২০০৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেল বেলা। রাজধানীর ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ১৪ দলীয় জোটের মহাসমাবেশ চলছে। সেখান থেকে একজন নেত্রীর দরাজ গলায় ভেসে এলো একটি নির্দেশ। ‘ডাকা মাত্র বাঁশের লাঠি নিয়ে ঢাকায় ছুটে আসবেন’। তিনি আর কেউ নন; ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠার তাণ্ডবের মাস্টার মাইন্ড ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পাশর্^বর্তী দেশে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরাচার ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। সূত্র ‘১৯ অক্টোবর ২০০৬ দৈনিক দিনকাল’ পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল এটি । দৈনিক ইত্তেফাকের ‘১৯ অক্টোবর ২০০৬’ প্রধান শিরোনাম ছিল একটু ভিন্ন রকম। ‘সংস্কার মানুন, নইলে বৈঠা লগি লাঠি নিয়ে মানুষ ঢাকায় চলে আসবে’। দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনামেও একই কথা প্রমাণিত হয়। দৈনিক ইনকিলাবের শিরোনাম অনেকটাই দৈনিক ইত্তেফাকের মতো। শিরোনামটি হলো হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধান করা হলে লাঠিসোঁটা নিয়ে ঢাকায় চলে আসবেন। দৈনিক সংগ্রামের প্রধান প্রতিবেদনে বলা হয়, ভোট ও ভাতের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে; লাঠি নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। সেখানেও নির্দেশ দাতা শেখ হাসিনা। সেদিনের সমাবেশে শেখ হাসিনার নির্দেশ প্রথম সারির সবগুলো পত্রিকার শিরোনাম হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে ১৯ তারিখে প্রকাশিত পত্রিকায়। মহাসমাবেশে শেখ হাসিনার কথাগুলোর ধারাবাহিকতায় এই দেশে আসে পরের মাসের ২৮ অক্টোবরের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের দিন। দৈনিক ইত্তেফাকের রিপোর্টটি করেছিলেন দু’জন রিপোর্টার ফরাজি আজমল হোসেন ও সাহাবুল হক। সেই সমাবেশ থেকে দুইদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে ১৪ দল। দিনটি ছিল মঙ্গলবার ৪ঠা আশ্বিন ১৪১৩ সাল, ২৫ শাবান ১৪২৭ হিজরী।
পল্টন ময়দানের মহাসমাবেশ থেকে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা তার কর্মীদের লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকা অবরোধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ধারাবাহিকতা দেখলে নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় যে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়েই আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের কর্মীরা লগি-বৈঠা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ২৭ অক্টোবর থেকেই ঢাকাসহ সারাদেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ২৮ অক্টোবর নৃসংশ হত্যাকা- ঘটায়। দেশে আসে ওয়ান ইলেভেনের রাজত্ব। ১৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা এহেন নির্দেশ দেওয়ার পরদিন ১৯ সেপ্টেম্বর বুধবার ময়মনসিংহে জনসভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, কোন দেশপ্রেমিক কখনো লগি-বৈঠা নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কথা বলতে পারে না। সূত্র- ২০ সেপ্টেম্বর, দৈনিক দিনকাল। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৮ সেপ্টেম্বরের ঘোষণা অনুযায়ী অবরোধ কর্মসূচি পালন করে। আর ২০ সেপ্টেম্বর সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে। পরদিন অর্থাৎ ২২ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক রিপোর্ট ছাপে, ‘ঢিলে ঢালা হরতাল’। এরপর সালিশ মানি তাল গাছ আমার স্টাইলে চলতে থাকে একের পর এক নানা কর্মসূচী।
২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৬ ইং দৈনিক ইত্তেফাকে একটি রিপোর্ট ছাপে। ভারতের হাই কমিশনার বিনা সিক্রির সঙ্গে শেখ হাসিনার রুদ্ধদ্বার বৈঠক। বিষয়টি নিয়ে দৈনিক সংগ্রাম একটি রিপোর্ট ছাপে। তাতে বলা হয়, বীনা সিক্রির কাছে শেখ হাসিনার বিকল্প সমাধান তালাশ। ২৭ সেপ্টেম্বর তৎকালীন বিএনপির মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূইয়া এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। মূলত এরপর থেকে পুরো মাসজুড়ে চলে সংলাপ সংলাপ খেলা। এর সাথে যোগ হয় বিদেশী কূটনীতিকদের নানা দৌড়ঝাঁপ।
৩ অক্টোবর দৈনিক দিনকাল একটি রিপোর্ট ছাপে। তাতে বলা হয় সংলাপ থেকে পিছিয়ে গেল আওয়ামী লীগ। ১২ অক্টোবর একটি ছবি ছাপে দৈনিক দিনকাল। তাতে দেখা যায় আওয়ামী লীগের লোকজন বৈঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজপথে। নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক।
