সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও দুবাইয়ে বিপুল অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠেছে। তার নেতৃত্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ঘুষবাণিজ্যের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন এসব দেশে। এ ছাড়া দুবাইয়ে স্বর্ণের ব্যবসায় রয়েছে অর্থলগ্নি।
পাশাপাশি কামালসহ তার পরিবারের ৩২০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদেরও প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গড়ে ওঠা দুর্নীতি আর লুটপাট সিন্ডিকেটের ‘পঞ্চপাণ্ডব খ্যাত’ সেই কর্মকর্তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সিন্ডিকেটের এই প্রভাবশালীদের অনেকেই আত্মগোপনে আছেন।
লুটপাট সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন, সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাবেক পিএস (একান্ত সচিব) হারুন উর রশিদ বিশ্বাস, জননিরাপত্তা বিভাগের সাবেক যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, সাবেক এপিএস (সহকারী একান্ত সচিব) মনির হোসেন ও সাবেক পিআরও (তথ্য কর্মকর্তা) শরীফ মাহমুদ অপু।
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল হাতিরঝিল-তেজগাঁও নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এলাকায় তার তেমন জনপ্রিয়তা না থাকলেও শেখ কামালের বন্ধু হিসেবে ২০১৫ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়ে মন্ত্রী ছিলেন টানা ৯ বছর। ৪ আগস্ট গভীর রাত পর্যন্ত ছিলেন মন্ত্রণালয়ের তার কার্যালয়ে। সরকার পতনের পর ভারতে পালিয়ে যান বলে অভিযোগ রয়েছে।
আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও দুবাইয়ে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। দুবাইয়ে স্বর্ণের ব্যবসায় রয়েছে অর্থলগ্নি। এছাড়া ঢাকার তেজগাঁও ছাড়া দাউদকান্দি ও কুমিল্লায় গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। তার শ্যালক লতিফ ভূঁইয়া দুলাভাইয়ের ক্ষমতায় হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। তবে লুটপাট আর অবৈধ আয়ে হাতে হাত ধরে এগিয়েছেন ঢাকা থেকে কুমিল্লায়। লতিফ ভূঁইয়া নিজেও সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, ধানমন্ডি এবং বরুড়া ও মনোহরপুরে। তদন্তে নামা দুদকের কর্মকর্তারাও শালা-দুলাভাইয়ের অবৈধ সম্পদের তালিকা তৈরিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি সূত্র জানায়, আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তার পরিবারের ৩২০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এ ছাড়া কয়েক হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে কানাডা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা কয়েকজন সন্ত্রাসীর বাণিজ্যে অর্থলগ্নির অভিযোগ রয়েছে আসাদুজ্জামান খান কামালের ছেলে কারাগারে থাকা সাফি মুদ্দাসির খান জ্যোতি এবং শ্যালক লতিফ ভূঁইয়া কামালের বিরুদ্ধে। দুদকে দায়ের করা অভিযোগে আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধে ‘সিন্ডিকেট’ করে ‘বস্তায় বস্তায়’ ঘুষবাণিজ্যের অভিযোগ আনা হয়েছে। কামাল ও তার স্ত্রী লুৎফুল তাহমিনা খান এবং তাদের ছেলে-মেয়ের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) নির্দেশে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এসপি বদলিতে এক বছরের জন্য এক কোটি টাকা, স্থানভেদে দুই থেকে তিন কোটি টাকাও দিতে হতো। এর মধ্যস্থতা করতেন এপিএস মনির হোসেন ও শরীফ মাহামুদ অপু। ঘুষের এই টাকা রাতে ধানমন্ডির বাসায় আসাদুজ্জামান খান কামালের ছেলের হাতে বুঝিয়ে দেয়া হতো।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, আসাদুজ্জামান খান কামাল গত দশ বছরে পুলিশের এসপি, ওসি ও এসআই বদলি, পদায়ন ও নিয়োগে কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। এর পাশাপাশি তিনি পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়ীকে অস্ত্রের লাইসেন্স পাইয়ে দিয়ে ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন শতকোটি টাকা।
এদিকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা দুর্নীতি ও লুটপাটের সিন্ডিকেটদের ‘পঞ্চপাণ্ডব’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেন সহকর্মীরা। দুর্নীতি আর লুটপাটে হাজার হাজার কোটি টাকার অর্থসম্পদের মালিক হওয়া এই পঞ্চপাণ্ডবরা এখনো রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলেও এদের কেউ কেউ পালিয়ে গেছেন ভারতে। কেউবা আবার দেশেই আছেন আত্মগোপনে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর ভারতে পালিয়ে যান আলোচিত পঞ্চপাণ্ডব প্রধান আসাদুজ্জামান খান কামাল। তার সাবেক পিএস হারুন উর রশিদ বিশ^াস অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন। তবে পটপরিবর্তনের পর অবসরে পাঠানো হয় তাকে। সাবেক যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাসকে জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে বদলি করা হয় পাট মন্ত্রণালয়ের রেশম শিল্পে। নতুন কর্মস্থলে তিনি যোগদান করেননি বলে রেশম শিল্প থেকে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় কামালের এপিএস হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মনির হোসেনকে ৫ আগস্টের পর থেকে কোথাও দেখা যায়নি। আর পিআরও শরীফ মাহমুদ অপুকে বেতারে ফেরত পাঠানো হয়। পরে অবশ্য তাকে চট্টগ্রাম বেতারের কার্যালয়ে বদলি করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, সাবেক মন্ত্রীসহ আলোচিত-সমালোচিত এই কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। দুর্নীতি, অনিয়ম আর লুটপাটে গা ভাসিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে পঞ্চপাণ্ডবের নেতৃত্ব দিয়ে আসাদুজ্জামান খান কামাল গড়েছেন অন্তত দশ হাজার কোটি টাকার সম্পদ। বাবার ক্ষমতায় তার ছেলে জ্যোতিও হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে পুরনো ভবন কিনে সংস্কার করে বিক্রির ব্যবসায় লগ্নি করেছেন অন্তত পাঁচ শত কোটি টাকা।
