মানবাধিকার বিষয় নিয়ে কথা বলার কথা বলে অফিস খোলা হলেও পরবর্তীতে অন্যন্য এডেন্ডা বাস্তবায়নের শঙ্কায় সংশ্লিষ্টরা। তাদের যুক্তি ১৯৯৩ সালে জেনেভায় অফিস অব দ্য ইউনাইটেড ন্যাশন্স হাই কমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর)-এর কার্যক্রম শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৭টি দেশে ওএইচসিএইচআর কান্ট্রি অফিস খুলতে পেরেছে।
ব্যাংককসহ কিছু জায়গায় লিমিটেড স্কেলে তাদের রিজিওনাল অফিস রয়েছে। কান্ট্রি অফিস রয়েছে এমন দেশ হলো- বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, চাদ, গুয়েতেমালা, গায়েনা, হন্ডুরাস, লাইবেরিয়া, মৌরিতানিয়া, মেঙিকো, নাইজার, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, সুদান, তিউনিসিয়া এবং ইয়েমেন। পর্যালোচকরা বলছেন, কোনো না কোনো সংকটে রয়েছে এমন দেশেই ওএইচসিএইচআর কান্ট্রি অফিস খুলতে পেরেছে। গত মাসে ঢাকায় মানবাধিকার অফিস খোলার প্রস্তাব আসে। অবিশ্বাস্য দ্রততায় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তির খসড়া পাঠায় জেনেভা।
প্রস্তাবে বলা হয়, সবকিছু ঠিক থাকলে অক্টোবরে ভলকার তুর্কের সফরে খসড়া চুক্তিটি সই হতে পারে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস চালু হলে সেটি মানবাধিকার সমুন্নত ও বিকাশের স্বার্থে নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করবে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক যে সব সনদ অনুসমর্থন করেছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পূরণে প্রস্তাবিত দপ্তর পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দেবে। আন্তঃসীমান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সুরাহার জন্য জাতিসংঘের প্রস্তাবিত অফিসটি বলপূর্বক গুম বিষয়ক কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহকে কারিগরিসহ নানা রকম সহায়তা দেবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গিকে যুক্ত করার ওপর জোর দেবে। নীতি প্রণয়নে সহায়তার জন্য ওএইচসিএইচআর-এর পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট গবেষণা পরিচালিত হতে পারে। জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী ঢাকায় প্রস্তাবিত ওএইচসিএইচআর অফিস পুলিশ এবং আইন সংস্কারে প্রয়োজনীয় সুপারিশ ও কারিগরি সহায়তাসহ সামগ্রিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় সহায়তা দেবে। সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অফিস খোলার চুক্তির খসড়ায় জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের অবাধে বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া এবং প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কোনো গ্রেপ্তার, আটক এবং জেরা করার প্রক্রিয়ায় ওএইচসিএইচআর প্রতিনিধিদের অবাধে প্রবেশাধিকার দিতে হবে।
কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে ৩৬ জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর থেকে স্বার্থান্বেষী নানা গোষ্ঠী সক্রিয়। ওএইচসিএইচআর-এর প্রস্তাব এসেছে ৫ই আগস্টের এক মাসের মাথায় এবং তা পারসু হচ্ছে নানাদিক থেকে। বাংলাদেশে জাতিগত কোনো সংঘাত হয়নি যে, এখানে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস খুলতে হবে- এমন মন্তব্য করে এক কর্মকর্তা বলেন, সংঘাতপ্রবণ দেশগুলোতে ওএইচসিএইচআর-এর অফিস রয়েছে। তাছাড়া ওই অফিসের বিরুদ্ধে দুনিয়ার দেশে দেশে সমকামিতার মতো সংবেদনশীল বিষয় প্রমোট করার অভিযোগ রয়েছে। সমকামিতা সব ধর্মে নিষিদ্ধ। অফিস খুলে এটি প্রমোশনের সুযোগ দিলে সরকার বাংলাদেশের সর্ব ধর্মের ধর্মভীরু মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়বে। ফলে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টির এমন আশঙ্কাকে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখাটা সমীচীন বলে মনে করছে সেগুনবাগিচা। বলা হয়, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর সব সময় দাতা সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত হয়। দাতা সংস্থাগুলো ওএইচসিএইচআরকে যেকোনো দেশের অভ্যন্তরীণ নীতি প্রণয়নে প্রভাব সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে একটি দেশের কোনো নীতি যখন দাতা দেশগুলোর বিপক্ষে