অভিনব কায়দায় গ্যাস চুরির ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। চুরি ধরা পড়লে বড়জোর জরিমানা আদায় করে দায় সারছে সংশ্লিষ্টরা। গ্যাস চুরির দায়ে বড় ধরনের কোন সাজার ঘটনা ঘটেনি। ফলে থেমে নেই গ্যাস চুরির ঘটনা। বিশেষ করে শিল্প কারখানা ও ক্যাপটিভ পাওয়ারে বাইপাস করে গ্যাস চুরির ঘটনা ঘটেই চলছে। একদিকে দীর্ঘ দিন ধরে নুতন গ্যাস সংযোগ দেয়া বন্ধ অন্য দিকে অহরহ গ্যাস চুরি ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রাহকরা।
বাংলাদেশে তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) সূত্রে জানা যায়, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ)। এর মধ্যে ৩০০০ এমএমসিএফ সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রতি নিয়ত বাড়ছে, কমছে উৎপাদন। বর্তমান দৈনিক উৎপাদন হচ্ছে ১৯৬০ এমএমসিএফ। আর কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে এলএনজি (তরলীকৃত প্রকৃতিক গ্যাস) থেকে সরবরাহ সক্ষমতা ১১০০ এমএমসিএফ। এখন সরবরাহ হচ্ছে ৮২০ এমএমসিএফ। এতে দিনে এখন গ্যাস সরবরাহ নেমে এসেছে ২৭৮০ এমএমসিএফ।
ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় জালের মত ছড়িয়ে আছে অবৈধ গ্যাস সংযোগ। আবাসিক ভবনের উপর তলা থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, শিল্প কারখানা এমনকি ক্যাপটিভ পাওয়ারেও এর বিস্তৃতি। অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ সংযোগ বিছিন্নকরণ এবং জরিমানা অব্যাহত রেখেছে তিতাস গ্যাস কোম্পানি। নকশা বহির্ভূত এলাকা থেকে হাজার হাজার ফুট পাইপ লাইনও তুলে ফেলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো স্থানীয়দের বাধার মুখেও পড়তে হচ্ছে।
তবে অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালী গ্রাহকদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে শিল্প কারখানা ও ক্যাপটিভ পাওয়ারে যারা বাইপাস (মিটার বহির্ভূত পার্শ্বসংযোগ) করে অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার করছেন তাদের বেলায় অনেকটাই নমনীয় এই কোম্পানি। অনেক সময় সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও জরিমানা করা হলেও তা আদায়ে জোরালো ভূমিকা নেওয়া হচ্ছে না। আরও অভিযোগ, বড় অঙ্কের জরিমানা করার পর নেগোশিয়েশনের (আলোচনা) মাধ্যমে তাদের জরিমানা মাফ করে কিংবা হ্রাস করে পুনরায় সংযোগ দেওয়া হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাইপাস ধরা পড়েছে, এমন বড় বড় প্রতিষ্ঠানও আছে। হয়েছে কী? লাইন কাটা হয়েছে, জরিমানা হয়েছে। কেউ দিয়েছে, আবার কেউ নানা উপায়ে পার পেয়ে গেছে.. উপর থেকে ফোন এসেছে। কিছু করা যায়নি। তিনি বলেন, ‘গ্যাস চুরির দায়ে বড় ধরনের সাজা তো হয়নি। জেল হয়েছে কারো? কোন মালিক কারাগারে সাজা ভোগ করছেন এমনটা কি আমরা দেখেছি?’