৫ অক্টোবর পর্যন্ত মান্নান ভূঁইয়া আর আবদুল জলিলের সংলাপের মধ্যে আবারো আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে অবরোধের সিদ্ধান্ত হয়। সূত্র- দৈনিক ইত্তেফাক- ৮ অক্টোবর ২০০৬ ইং। ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০ অক্টোবর অবরোধ কর্মসূচি পালন করে আওয়ামী লীগ। সেদিন সারাদেশ রেলপথ চলাচল অচল করে দেয় আওয়ামী লীগ।
১৩ অক্টোবর ঢাকাসহ সারাদেশে সমাবেশ ডাকে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। এমতাবস্থায় ভারতের হাইকমিশনারের আরেকটি বক্তব্য সামনে আসে। ঐদিন ভারতের তৎকালীন হাই কমিশনার সাক্ষাৎকার ছাপে দৈনিক ইত্তেফাক। সেখানে বীনা সিক্রি বলেন, নির্বাচনে জনগণই পছন্দের সরকার বেছে নিবে। এভাবে সংলাপ সংলাপ খেলা চলে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত। চলে আসে পবিত্র রমজানের ঈদ। এদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ২৮ অক্টোবর, ২৯ অক্টোবর ও ৩০ অক্টোবর রাজপথ দখলের ঘোষণা আসে। (সূত্র: ২৯ অক্টোবর ২০০৬ ইং দৈনিক ইত্তেফাক )।
২১ অক্টোবর দৈনিক দিনকালের একটি রিপোর্টে বলা হয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় সংলাপ ব্যর্থ হলে ২৮ অক্টোবর ঢাকা অবরোধ করা হবে। ঘোষণা অনুযায়ী ২৭ অক্টোবর শুরু করে তা-ব। দৈনিক সংগ্রামের আরেকটি রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে, সংলাপের ফলাফল নিয়ে অনিশ্চয়তা, দুই পক্ষেরই মাঠ দখলের প্রস্তুতি। ২৮ অক্টোবরের আগে লন্ডনে যান শেখ হাসিনা। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ঘোষণা দেন যে, সংলাপ ব্যর্থ হলে ২৮ অক্টোবর ঢাকা অবরোধ করা হবে।
২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রেডিও-টিভিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। মূলত এ ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই দেশব্যাপী শুরু হয় লগি-বৈঠার তা-ব। বিভিন্ন স্থানে বিএনপি-জামায়াত অফিসসহ নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি যেমন চালানো হয় পৈশাচিক হামলা, তেমনি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় অনেক অফিস, বাড়িঘর, পুরো দেশব্যাপী চলে তা-ব।
২৮ অক্টোবর দৈনিকগুলোর শিরোনাম হলো- রাজধানীতে আওয়ামী লীগের ধ্বংসযজ্ঞ। এসবের ধারাবাহিকতায় আসে ২৮ অক্টোবর। এদিন আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র দলগুলো বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সমাবেশ ডাক দেয়, সেখানে অনেকে লগি-বৈঠা নিয়ে হাজির হয়। একই দিন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বায়তুল মুকাররম মসজিদের উত্তর গেটে পূর্ব ঘোষিত সমাবেশ ছিলো। ফলে চলমান সংঘর্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটে, ঐ দিন থেকে পরবর্তী একমাসের মধ্যে ৪০ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়। ২৮ অক্টোবরের রেশ থাকে আরও কয়েকদিন। সারাদেশে চলতে থাকে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের লোকজনের নৃশংস হামলা, হত্যা, বাড়িঘর ভাঙ্চুর এবং অত্যাচার তাণ্ডব।
১৪ দলীয় জোট ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল জলিল, তোফায়েল আহমদ, আবদুর রাজ্জাক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন বারবার উত্তেজনাকর বক্তব্য দিয়ে সেদিন হামলার জন্য তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীকে উৎসাহিত করছিলেন। দুঃখজনক বিষয় হলো যে, সেদিন অজানা কারণে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। সেই সাুযোগে জামায়াত-শিবিরের লোকজনকে নির্মমভাবে সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করে আওয়ামী লীগের লোকজন।
সারাবিশ্ব বিস্ময়ে দেখেছে শেখ হাসিনার নির্দেশে কিভাবে বাস্তবায়ন হলো লগিবৈঠার তাণ্ডব। তাতে বদলে গেল দেশের রাজনীতির ইতিহাস। দেশে এলো ওয়ান ইলেভেন। দীর্ঘদিনের অপেক্ষায় পড়লো গণতন্ত্র।
২৮ অক্টোবর ঢাকায় বড় আকারের সহিংসতা হলেও সেদিন ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়েছিল। নয়া দিগন্ত পত্রিকার খবর অনুযায়ী ২৮শে অক্টোবর সহিংসতায় দেশজুড়ে অন্তত ১৩জন নিহত হয়েছে।
ঊনত্রিশে অক্টোবর দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল – দেশজুড়ে নৈরাজ্য। ইত্তেফাকের খবর অনুযায়ী দেশজুড়ে সহিংসতায় ১১জন নিহত হয়েছে। উনত্রিশে অক্টোবরও দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতা হয়েছে। সেদিন অন্তত সাতজন মারা যায়। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়, তিনদিনের রাজনৈতিক সহিংসতায় দেশে অন্তত ২৩জন নিহত হয়েছেন। ৩৬ জুলাই দেশ স্বাধীন হওয়ায় আবার ফিরে আসে গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা। দেখা যাক সামনের দিনগুলোতে সুদিন ফিরে আসে কি-না।