দুর্বল পরিকল্পনা ও অবহেলার এক অন্যতম দৃষ্টান্ত ঘোড়াশাল ৪র্থ ইউনিট রি-পাওয়ারিং প্রকল্প। তিন দফা সময় ও ব্যয় বাড়িয়েও শেষ হয়নি প্রকল্পটির কাজ। তিন বছরের এই প্রকল্পের মেয়াদ গিয়ে ঠেকেছে সাড়ে ৯ বছরে। এতে গচ্চা যাচ্ছে দেশীয় অর্থ। আর
হাতছাড়া হচ্ছে বিশ্বব্যাংকের প্রায় ২৬২ কোটি টাকার ঋণ। পরিকল্পনা কমিশন ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তা, জিওবি ও সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নপুষ্ট তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পটি ২০১৬ সালের জুন মাসে একনেকে অনুমোদন পায়। নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় পরবর্তীতে তিন দফায় প্রকল্পের মেয়াদ ৫ বছর বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত করা হয়। তাতেও শেষ হচ্ছে না কাজ। ফলে মেয়াদ আরও ১ বছর ৬ মাস বাড়াতে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এই প্রস্তাব অনুমোদন করা হলে তিন বছরের প্রকল্প গিয়ে ঠেকবে সাড়ে ৯ বছরে।
অন্যদিকে মেয়াদ বাড়ানোর পাশাপাশি তিন দফায় বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের ব্যয়ও। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রথম দফায় ৪২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় ৯৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ানো হয়। এ ছাড়া তৃতীয় দফায় আরও ৫৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। এই প্রস্তাব অনুমোদন পেলে ২ হাজার ২৯ কোটি ২৩ লাখ টাকায় শুরু হওয়া প্রকল্পটির খরচ বেড়ে দাঁড়াবে ২ হাজার ২২৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এতে গচ্চা যাচ্ছে দেশের প্রায় ২০০ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ না হওয়ায় ফেরত যাচ্ছে বিশ্বব্যাংকের ঋণও।
পিডিবি সূত্র বলছে, মূল ডিপিপি অনুমোদনের সময় প্রকল্পটির অনুকূলে বিশ্বব্যাংক প্রদত্ত ঋণের পরিমাণ ছিল ২১৭ মিলিয়ন ডলার। পরবর্তীতে প্রকল্প ঋণের পরিমাণ ১০ মিলিয়ন ডলার হ্রাস পেয়ে ২০৭ মিলিয়ন ডলার নির্ধারিত হয়। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৩ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর। ফলে নির্ধারিত মেয়াদে প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় সংস্থাটির ২১ দশমিক ৯২ মিলিয়ন ডলার ব্যবহার করা যাচ্ছে না। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় এই অর্থ দেবে না সংস্থাটি। প্রতি ডলার সমান ১১৯ টাকা ৪৯ পয়সা ধরে বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ২৬১ কোটি ৯৩ লাখ টাকার বেশি। বিশ্বব্যাংক টাকা না দেয়ার কারণে এখন সরকারি কোষাগার থেকে এই চাহিদা মেটানো হবে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড।
এ প্রসঙ্গে ঘোড়াশাল ৪র্থ ইউনিট রি-পাওয়ারিং প্রকল্পের পরিচালক মো. আব্দুল বাছিদ মানবজমিনকে বলেন, ‘আমি কোনো তথ্য দিতে পারবো না। জনসংযোগ শাখার মাধ্যমে তথ্য নিতে আসেন।’ এর বাইরে তিনি কোনো কিছু বলতে রাজি হননি।
প্রকল্প সংশোধনের নির্দেশনা মানা হয়নি: পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন পদ্ধতি (জুন ২০২২) অনুসারে প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব প্রকল্পের মেয়াদ সমাপ্তির অন্তত ৩ মাস আগে পাঠানোর নির্দেশনা থাকলেও ঘোড়াশাল ৪র্থ ইউনিট রি-পাওয়ারিং প্রকল্পের ক্ষেত্রে সেই নির্দেশনা মানা হয়নি। সংস্থাটির কাছে এই বিলম্বের কারণ জানতে চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। এদিকে প্রকল্পের কয়েকটি খাতে নতুন করে ব্যয় বাড়ানো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। সূত্র বলছে, ‘পরিচালন’, ‘মেরামত’ ও ‘সংরক্ষণ কাজ’ খাতে ২য় সংশোধিত ডিপিপি থেকে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা (৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ); ‘সভা’, ‘বিজ্ঞাপন’, ‘আপ্যায়ন’, ‘পরিবেশ ফি’, ‘লাইসেন্স ফি’, ‘অডিট ফি’, ‘আরএমএস কমিশনিং ফি’ এবং অন্য সংশ্লিষ্ট ব্যয় খাতে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা (৪০০ শতাংশ) ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। আরএমএস কমিশনিং ফি বাবদ ২ কোটি ৩১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এ সকল খাতে ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্পের বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মত হলো- বিদ্যুৎ খাতটি লুটপাটের আখড়া। তাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে। তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেনি। এ ছাড়া তাদেরকে রক্ষা করতে দায়মুক্তি আইন করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই খাতে সঠিক ব্যক্তিদেরকেও পদায়ন করা হয়নি। তারই পরিণতি আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে।