স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে (এলজিইডি) বিভিন্ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি কোনো নিয়মকানুন মানা হয়নি। আদালতের আদেশকে সামনে রেখে বিগত সরকারের ১৫ বছরে প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ইচ্ছামতো। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। এর মধ্যে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেননি এমন প্রার্থীকেও প্রকৌশলী পদে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা কয়েকজন কৃষিবিদকে পুরকৌশল (সিভিল ইঞ্জিনিয়ার) পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যথাযথ শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনের আগেই চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এসবই হয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে। বিগত সরকারের শুরু থেকেই সুবিধাভোগী কয়েক প্রভাবশালী আমলা ও এলজিইডির ক্ষমতাধর কর্মকর্তারা প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত প্রার্থীদের পক্ষে ভর করেন। এ কারণে পদোন্নতি ও পদায়নের বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন তারা। এ নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে প্রকল্প ও এলজিইডির নিজস্ব কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, জনপ্রশাসন, সরকারের অর্থ বিভাগ এবং উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটিও যদি এলজিইডির এই নিয়োগ সম্পর্কে কিছুই না জানে তাহলে তারা সরকারি বেতন-ভাতা পাচ্ছেন কীভাবে? অবশ্যই বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নেওয়া দরকার। এই দীর্ঘ সময় সরকারের অডিট বিভাগ এলজিইডির এই জনবলের রিপোর্ট কীভাবে দিয়েছে তাও দেখা উচিত। বিষয়টি দেখব।
জানা গেছে, এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী আলী আখতার হোসেন সম্প্রতি অবসরে গেছেন। যাওয়ার আগে তিনি প্রকল্প থেকে আসা ১১২ জনকে চলতি দায়িত্বে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি দেওয়ার উদ্যোগ নেন। এরপরই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। অথচ ২০২২ সালে তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিন ওই সময়ে স্থানীয় সরকার সচিবের কাছে জটিল এই বিষয় নিয়ে লিখিতভাবে প্রকৃত চিত্র উপস্থাপন করেন। দাপ্তরিক ওই পত্রে তিনি বলেন, ‘ইতোপূর্বে এলজিইডির বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে প্রকৌশলী পদে জনবল নিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে আদালতের রায় অনুযায়ী ১৩২ জনকে রাজস্ব খাতে পদায়ন/নিয়মিতকরণে স্থানীয় সরকার বিভাগের মাধ্যমে পিএসসির মতামত চাওয়া হয়। ওই সময়ে কর্মরত ১১০ জনকে এলজিইডির সাংগঠনিক কাঠামোভুক্ত সহকারী প্রকৌশলী/ উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী শূন্য পদের বিপরীতে নিয়মিতকরণের বিষয়ে পিএসসি কিছু তথ্য চেয়ে মতামতের জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পত্র পাঠায়। এ অবস্থায় ১৩১ জনের মধ্যে ১ জন সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা অতিক্রমের বিষয়ে মানবিক বিবেচনার দাবি নিয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন। আদালত ওই ব্যক্তিকে রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্তির আদেশ দেন। এই সুযোগে ১৩১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকল্প থেকে নাম পিএসসিতে পাঠানো হয়। ২০১০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পিএসসি আংশিক মতামত দেয়। কিন্তু নথিতে ৬৫২ নম্বর স্মারকে যে পত্র দেয় তাতে পিএসসির মতামত পাওয়া যায়নি।’ এভাবে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রকল্পভুক্তদের পক্ষ থেকে ১০৫টি আবেদন করা হয় হাইকোর্টে।
সদ্য বিদায়ি প্রধান প্রকৌশলী আলী আখতার হোসেনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার ব্যক্তিগত ও অফিসিয়াল সব নম্বর বন্ধ পাওয়া গেছে। তার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার অবস্থান জানার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার অবস্থান সম্পর্কে বলতে পারেননি।
তবে এলজিইডির ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী গোপাল কৃষ্ণ দেবনাথ যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে নিয়োগের বিষয়টি আসলে অনেক পুরোনো। এলজিইডির শীর্ষ পদে থাকলেও এ বিষয়ে কথা বলার মতো তথ্য আমার কাছে নেই, আমি জানিও না।’
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তরিত পদধারীদের নিয়মিতকরণ ও জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণে বিধিমালা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিধিমালা, ২০০৫-এর বিধি ৪(৩) অনুযায়ী প্রথম শ্রেণির পদে নিয়মিতকরণের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসির) সুপারিশ গ্রহণ করতে হবে। প্রথম শ্রেণির প্রকৌশলীদের রাজস্ব খাতে স্থানান্তরে পিএসসির সুপারিশ গ্রহণ না করে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এমনকি তাদের ৬ষ্ঠ গ্রেডে বেতন দেওয়া হচ্ছে। এলজিইডির চলমান এই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামতকে অগ্রাহ্য করে তাদের এক দফা পদোন্নতি দেওয়ার পর আবার ২য় দফায় ৫ম গ্রেডের নির্বাহী প্রকৌশলী পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এতে একদিকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অর্থ অপচয়ের পাঁয়তারা অন্যদিকে এলজিইডিতে বিশৃঙ্খলা এবং অসন্তোষ তৈরি করছে।
নথিপত্র বিশ্লেষণ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে নিয়োগের প্রক্রিয়াটি শুরু হয় ২০০০ সালে। সরকারি চাকরির বয়স শেষ উল্লেখ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করে ছিলেন প্রকল্পের এক কর্মকর্তা। সেই সময় মানবিক বিবেচনায় তাকে রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত করার আদেশ দিয়েছিলেন আদালত। ২০০৬, ২০১০ সালসহ বিভিন্ন সময়ে রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি দীর্ঘ হয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, সরাসরি নিয়োগের আদেশ বাস্তবায়ন না করে পিএসসির মতামত চাওয়ায় আদালত অবমাননার অভিযোগও করেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। এরপর ২০১০ সালের ২২ আগস্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব ও প্রধান প্রকৌশলীকে হাইকোর্টে ডেকে পাঠানো হয়। এরপর থেকে আদালতের রায়ের আলোকে প্রকল্প থেকে আসা রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্তির আদেশ বাস্তবায়ন হচ্ছে।
নথিপত্রে দেখা গেছে, বিদায়ি প্রধান প্রকৌশলী আখতার হোসেন চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি জ্যেষ্ঠতার খসড়া তালিকা বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করে। এই তালিকা নিয়েই কর্মকর্তাদের মধ্যে চলছে তীব্র অসন্তোষ। এক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০২২ সালের ২৬ অক্টোবর, ২০১০, ২০১১ ও ২০১৩ সালে ২৫৭ জন সহকারী প্রকৌশলীকে নিয়মিতকরণ ও পিএসসির সুপারিশের বিষয়ে মতামত দেয়। অথচ রহস্যজনক কারণে তা আমলে না নিয়েই জ্যেষ্ঠতার খসড়া তালিকা প্রকাশ করে এলজিইডি। অনেকের অভিযোগ মোটা অঙ্কের টাকার চুক্তিতে তালিকা করা হয়েছে। উত্থাপিত ২০২৪ সালের জ্যেষ্ঠতার খসড়া তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ‘শিখা ব্যানার্জি, মো. আব্দুল মালেক মন্ডল, মো. আল-আমিন সরকার, মো. নুরুন্নবীসহ অনেকেই এলজিইডির ফিডার পদের ন্যূনতম শিক্ষাগত বিএসসি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জন করেননি।’ যথাযথ যোগ্যতা পূরণ না করেই রাজস্ব খাতে সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগদান করে বর্তমানে ৬ষ্ঠ গ্রেডের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী পদে কর্মরত আছেন। তাছাড়া ২০১০ সালে এলজিইডির তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমান স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে দেওয়া চিঠিতে জানান, মামলার রায়ে প্রাপ্ত ১১০ জনের মধ্যে অন্তত ১৪ জন তখন এলজিইডিতে কর্মরত ছিলেন না। তা ছাড়া জ্যেষ্ঠতার খসড়া তালিকা-২০২৪ এর ক্রমিক নং- ৫০০, ৫২১, ৫২২, ৫২৩, ৫২৪, ৫২৬, ৫২৭, ৫২৮, ৫২৯, ৫৩০, ৫৩১, ৫৩২, ৫৩৫, ৫৪০, ৫৪২সহ অনেকেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা থাকা সত্ত্বেও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে গোপনে ১ম শ্রেণি পদে শামিল হয়েছেন।
ক্ষুব্ধ এক সহকারী প্রকৌশলী যুগান্তরকে বলেন, জনপ্রশাসন, অর্থ বিভাগ ও এলজিইডি মন্ত্রণালয়ের বিধিবিধান অমান্য করে পদোন্নতির ক্ষেত্রে এলজিইডিতে মারাত্মক বৈষম্য শুরু হয়েছে। অনেকে পারিবারিক সিন্ডিকেট তৈরি করে চালিয়েছেন নিয়োগ ও পদোন্নতি বাণিজ্য। এমনকি সরকারি বিধিবিধান অমান্য করে দেওয়া হয়েছে ১ম শ্রেণির পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি, এটা অবিশ্বাস্য।
যোগ্যতার গ্যাঁরাকল : নথিপত্রে দেখা যায়, এলজিইডির উন্নয়ন প্রকল্পের নিয়োগে যাচাই-বাছাই সেভাবে না হওয়ায় খুব সহজেই সেখানে পরিবার-পরিজনদের নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। নিয়োগের কিছুদিন পরই তারা রাজস্ব খাতে চাকরি দাবি করে। অনেকের মতো একজন তাসমিন আক্তার ২০০৮ সালে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করে ২০০৯ সালে প্রকল্পে যোগদান করে এবং সরকারি চাকরি পাওয়ার উদ্দেশ্যে মামলা করে। ২০১১ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে তাকে কোনোরকম প্রতিযোগিতমূলক পরীক্ষা ছাড়াই ১ম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে রাজস্ব খাতে আত্তীকরণ করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে যাদের বিরোধিতা করার কথা তারা তাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেন। এমনকি এসব মামলায় কোনো আপিল পর্যন্ত করা হয় না। চাকরি প্রাপ্তির এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সহিদুর রহমান প্রামাণিকের ছেলে সালেহ প্রামাণিক, প্রকল্প পরিচালক আমিনুল ইসলামের স্ত্রী শান্তা ইসলামসহ অনেকের চাকরি আত্তীকৃত করা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে মোটা অঙ্কের টাকা চাঁদা উত্তোলন করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। টাকা উত্তোলনের দায়িত্ব পালন করেন তৎকালীন সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী ও প্রধান প্রকৌশলীর এক স্টাফ।
এলজিইডি প্রকাশিত জ্যেষ্ঠতার খসড়া তালিকা ২০২৪ (ক্রমিক নং ৬২৭)-এ দেখা যায়, ফিরোজা করিম নেলী ৪১ বছর বয়সে ২০০৯ সালে পুরকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে ২০১৩ সালে সরকারি চাকরিতে আত্তীকৃত হয়েছে। কেএম রেজাউল করিম (ক্র.নং ৪৫৫), ৩৬ বছর বয়সে ২০১০ সালে পুরকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে ২০১১ সালে সরকারি চাকরিতে আত্তীকৃত হয়েছে। মো. আব্দুস সাত্তার (ক্রমিক নং ৪৫৪) ৩৬ বছর বয়সে ২০০৯ সালে পুরকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে ২০১১ সালে সরকারি চাকরিতে আত্তীকৃত হয়েছে। তাদের কারোরই নেই পুরকৌশল বিষয়ে কাজ করার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতা। অনেকেই এলজিইডির ফিডার পদের ন্যূনতম শিক্ষাগত বিএসসি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি অর্জনের যোগ্যতা পূরণ না করেই এলজিইডিতে বর্তমানে কর্মরত আছেন। একদিকে যেমন নির্দিষ্ট বয়স অতিক্রান্ত লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে সারা দেশের মেধাবীদের বঞ্চিত করা হয়েছে। ২০২৪ সালে জ্যেষ্ঠতার খসড়া তালিকায় ৬২৮ নম্বর ক্রমিকে পাওয়া গেছে সালেহ হাসান প্রামাণিকের নাম। তিনি এলজিইডির তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রশাসন) সহিদুর রহমান প্রামাণিকের ছেলে। তিনি ২০১২ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের পরামর্শক হিসাবে যোগদান করে মাত্র ৬ মাস পর ২০১৩ সালের জুন মাসে রাজস্ব খাতে আত্তীকৃত হয়েছেন। বিদায়ি প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীর ভাতিজা এই সালেহ হাসান প্রামাণিক ৬ বছর ধরে প্রভাব বিস্তার করে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সাভার উপজেলা প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত আছেন।
