নতুন করে কুইক রেন্টাল চুক্তি নবায়ন করা হচ্ছে না। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এ কাজটি করেছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের একটি বড় সিন্ডিকেট। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের চুক্তিসমূহ পর্যালোচনা সংক্রান্ত জাতীয় রিভিউ কমিটি এই নিয়ে মন্ত্রণালয়ে দুই দফা বৈঠকও করেছে।
এ প্রসঙ্গে কুইক রেন্টালের চুক্তি প্রসঙ্গে-কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম মানবজমিনকে বলেন, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তি বাতিল করতে হবে। কোনো নবায়ন করা চলবে না। কারণ এধরনের অবৈধ চুক্তি যারা করেছেন, তারা ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। যারা সুবিধা নিয়েছেন সেসব ব্যবসায়ী এবং যারা সুবিধা তৈরি করে দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার দাবি তুলেছে ভোক্তা অধিকার রক্ষার এই সংগঠনটি।
২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরই দ্রুত বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে ছোট ও মাঝারি বেশকিছু রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রের লাইসেন্স দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। তিন বছরের জন্য এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হলেও তা চলেছে আট থেকে ১০ বছর। কোনোটি চলেছে আবার ১২ থেকে ১৫ বছর। এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জও নির্ধারণ করা হয় অতি উচ্চ হারে। এতে বিনিয়োগের প্রায় সাড়ে চারগুণ বা ৪৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ তুলে নিয়েছে কোনো কোনো কোম্পানি। ঘোড়াশালে এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনালের নির্মিত ১৪৫ মেগাওয়াট দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক (গ্যাস ও ডিজেল) বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। এ কেন্দ্রটি উৎপাদন শুরু করে ২০১০ সালের ২৩শে আগস্ট। প্রথমে ডিজেলে ১৮ মাস চললেও পরে তা গ্যাসে উৎপাদন শুরু করে। উৎপাদন শুরুর সময় কুইক রেন্টাল এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি কিলোওয়াটের জন্য প্রতি মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ ধরা হয়েছিল ২১ ডলার। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি মাসে ৩০ লাখ ৪৫ হাজার ডলার ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হতো। এগ্রিকো’র ঘোড়াশাল ১৪৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রের জন্য এ হারে বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পড়তো তিন কোটি ৬৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। তিন বছরের জন্য কুইক রেন্টাল এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। আর এগ্রিকো বিনিয়োগ করেছিল ১০ কোটি ডলার বা ৫৬০ কোটি টাকা। এতে তিন বছরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতো ১০ কোটি ৯৬ লাখ ২০ হাজার ডলার।
পিডিবি’র কর্মকর্তারা বলেন, ২০০৯ থেকে ২০১১ সালে বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল সবচেয়ে বেশি। আর ঘাটতির এ সুযোগকে দুর্নীতির জন্য কাজে লাগানো হয়েছে বেশি হারে। এজন্য ওই সময়ে কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল বিনা দরপত্রে। তারা আরও জানান, পরবর্তী সময়ে দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে দ্বৈত জ্বালানিভিত্তিক বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। ওই কেন্দ্রগুলোয় কিলোওয়াটপ্রতি মাসিক ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় ১০ থেকে ১২ ডলার। অর্থাৎ ঘাটতির সুযোগের আড়াই থেকে তিনগুণ হারে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়েছিল বিনা দরপত্রের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয়। এতে প্রচুর অর্থ গচ্চা গেছে। যদিও এসব ক্যাপাসিটি চার্জও ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে বলেই জানা গেছে।
সূত্র মতে, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে পাচার করেছে। আর এ কাজটি করেছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব আহমদ কায়কাউসসহ বিদ্যুৎ বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট বিশেষ আইনে, বিনা দরপত্রে প্রতিযোগিতা ছাড়াই তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও আওয়ামী সমর্থক ব্যবসায়ীদের কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুবিধা দেয়। বছরের পর বছর এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো গড়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ চালানো হলেও ক্যাপাসিটি চার্জের নামে এগুলোর মালিকরা হাজার হাজার কোটি টাকা পকেটে ভরেন। ক্যাপাসিটি চার্জের টাকায় ফুলেফেঁপে ওঠা এই বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে পাচার করে দেন। যারা এ কাজে তাদের সহযোগিতা করেন সেই সিন্ডিকেটের প্রভাবশালীরাও বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে পাচার করে দিয়েছেন। এ প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি দমন কমিশন এরই মধ্যে সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ হচ্ছে আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড। কিন্তু এতদিন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের প্রিয় লোকদের আবদার পূরণে বিদ্যুৎ না নিয়েও ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে। এর বিনিময়ে তৎকালীন সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সুবিধাভোগী বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীরা অর্থ সুবিধা দিয়েছেন। তাদের মতে, বিদ্যুৎ দেয়া ছাড়াই ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিল নেয়ার মতো মারাত্মক অনিয়ম আর কিছু নেই। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে তা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, এ টাকা দেশের নাগরিকদের। তারা আরও বলেন, কোনো ধরনের টেন্ডার ছাড়া এসব রেন্টাল আর কুইক রেন্টালের লাইসেন্স তুলে দেয়া হয় দেশের প্রভাবশালী কোম্পানিগুলোর কাছে। মূলত আওয়ামী লীগ সরকার বিনা টেন্ডারে দায়মুক্তি আইনের আওতায় একসময়ে উচ্চমূল্যের রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছিল। ২০১০ সালে বলা হয়েছিল, এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র আপৎকালীন চাহিদা মেটানোর জন্য। কিন্তু গত দেড় দশকেও এগুলো আর বন্ধ করা যায়নি।
অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতে হরিলুটের অন্যতম উৎস ছিল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। তখন বিনা টেন্ডারে প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়া হয়। এসব উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে চুক্তি অনুযায়ী বছরের পর বছর সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এর সিংহভাগই গেছে নসরুল হামিদ ও জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পকেটে। এরই মধ্যে এ ব্যাপারে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী বিডি রহমত উল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করতে হবে। কুইক রেন্টালের নামে ডলারে বিদেশে ৬২ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এসব টাকা উদ্ধার করতে হবে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ (রেন্টাল ভাড়া) হিসেবে দিতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ দরকার নেই কিন্তু টাকা চলে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য এই টাকা ভাগাভাগি করা। তিনি আরও বলেন, বিদ্যুতের চাহিদা ছিল না। অথচ কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করেনি গত জনবিরোধী আওয়ামী লীগ সরকার। বিদ্যুতের চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও কেন এগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল- এমন প্রশ্ন রাখেন এই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, এগুলো প্রথমে ৩ বছরের জন্য চুক্তি ছিল। পরে তা নবায়ন করে ১৫ বছর চলেছে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
গত ১৯শে সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, নতুন করে কুইক রেন্টাল চুক্তি নবায়ন করা হবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা চুক্তিগুলো দু’টি কমিটি পর্যালোচনা করছে। কমিটির পরামর্শের ভিত্তিতে আমরা কাজ করবো। একটু ধৈর্য ধরুন। কমিটির প্রতিবেদন আসুক। তারপর দেখুন আমরা ব্যবস্থা নিই কিনা। এ বিষয়ে যথাযথ চিন্তা করেই পিডিবিকে সিদ্ধান্ত বলে দিয়েছি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে দাম বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।