয়ামী লীগের নেতারা যে কোনো সময় বন্দরে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। এ জন্য যত দ্রুত সম্ভব দেশবিরোধী এসব লোককে বন্দর পরিচালনা থেকে অপসারণ করা দরকার বলে তারা মনে করছেন।
তথ্যে দেখা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয় ৩টি টার্মিনালের ১২টি জেটির মাধ্যমে। সবচেয়ে বড় ও সরঞ্জামসমৃদ্ধ টার্মিনাল নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল এনসিটি। এনসিটির ৪টি এবং চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনালের সিসিটির দুটি জেটির নিয়ন্ত্রণ সাইফ পাওয়ার টেকের হাতে। দেড় দশক এ ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় ৭টি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে বন্দরের কনটেইনার ওঠানো-নামানোর ব্যবসা। প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনোটিতে আওয়ামী লীগ নেতা অথবা তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানা রয়েছে। আবার কোনোটির মালিক আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী। ৭ প্রতিষ্ঠানের একটি সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন সাবেক নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, নূর-ই-আলম চৌধুরী ও স্থানীয় এম এ লতিফ এমপির ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সাইফ পাওয়ারটেকের ৬টি জেটির মাধ্যমে বন্দরের ৬৫ শতাংশ কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় এম এইচ চৌধুরী লিমিটেড ও বশির আহমেদ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় রয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা আজম নাছির উদ্দীন। এভারেস্ট পোর্ট সার্ভিসেস লিমিটেড নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানে মালিকানা ছিল আজম নাছির উদ্দীন এবং পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা আলাউদ্দিন নাসিমের।
এ দিকে চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় নোয়াখালীর সাবেক সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর মালিকানা রয়েছে এ অ্যান্ড জে ট্রেডার্সে। ফজলীসন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে ইকরাম চৌধুরী। এফকিউ খান অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: আবু শরীফ। তাদেরও রয়েছে আওয়ামী লীগের সাথে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা।
চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় কনটেইনার ওঠানো-নামানোর বিনিময়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বন্দর থেকে অর্থ পায়। এই টাকার পরিমাণ কত হবে, তা দরপত্রের মাধ্যমে ঠিক হওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত প্রতিযোগিতা হলে কনটেইনার ব্যবস্থাপনার ব্যয় অনেক কমে আসার সুযোগ তৈরি হতো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন কনটেইনার ওঠানো-নামানোর ব্যবসায় বিনিয়োগ কম, নিশ্চিত মুনাফা বেশি। আগের সরকার ঘনিষ্ঠরা বেশি টাকায় কাজ নিয়েছেন। যার অর্থমূল্য দুই হাজার কোটি টাকার বেশি। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অন্য কাউকে সেখানে ঢুকতে দেয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ব্যবসায়ী নেতারা।
এ দিকে বন্দরে কারো একক আধিপত্য চায় না পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। সংস্কারের মাধ্যমে একাধিক অপারেটর নিয়োগ করা হলে পরিচালনা ব্যয় কমে আসবে বলে দাবি করেন বিজিএমইএ নেতা এস এম আবু তৈয়ব।
চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশন কাজে এখন অন্য কারো ঢুকার সুযোগ নেই জানিয়ে সিন্ডিকেট ভেঙে প্রতিযোগিতামূলক করলে অপারেশন খরচ কমবে বলছেন বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ।