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, ‘তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমান ২০১০, ২০১১ ও ২০১৩ সালে ২৫৭ জনের কাছ থেকে নিয়োগ বাবদ মোটা অঙ্ক হাতিয়ে নিয়েছেন। এই বিতর্কিত নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন এক প্রকৌশলী। তিনি বর্তমানে ঢাকায় কর্মরত। তৎকালীন বেশ কয়েকজন প্রকৌশলী এই নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী আলী আক্তার হোসেন বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের সভাপতি হিসাবে বিগত সরকারের অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসাবে পরিচিত ছিলেন। সেই দাপটেই চলেছেন তিনি। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ভোল পাল্টে তিনি ও এক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সড়ক ও ভবন) বড় একটি দলের নাম ভাঙিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিদায়ের আগ পর্যন্ত চালিয়েছেন বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্য। বিধিবহির্ভূতভাবে তাদের একদফা পদোন্নতির পর ফের তাদেরই ২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত প্রজ্ঞাপনের ৮(৮) ও ৯ (২)-এর বর্ণিত ধারা লঙ্ঘন করে নিয়মিতকরণ ছাড়া ৫ম গ্রেডে চলতি দায়িত্বে পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে নিষেধ থাকার পরও তাদের বদলি বাণিজ্যের কারণে মাঠ পর্যায়ের প্রকৌশলীরা প্রতিনিয়ত আতঙ্কে ভুগছেন, এতে স্থবির হয়ে পড়েছে এলজিইডির সার্বিক কার্যক্রম।
জানা যায়, ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর গত দুই মাসে বিভিন্ন পদে প্রায় সাড়ে পাঁচশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বদলি ও পদায়ন হয়েছে। যাদের বেশির ভাগই বিগত সরকারের সুবিধাভোগী। এছাড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও বিদ্যমান নিয়মনীতি উপেক্ষা করে এখনো চলছে বিতর্কিত পদোন্নতির প্রক্রিয়া। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুবিধাবঞ্চিত এক সহকারী প্রকৌশলী যুগান্তরকে বলেন, বিশাল অঙ্কের টাকার প্রলোভন থাকায় কোনো নিয়মনীতিই মানা হচ্ছে না। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটির মাধ্যমে বিষয়টি তদন্ত করলে এর সত্যতা বের হয়ে আসবে। তা ছাড়া এত অল্প সময়ে এই ধরনের অস্বাভাবিক বদলি ও পদোন্নতির সার্বিক কার্যক্রম দুর্নীতি দমন কমিশনের মাধ্যমে তদন্ত করা উচিত।
প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে কর্মকর্তাদের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এদের একজন মো. আল আমিন সরকার। তিনি ২০১০ সালে সহকারী প্রকৌশলী হয়েছেন। বর্তমানে তিনি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলা প্রকৌশলী পদে কর্মরত। তিনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী। জানতে চাইলে এ বিষয়ে তিনি বলেন, পদোন্নতির ফাইল যখন নাড়াচাড়া হয় তখনই এ বিষয়টি আলোচনায় আসে। ঊর্ধ্বতন উভয় পক্ষকে মিলিয়ে দিলে এ বিষয়টি অনেক আগেই মিটে যেত। চাকরির শেষ বয়সে এসে এ নিয়ে আর কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। কারণ সবারই ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কৃষিবিদ হলেও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অনেক কিছুই আমাদের পড়ানো হয়। তাছাড়া এলজিইডির প্রকল্পে থাকাবস্থায় অনেক কাজ তো আমরাই করেছি। কাজেরও তো একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা আমাদের আছে।’ কৃষিবিদ হিসাবে কতজন প্রকৌশলী পদে চাকরি করছেন জানতে চাইলে আল আমিন বলেন, ‘আমরা চারজন ছিলাম। একজন অবসরে যাওয়ায় এখন তিনজন।’
আল আমিন সরকারের এই যুক্তি মানতে রাজি নন তার সহকর্মীরা। ঢাকার পার্শ্ববর্তী একটি উপজেলায় কর্মরত সহকারী প্রকৌশলী বলেন, আল আমিন যেভাবে অতি সহজে কৃষিবিদ হয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং অর্জনের তথ্য দিলেন তাহলে তো আর আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিল না। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় উপজেলা প্রকৌশলী বা সহকারী প্রকৌশলী পদটি ৬ষ্ঠ গ্রেডের। অথচ পিএসসি, অর্থ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও নবম গ্রেডে বেতন বা পদোন্নতি তারা কীভাবে পাচ্ছেন বিষয়টির তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।