এদিকে পঞ্চপাণ্ডবের হারুন উর রশিদ বিশ^াস, ধনঞ্জয় কুমার দাস, মনির হোসেন ও শরীফ মাহমুদ অপু হয়েছেন বটবৃক্ষ। দেশে বিদেশে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। তাদের অবৈধ আয়ের মূল উৎস্যই ছিল পুলিশে নিয়োগ, বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতি, ফায়ার সার্ভিস ও কারাগারে নিয়োগ, অস্ত্র ও মদের বারের লাইসেন্স দেয়া। অভিযোগ রয়েছে, এই কর্মকর্তারা ঘুষের টাকা বস্তায় ভরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালের ধানমন্ডির বাসায় পাঠাতেন।
সরকার পতনের আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব থেকে ধাপে ধাপে অতিরিক্ত সচিব হন হারুন-অর রশিদ বিশ্বাস। তবে সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের একান্ত সচিব (পিএস)। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। নিয়োগ-বাণিজ্য, জমি দখল, লুটপাট ও প্রকল্পের নামে অর্থ আত্মসাৎ করে গড়েছেন শত কোটি টাকার সম্পদ।
হারুন-অর রশিদ বিশ্বাস, তার স্ত্রী ও মেয়ের নাম ও জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য দিয়ে সরকারি-বেসরকারি অন্তত ৯৯টি প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তলব করে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান কর্মকর্তা।
অপরদিকে পতিত সরকারের আমলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আলোচিত পঞ্চপাণ্ডবের অন্যতম হোতা ছিলেন ধনঞ্জয় কুমার দাস। ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব হিসেবে যোগ দেন তিনি। সরকারের অনুমোদনের পর দেশজুড়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের পদায়ন ও বদলির অর্ডার হতো তার স্বাক্ষরে। টানা প্রায় পাঁচ বছর ছিলেন এই দায়িত্বে। পদটিতে যোগ দিয়ে তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। এই স্বল্প সময়েই তিনি হয়েছেন অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক। তবে তার এই অবৈধ আয়ের সামান্য অংশ রেখেছেন দেশে। বাকিটা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মালয়েশিয়া ও ভারতে। এসবের কারণে ধনঞ্জয়কে পুলিশে বদলি-বাণিজ্যের ‘মহারাজা’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেন ব্যাচমেট ও অন্য পেশার বন্ধুরা।
আলোচিত কর্মকর্তা মহারাজা ধনঞ্জয় কুমার দাস ২০১৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব হিসেবে যোগদান করেন। টানা চার বছর আট মাস পর ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর তাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে বদলি করা হয়। তবে মাত্র তিন মাসেই ২০২৩ সালের ২০ মার্চ ফিরে আসেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে। এ সময় তাকে যুগ্মসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। এই পদে থেকেও অধস্তনদের দিয়ে চালাতেন বদলি বাণিজ্য। নতুন করে ফিরে আসার পর ৫ আগস্ট পর্যন্ত অর্থাৎ আরো এক বছর চার মাস সব প্রক্রিয়া চলমান রাখেন ধনঞ্জয়।
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা (পিআরও) ছিলেন শরীফ মাহামুদ অপু। পুলিশে বদলি বাণিজ্য সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন তিনি। বদলি বাণিজ্যের ঘুষের টাকার একটি অংশ নিজে রেখে বাকিটা রাতে ধানমন্ডির বাসায় মন্ত্রীর ছেলের হাতে বুঝিয়ে দিতেন তিনি। এভাবেই আসাদুজ্জামান খান কামাল, তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও পুত্রের কাছে বিশ^স্ত হয়ে উঠেছিলেন এই কর্মকর্তা।
জানা গেছে, পুলিশের এসপি, ওসি ও এসআই বদলির পাশাপাশি তিনি অন্তত অর্ধশত ব্যবসায়ীকে অস্ত্রের লাইসেন্স পাইয়ে দিয়েছেন। যার বিনিময়ে অপু নিজের এবং আসাদুজ্জামান খান কামালের জন্য নিয়েছেন ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা। এসব টাকার বড় একটি অংশ দিতে হতো কামালের ছেলে অথবা তার স্ত্রীর কাছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই আস্থাভাজন কর্মকর্তা শরীফ মাহামুদ অপুর বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ দাখিলের পর তাকে ডাকা হয়েছিল। দুদকে হাজিরাও দিয়েছেন তিনি। তার অর্থসম্পদের হিসাবও জমা দিয়েছেন অপু। তবে এসবের তথ্য নিয়ে শিগগিরই অনুসন্ধানে নামবে দুদক।
অপরদিকে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অর্থ লুটপাট আর দুর্নীতির সিন্ডিকেটের আরেকজন সদস্য আসাদুজ্জামান খান কামালের সাবেক এপিএস মনির হোসেন। ব্যক্তিগত সহকারী (পিও) থেকে হয়েছিলেন এপিএস। সব অবৈধ আয়ের ভাগ পেতেন মন্ত্রণালয়ে তার দফতরে বসেই।