এ দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বন্দর পরিদর্শনে গিয়ে সাম্প্রতিক সাংবাদিকদের বলেন, বন্দরে অনেক অনিয়ম হয়েছে। অনেক লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। সবই নজরে আছে। বন্দরে এখন থেকে সব দরপত্র উন্মুক্ত পদ্ধতিতে হবে বলে তিনি জানান।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনে স্বচ্ছতা আনার সুযোগ তৈরি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। বন্দরকে সিন্ডিকেট ও দুর্নীতিমুক্ত করতে হাজার কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা দরকার বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তারা বলছেন টানা ১৭ বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ওঠানো-নামানোর ব্যবসা সাত প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে। প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনোটিতে আওয়ামী লীগ নেতা অথবা তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানা রয়েছে। আবার কোনোটির মালিক আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী।
কখনো এসব প্রতিষ্ঠান ‘নামকাওয়াস্তে’ ডাকা দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে। কখনো সরাসরি দরপত্র পদ্ধতিতে এই সাত প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হয়েছে। কার্যত প্রতিযোগিতা না হওয়ায় বন্দরে কনটেইনার ব্যবস্থাপনায় ব্যয় বেশি হয়েছে। বাড়তি ব্যয় পণ্যের দামের ওপর সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আদায় করেছেন ব্যবসায়ীরা। তথ্যে দেখা যায় সাইফ পাওয়ারটেকের হাতে যে ছয়টি জেটি রয়েছে, সেগুলোর মাধ্যমেই বন্দরের ৬৫ শতাংশ কনটেইনার ওঠানো-নামানো হয়। ২০০৬ সালে বন্দরে গ্যান্ট্রি ক্রেন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজের হাতেখড়ি হয় সাইফ পাওয়ারটেকের। আওয়ামী লীগ আমলেই সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, সংসদীয় কমিটি ও বন্দর কর্মকর্তারা কিভাবে সাইফ পাওয়ারটেককে বন্দরের কাজ পেতে সহযোগিতা করতেন, তার বড় উদাহরণ নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা সংক্রান্ত দরপত্র। বাংলাদেশে প্রথম বন্দরকেন্দ্রিক বিদেশী বিনিয়োগ হওয়ার কথা ছিল এই নিউমুরিং টার্মিনালে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সে কাজ গুছিয়ে এনেছিল। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নূর-ই-আলম চৌধুরী ও নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের হস্তক্ষেপে দরপত্র প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। টার্মিনালটি চালু করতে লেগে যায় আরও ছয় বছর। ২০১৫ সালে টার্মিনালটির চার জেটিকে দুই প্যাকেজে ভাগ করে দরপত্র আহ্বান করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। দরপত্রের শর্ত এমনভাবে দেয়া হয়েছিল, যাতে সাইফ পাওয়ারটেক ছাড়া আর কেউ যোগ্য নির্বাচিত না হয়।
এ দিকে সাইফ পাওয়ারটেকের কর্মকর্তারা বলছেন তারা যোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে দরপত্রের মাধ্যমে অনেক কাজ পেয়েছেন। সরাসরি ক্রয়পদ্ধতিতে দেয়া কাজ তারা করতে চান না। তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে বন্দরকে আমরা চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি, যাতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করা হয়।’
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে জেনারেল কার্গো বার্থের ছয়টি কনটেইনার জেটিতে একটি করে অপারেটর ও দুটি করে সহ-অপারেটর নিয়োগ দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দরপত্র আহ্বান করা হলে সহ-অপারেটররা আর জেটি পরিচালনার সুযোগ পায়নি। সেই থেকে ছয়টি জেটিতে ছয়টি প্রতিষ্ঠান কাজ করে আসছে। প্রতিবার দরপত্রে সবাই এমনভাবে দর দিচ্ছে, যাতে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের দরের খুব বেশি পার্থক্য থাকে না। প্রাক্কলিত দরের সঙ্গেও ব্যবধান বেশি থাকে না।
তথ্যে দেখা যায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে ৩১ লাখ ৬৮ হাজার ৬৯০ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে ৩০ লাখ ৯৭ হাজার ২৬৩ টিইইউএস (২০ ফুটের একক) কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। এতে এক বছরের ব্যবধানে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের প্রবৃদ্ধি ৫.৩৬ শতাংশ বেড়েছে।
বিদায়ী (২০২৩-২০২৪) অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিংও বেড়েছে। এ বছর কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে ১২ কোটি ৩২ লাখ ৪২ হাজার ৭৪৮ টন। আগের বছর যা ছিল ১১ কোটি ৮২ লাখ ৯৭ হাজার ৬৪৩ টন। অর্থাৎ এই বছর বন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে ৪.১৮ শতাংশ বেড়েছে।