যায়, তখন তারা মানবাধিকারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ওএইচসিএইচআর এর মাধ্যমে। জাতিসংঘে কাজ করছেন এমন একাধিক কূটনীতিক জানান, জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস কখনো কখনো এমন এজেন্ডার বিকাশে কাজ করে থাকে যেগুলো সর্বজনীন নয়। যেমন তারা সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সমন্বিত যৌন শিক্ষার বিকাশে কাজ করে যা অনেক দেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার পরিপন্থি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, কিছু স্পর্শকাতর পশ্চিমা এজেন্ডা বাস্তবায়নে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস কাজ করে। অথচ চুক্তি করা বা অফিস স্থাপনের অনুমতি দেয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে কোনো দেশই ব্যবস্থা নিতে পারে না। এটি করলে উভয় সংকট তৈরি হয়।
রাজনীতিবিদদের উদ্বেগ : রাজনীতিবিদরা জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকার সংষ্কারের মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করবে। কোন স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া তাদের কাজ নয়। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব প্রিন্সিপাল মাওলানা ইউনুছ আহামদ ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস খোলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ১০ বছর চেষ্টা চালিয়ে শ্রীলঙ্কায় মানবাধিকারের কান্ট্রি অফিস খুলতে তারা ব্যর্থ হয়। ৩৬ জুলাই-এর অভ্যুত্থানের পর নানা দেশী-বিদেশী চক্রান্ত সক্রিয়। বাংলাদেশে জাতিগত কোন সংঘাত হয়নি যে, জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস খুলতে হবে। তাছাড়া ঐ অফিসের বিরুদ্ধে দেশে দেশে সমকামীতার প্রমোট করার অভিযোগ রয়েছে। সভায় ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে সমকামীতার প্রমোট করার মত জঘন্য ও আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়।
বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী বলেছেন, মানবাধিকার রক্ষার নামে কিছু সা¤্রাজ্যবাদী দেশ ও তাদের সহযোগীরা দেশে দেশে ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতার মত সভ্যতাবিরোধী, অশ্লীল মতবাদ প্রচার-প্রসার ও চাপিয়ে দেয়ার মত জঘন্য অপতৎপরতায় লিপ্ত। উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঋণ, উন্নয়ন সহযোগিতা, কারিগরি সহযোগিতা ইত্যাদির ফাঁদে আটকে ফেলে তারা তাদের এসব হীন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে থাকে। বাংলাদেশের জনগণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নামে বিদেশী শক্তিগুলোর এই হীন এজেন্ডা বাস্তবায়ন কখনোই মেনে নিবে না। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১১টায় কামরাঙ্গীরচস্থ মারকাজুল খেলাফত জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়ায় খেলাফত আন্দোলনের এক বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমীর মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, সাংগঠনিক সম্পাদক মুফতী সুলতান মহিউদ্দীন, প্রচার সম্পাদক মাওলানা সাইফুল ইসলাম সুনামগঞ্জী প্রমুখ।
বৈঠকে মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী আরও বলেন, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোন জাতিগত সহিংসতা ঘটেনি। ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে বিগত সরকারের গুম-খুনের সংস্কৃতিরও অবসান হয়েছে বলে আমরা মনে করি। এমতাবস্থায় পৃথিবীর মাত্র ১৯টি দেশে অফিস স্থাপন করা জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের ২০তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে অফিস স্থাপন করার কোন যৌক্তিকতা আছে বলে আমরা মনে করি না। তিনি বলেন, জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন যদি প্রকৃত অর্থেই মানবাধিকার রক্ষা করতে চায় তাহলে তাদের উচিত হবে নিজভুমিতে পরাধীন ফিলিস্তিনের জনগণের উপর দশকের পর দশক ধরে চলে আসা দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ হাতে নেয়া। স্বাধীন বাংলাদেশে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সার্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রক্ষায় এদেশের জনগণই যথেষ্ট।