রাষ্ট্রীয় ৬টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। দেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ গ্যাস বিতরণ করা হয় তার প্রায় ৫৫ শতাংশ বিতরণ করে তিতাস গ্যাস কোম্পানি। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নরসিংদী, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলায় গ্যাস বিতরণ করে এই কোম্পানি।
২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ি, তিতাসের মোট গ্রাহক সংখ্যা ২৮ লাখ ৭৮ হাজার ৭৫৭। এরমধ্যে, আবাসিক গ্রাহকের সংখ্যা ২৮ লাখ ৫৩ হাজার ৫৩। বাকী যেসব সংযোগ রয়েছে তারমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে ৫৬টি, সার কারখানা ২টি, শিল্প সংযোগ ৫৪২৯টি, ক্যাপটিভ পাওয়ার ১৭৫৫টি, সিএনজি ফিলিং স্টেশন ৩৯৬টি, বাণিজ্যিক সংযোগ রয়েছে ১২ হাজার ৭৮টি।
কোম্পানির তথ্য এবং স্থানীয় সূত্র অনুযায়ি, তিতাসের আওতাভুক্ত এলাকায় হাজার হাজার আবাসিক এবং শত শত বাণিজ্যিক ও শিল্প সংযোগ রয়েছে অবৈধ। ফলে তিতাসের সিস্টেম লসের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশ।
প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাস ক্রয়ের পর তা গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করে তিতাস গ্যাস কোম্পানি। ক্রয়-বিক্রয়ের যে পার্থক্য হয় তা সিস্টেম লস হিসেবে দেখায় কোম্পানিটি।
পেট্রোবাংলার সাবেক এক পরিচালক বলেন, ‘তিতাস গ্যাস একটি বড় কোম্পানি। এর ডিস্ট্রিবিউশন লাইন পুরোনো। এতে সিস্টেম লস হবে। কারিগরি কিছু কারণেও লস হয়। এরপরও, সবমিলিয়ে সিস্টেম লস ২ শতাংশের বেশী হওয়ার কথা নয়।’
তিতাস গ্যাস কোম্পানির হিসাব বিভাগের সূত্র অনুযায়ী, ৭ শতাংশ সিস্টেম লস মানে হলো প্রতি মাসে ১৫০ থেকে ১৮০ কোটি টাকা লোকসান। যা বছরে দাঁড়ায় ১৮০০ কোটি থেকে ২১৬০ কোটি টাকা।
তিতাসের সঙ্গে অন্য পাঁচটি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির সিস্টেম লসের আর্থিক মূল্য যুক্ত করলে তা মোট বছরে ৩০০০ কোটি টাকা দাঁড়াবে বলে জানান সাবেক এই কর্মকর্তা।
অবৈধ সংযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ পারভেজ সাংবাদিকদের বলেন, অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদে অভিযান চলমান আছে।তিনি জানান, তিনি দায়িত্ব পেয়েছেন দেড় মাসের কিছু বেশী সময় হয়েছে। এরমধ্যে বেশকিছু অভিযান তিনি পরিচালনা করেছেন।
জানা গেছে, , ‘গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ৪৫ দিনে তিতাস গ্যাসের আওতাধীন এলাকায় ৫ হাজার ২৯৪টি অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এর মধ্যে আবাসিকে অবৈধ সংযোগ ছিল ৫ হাজার ১৭০টি। বাণিজ্যিকে ৪৬টি আর শিল্পে ৭৮টি। এ সময় ২৯ কিমি পাইপলাইন অপসারণ করা হয়। এর ফলে দিনে ৪১ লাখ ৩৭ হাজার ৫৩ ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় হয়। এ সময়ে দৈনিক ২০ লাখ ১৫ হাজার টাকার গ্যাস সাশ্রয় হয়।’ গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীতে অভিযান চলছে।
পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, গত বছর (২০২৩ সাল) দেশে অবৈধ গ্যাস-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য মোট ১৮৬টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসব অভিযানে মোট ২ লাখ ১৯ হাজার ২৬৫টি চুলা এবং ৭টি শিল্পগ্রাহকের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এর ফলে দিনে প্রায় ২ কোটি টাকার গ্যাস সাশ্রয় করা হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৯৫টি অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় সোয়া লাখ চুলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। শিল্প খাতের ৭৪টি অবৈধ গ্যাস-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এর ফলে দৈনিক ১ কোটি ৪১ লাখ টাকার গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে। অভিযানে বিচ্ছিন্ন করা সংযোগ কত দিন বিচ্ছিন্ন থাকবে, তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেনা তিতাস কোম্পানি। পূর্বে দেখা গেছে, বিচ্ছিন্ন করার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আবার সংযোগগুলো পুনঃস্থাপিত করে নেওয়া হয়। এভাবেই চলতে থাকে অভিযানে লাইন কাটা আবার সংযোগ নেওয়ার খেলা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, ‘দেশে গ্যাসের তীব্র সংকট চলছে। জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, আমাদের ৪ হাজার এমসি গ্যাস দরকার। সেখানে আমরা ৩ হাজার এমসি গ্যাস পাচ্ছি।‘প্রয়োজনে আমাদের গ্যাস আমদানি করতে হচ্ছে।
এ জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় হয়। এই মুহূর্তে বাসাবাড়িতে গ্যাস দেওয়ার হবে, আমাদের জন্য এটি একটি মিথ্যা আশ্বাস।’বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, তবে ভবিষ্যতে গ্যাস সরবরাহ বাড়লে, তখন এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হবে।
তিনি জানান, বিবিয়ানার পরে এখনো দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ গ্যাসের কোনো কূপে পাওয়া যায়নি।